বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মাত্র ৩৫ বছর বয়সেই
এক নেতার অভিষেক
হিমাংশু সিংহ

‘যিনি মানুষের মনে আশা জাগাতে পারেন তিনিই নেতা।’ কথাটা আমার নয়। বলে গিয়েছেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। সেখানে অবশ্য আদর্শ নেতার বয়সের কোনও উল্লেখ 
তিনি করেননি। কিন্তু বাংলার মানুষের মনে গত ৩৯ দিন ধরে ক্রমাগত সেই আশারই সঞ্চার করে চলেছেন এক তরুণ। ক্রমাগত কেন্দ্রের বঞ্চনা। প্রাপ্য অর্থ আটকে রাখা। এজেন্সির সন্ত্রাস, বিমাতৃসুলভ মনোভাব তথা যাবতীয় কেন্দ্রীয় আক্রমণের বিরুদ্ধে তিনি যেন জীবন্ত প্রতিবাদ। বাংলার স্বার্থ ছাড়া আর সবকিছুই তাঁর কাছে নগণ্য।
জন্ম ৭ নভেম্বর, ১৯৮৭। সেই হিসেবে এখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৫ বছর সাতমাস। জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ৬৪ বছর বয়সে, আর সিদ্ধার্থশংকর রায় ৫২ বছরে। আর ইনি এর মধ্যেই রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। দলের জাতীয় সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গ রাজনীতির শুধু অন্যতম আলোচিত মুখই নন, অধুনা প্রধান নিয়ন্ত্রকও বটে। তিনি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। যাদবপুর কেন্দ্রে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে বঙ্গ রাজনীতিতে মমতার ধূমকেতুর মতো আত্মপ্রকাশের তিনবছর পর তাঁর জন্ম। কিন্তু এত কম বয়সেও চালচলন, বাচনভঙ্গি, কৌশলী রাজনৈতিক পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই তাঁকে একজন পরিপূর্ণ নেতার মর্যাদা দিয়েছে। টানা দু’মাস বাংলার প্রতিটি জেলায় নিরবচ্ছিন্নভাবে তাঁবু খাটিয়ে জনগণের অভাব অভিযোগ শোনার দুঃসাহস খুব একটা দেখাতে পারেননি কেউ। বিরোধীদের মুখে ঝামা ঘষে তাঁর সেই যাত্রা আজ প্রায় ৩৯ দিনের মাথায় হাওড়ায় পৌঁছেছে। প্রবল দাবদাহ, জনতার আবদার মেটাতে গিয়ে শরীর ক্লান্ত, গলা ভাঙা, তবু দীর্ঘ ২০ কিলোমিটারের পদযাত্রায় ছেদ পড়েনি এতটুকুও। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গোটা নন্দীগ্রামের মানুষ হাত নাড়ছে।
তাঁর দু’মাসের এই নবজোয়ার যাত্রা ২৫ এপ্রিল উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলা থেকে শুরু হয়। অনেক নিন্দা, দেদার টাকার শ্রাদ্ধ হচ্ছে বলে প্রতিনিয়ত আক্রমণ, সার্কাসের তাঁবু বলে কটাক্ষ এবং 
পুলিস দিতে গিয়ে থানা ফাঁকা রাখার কুৎসা সব ভোঁতা করে ‘ভাইপো’র জয়যাত্রা কিন্তু তার কক্ষপথে অবিচল। লক্ষ্যে স্থির। কীভাবে একজন নেতার জন্ম হয়, তারই যেন চলমান ধারাবাহিক দেখছে বাংলা। কখনও বাসের মাথায় দাঁড়িয়ে হাত ছুড়ছেন, আবার কখনও জনতার সঙ্গে মিশে ১০০ দিনের কাজের টাকা আটকে থাকায় সাধারণের অসুবিধার কথা তুলে ধরছেন। কখনও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ঠিকমতো মিলছে কি না তার খোঁজ নিচ্ছেন।
গত একমাসেরও বেশি রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ একটার পর একটা জেলা চষে বেড়াচ্ছেন। অধিকাংশ সময়ই সাদা শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পরা আদ্যন্ত এক বাঙালি। জ্বালা ধরানো গরমের মধ্যে ঘরবাড়ি-পরিবার ব্যক্তিগত জীবন ছেড়ে এই নবজোয়ার যাত্রার দু’টো উদ্দেশ্য। এক নিজের দলকে আসন্ন নির্বাচনী লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করা এবং সেইসঙ্গে ক্রমাগত জনসভা, রোড শো, ছোটবড় মিছিলের মধ্যে দিয়ে জেলার মানুষের পালসটা বুঝে নেওয়া। কোনও হোটেল নয়, গেস্টহাউস নয়, খোলা মাঠে তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিবাস। জনগণের সঙ্গে কথা শেষ হওয়ার পরই আলোচনায় বসছেন পঞ্চায়েত ভোটে কে প্রার্থী হবেন এবং তার  দলীয় ভোটদান প্রক্রিয়া নিয়ে। কোথাও গণ্ডগোল হলে আবার ভোটগ্রহণ এবং পার্টির বিবদমান দুই গোষ্ঠীকে সাবধান করা। কেমন করে চলতে হবে, দিচ্ছেন তার দিকনির্দেশও। কোনও কিছু থেকেই বিরত থাকেননি তিনি। কেন্দ্রীয় এজেন্সি ডাকায়, মধ্যিখানে শুধু দু’দিনের জন্য ফিরেছিলেন কলকাতায়। নির্ধারিত সময়ের আগেই জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছেন। তারপর আবার তাঁর নির্দিষ্ট কর্মসূচিতে ফিরে গিয়েছেন শৃঙ্খলাবদ্ধ দলের সুযোগ্য জেনারেলের মতোই। 
প্রিয়, সুব্রত, সোমেন এই বাংলায় ছাত্রনেতা হিসেবে সত্তরের দশকে একটা ছাপ ফেলেছিলেন। বর্তমানের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক বরুণ সেনগুপ্ত প্রিয়-সুব্রত জুটি নিয়ে তাঁর পুরনো বহু লেখায় রাজ্য-রাজনীতিতে ঝড় তুলেছিলেন। দু’জনকেই অসম্ভব স্নেহও করতেন তিনি। সেই স্মৃতি আজ অনেকটাই ফিকে। তিনজনের কেউ আজ বেঁচে নেই। বিরোধীরা যতই কট্টর সমালোচনা করুন না কেন, বামফ্রন্টের ৩৪ বছরে মাত্র ৩৫ বছরের কোনও তরুণ বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে রাজ্যটা চষেছেন, তাঁবুতে রাত কাটাচ্ছেন এমন নজির নেই। হরেকৃষ্ণ কোঙার, দীনেশ মজুমদার, বিমান বসু, গৌতম দেবরা কোনও আন্দোলন সংগ্রাম যে করেননি, তা বলাটা ভুল হবে। কিন্তু সেটা কখনও এতবড় ক্যানভাসে ছড়াতে পারেনি। দুর্ভাগ্য বামেদের, ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা সম্ভাবনাময় সিপিএম নেতা দীনেশ মজুমদার মারা যান মাত্র ৪২ বছর বয়সেই।
এটা না বললে ভুল হবে সুভাষ চক্রবর্তীর মধ্যে সেই সম্ভাবনা ছিল। পুরোদস্তুর ছিল। হয়তো বুদ্ধদেব-অনিল বিশ্বাসের চেয়ে একটু বেশিই ছিল। কিন্তু ওই যে বললাম, পিছন থেকে জামা টেনে ধরে রাখার লোকের অভাব কোনওদিনও বাম দলে ছিল না। তাই অনিল বিশ্বাসদের চেয়ে মানুষের দরবারে বেশি গ্রহণযোগ্য ও ক্যারিশমার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আজীবন জ্যোতিবাবুর নয়নের মণি সুভাষকে সামান্য জেলার নেতা হিসেবেই জীবন কাটাতে হয়েছে! সেই উত্তর ২৪ পরগনা জেলাতেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রতিনিয়ত তাঁকে পিছনে টেনে রেখেছে। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর চেয়ারটুকুও জোটেনি তাঁর। অথচ ব্রিগেড ভরাতে, দলের কোনও সঙ্কটমুহূর্তে বারবার তাঁরই ডাক পড়ত। বিতর্কিত ‘হোপ ৮৬’ থেকে হকার তুলতে ‘অপারেশন সানসাইন’—শুধু বিতর্ক মাথায় নিয়েই সুভাষের রাজনৈতিক জীবন কেটে গিয়েছে। বামেদের স্বর্ণযুগেও পূর্ণতা পেল না কোনওদিন। আর ক্ষীর খেতেন পাকাচুলের কিছু তাত্ত্বিক নেতা, যাঁদের পিছনে তেমন কোনও জনসমর্থন ছিল না। এখন দেখার, দলের এই কঠিন সময়ে মীনাক্ষী, ঐশী, দীপ্সিতাদের জন্য কোন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে? দলের দুর্দিনে মীনাক্ষীকে আজ ব্যবহার করা হচ্ছে, সুসময় এলেই পাকা চুলের নেতারা আবার পিছন থেকে টেনে ধরেন কি না তাও কিন্তু ভাববার। আর কে না জানে প্রদেশ কংগ্রেস দীর্ঘদিনই রক্তশূন্য। হিমোগ্লোবিন পাঁচেরও নীচে!
এরাজ্যে বিজেপির সেই অর্থে কোনও নেতা কিংবা জননেতা নেই। এটা শুধু কাঁথি থেকে কাকদ্বীপ নয়—দিল্লির কী যুব, কী বৃদ্ধদের মধ্যেও। যা আছে সবই দলভাঙানো, দলবদলু কলঙ্কের দাগ মাথায় নেওয়া কিছু নেতা ও নেত্রী। দোআঁশলা চরিত্রের। আর আছেন হিন্দি বলয় থেকে আমদানি করা কিছু দেহাতি রাজনীতিক, সঙ্ঘ পরিবারের একনিষ্ঠ ছাত্র। আজীবন সপরিবারে তৃণমূলের উচ্ছিষ্ট খাওয়া, কালীঘাটের দয়ায় বেড়ে ওঠা কেউ যদি আজ হঠাৎ ভোটের 
বাজারে এসে কেউকেটা হয়ে উঠতে চান, তাতে বিজেপির কী লাভ হবে? আসলে, এদের কারও মধ্যেই বাংলার নাড়ির টানটাই নেই। কেউ কেউ ভুল মনীষীর গলায় মালাও দিয়ে ফেলেন। রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের নামে একটা জগঝম্প সংস্কৃতি উপহার দেন। বুঝিয়ে দেন, এই বাংলা কোনওভাবেই এই নেতাদের রাজনীতির ময়দান হতে পারে না। তাঁরা ‘বহিরাগতই’, বিদেশিদের মতোই। বাংলার মাঠ-ময়দানের চরিত্র বুঝতে, পথ চিনতে, এদিক-ওদিক ঘুরতে ‘দলবদলু’ সারথি লাগে। সেই সারথি আবার বিজেপিতে পা বাড়িয়েও বলেন, কই কোনওদিন ওখানে তো যাইনি, তৃণমূলেই তো আছি! আসলে বিভ্রান্তি আর সংশয় পরতে পরতে। কারণ মোদিজি বেপরোয়া চেষ্টা করেও একুশে বাংলায় মুখ থুবড়ে পড়েছে তাঁর গেরুয়া রথ। তাই একুশের বিধানসভা ভোটে ৭৭ জন জিতলেও এখন সংখ্যাটা কমে অনেক নীচে। আর যে-দল মানুষে-মানুষে বিভাজনের বিষ বপন করে আর হিন্দুত্বের কট্টর এজেন্ডা আঁকড়ে বসে থাকে, তারা আর যাই হোক, বাংলার মানুষের মনের ঠিকানায় পৌঁছতে পারে না। 
এরা গণতন্ত্রের পূজারী অথচ আসন্ন চব্বিশের লড়াইয়ের আগে দশ ক্লাসের সিলেবাস থেকে ‘গণতন্ত্র’ শীর্ষক অধ্যায়টাকেই বাদ দেওয়ার পণ করেছে। এরাজ্যে এখনও এতকিছুর পরেও গেরুয়া সংগঠন বলে কোনও বস্তু নেই। ক’টা বুথে তারা লোক দিতে পারবে, তা নিয়ে দিল্লির নেতৃত্বই চরম সন্দিহান। তাই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে এবং সংগঠন মজবুত করতে নামানো হয়েছে তাবৎ কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে। ইডি, সিবিআই জেরা করলে তৃণমূলের কাউকে ধরে আনলে বিরোধীদের তালি পড়ে। অন্যসময় কলকাতার মুরলীধর লেনে চূড়ান্ত নিস্তব্ধতা। হতাশা শুধু গুমরে গুমরে ওঠে।
নিন্দুকেরা অনেক কথা বলতে পারেন। গণতন্ত্রে বলতে কিছু বাধা নেই। কিন্তু ৩৫ বছর বয়সে এমন পরিণত দৃঢ়চেতা পরিমিত কথার নেতা শেষ কবে দেখেছে বাংলা? আর যাঁরা আইন থেকে বাঁচতে ক্রমাগত ‘ভাইপো’ বলে আড়াল থেকে আক্রমণ করছে তাদেরই বা এত ভয়ের কী আছে। অভিষেক তো আপনাদের নাম করেই জবাব দিচ্ছেন। আপনাদের নাম করে তোপ দাগার সৎ সাহস ওঁর আছে। নিন্দুকদের নেই। এখানেই আসল নেতা আর নকল নেতার পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে নাকি? 
নব জোয়ারকে সঙ্গী করে অভিষেকের এই রাজনৈতিক দৌড় কোথায় শেষ হবে জানি না। রাজনীতিতে চড়াই-উতরাই ওঠাপড়া থাকেই। সাফল্য ব্যর্থতাও নিত্যসঙ্গী। সমালোচনা, কুৎসা চলার পথের পরতে পরতে থাকবেই। তবে বাংলার আগামী অন্তত চার দশকের রাজনীতির উত্থান-পতন যে আজকের মাত্র ৩৫ বছরের মেরুদণ্ড সোজা ভয়ডরহীন ছেলেটাকে ঘিরে আবর্তিত হবে, সে-ব্যাপারে আমি অন্তত নিশ্চিত। বাংলার গত অর্ধ শতকের আপসহীন জননেত্রীর সার্থক উত্তরাধিকার। বাংলার আর কোন দলে পরের প্রজন্মের এমন গ্রহণযোগ্যতা আছে? গবেষণা করুন, উত্তর খুঁজে পাবেন না।

4th     June,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ