বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

পুরাণের রাজার প্রত্যাবর্তন
হারাধন চৌধুরী

মহাভারতে যুধিষ্ঠির জানতে চেয়েছিলেন, রাজার উৎপত্তি কীভাবে? উত্তর দিতে গিয়ে পিতামহ ভীষ্ম যা বলেছিলেন, তার সারকথা হল—মানুষের লোভ আর মোহ থেকেই রাজার জন্ম। পৃথিবীর সূচনায় প্রতিটি মানুষ আপন শৃঙ্খলায় সুখে বসবাস করত। কিন্তু একদিন তাদের মনে লোভ বাসা বাঁধল, মানুষ মোহান্ধ হয়ে উঠল, তখনই সমাজে দেখা দিল বিশৃঙ্খলা, সেটা ক্রমে গড়াল মাৎস্যন্যায় পর্যন্ত। তখনই প্রয়োজন দেখা দিল দণ্ড ও দণ্ডদাতা এবং একজন রাজার। চরম বিশৃঙ্খলা দমনের সূত্র ধরেই রাজা পৃথুর অভিষেক হয়। তাঁকে পৃথিবীর প্রথম রাজা বলা হলেও তিনি কিন্তু অন্য এক রাজারই উত্তরসূরি। অধর্মের মূর্তিমান বিগ্রহ বেণ রাজার ধ্বংসস্তূপ থেকেই পৃথুর উৎপত্তি। পুরাণ, মহাভারত প‍্রভৃতি বলছে যে, রাজা বেণের বিরুদ্ধে ব্রহ্মবাদী ঋষিদের মহাজোট তৈরি হয়। সেই জোট কৈফিয়ত দাবি করেছিল, পালনের প্রতিজ্ঞা ভুলে আপনি প্রজাদের ক্ষতি করছেন কেন? ধর্মপালনে ব্রতী হোন। বেণের অট্টহাসির সামনে ঋষিদের যাবতীয় পরামর্শ, হুঁশিয়ারি ফুৎকারে উড়ে যায়। বেণ উল্টে শুনিয়ে দেন, ধর্ম? সে তো আমিই সৃষ্টি করেছি! ইচ্ছে করলে এই পৃথিবী ধ্বংস করে জলে ভাসিয়ে দিতে পারি। আমি যেমন সৃষ্টি করেছি, ধ্বংস করতেও আমার হাত কাঁপবে না! 
রাজার এই অতিদর্পই কাল হল। ঋষিরা বেণকে ধ্বংস করে তাঁদের ডানহাত মন্থন করলেন। উঠে এলেন নতুন রাজা পৃথু। তাঁর শপথবাক্য পাঠ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কারও মতে, মানুষকে রক্ষার প্রশ্নে কোনওপ্রকার ভেদাভেদ না-করারই প্রতিজ্ঞা করেন তিনি। কিন্তু বেশিরভাগ পণ্ডিতের মতে, তিনি রাজকার্যে মনোনিবেশ করেন শুধু ঋষি-ব্রাহ্মণদের সুরক্ষার শপথ নিয়ে। পৃথু পুরো শপথবাক্য পাঠ করেননি। এই সামাজিক বোঝাপড়াটা সাধারণ মানুষ এবং রাজার মধ্যে হলে ভবিষ্যতে কোনও সমস্যা হতো না। প্রজাদের পরিবর্তে, চুক্তির প্রথম পক্ষে ছিলেন ঋষি-ব্রাহ্মণগণ। চুক্তি যেমনই হোক, পৃথিবীর সিংহাসনে বসলেন রাজা পৃথু। ভগবান বিষ্ণু তাঁর 
অংশ পৃথুর মধ্যে প্রবেশ করালেন। জগতে শৃঙ্খলা ও শান্তি ফিরে এল। কিন্তু সেসব কতটা স্থায়ী হল? প্রশ্ন থেকেই যায়। এই প্রসঙ্গে দুটি কারণ বড়: পৃথুর জন্ম স্বৈরাচারী বেণের থেকে এবং পৃথু সকল মানুষকে রক্ষার প্রতিজ্ঞা নেননি।
মানব সমাজে বারবার বিশৃঙ্খলা, হানাহানির কাহিনি সকলের জানা। 
এই সঙ্গে আজকের ভারতের কোনও মিল আমরা খুঁজে পাচ্ছি না কি? খবরকাগজ কিংবা টিভি খুলে প্রথমেই সামনে আসে আমাদের মন ভেঙে দেওয়ার ছবিগুলি। যেমন মণিপুরে একমাস ধরে চলছে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে হানাহানি। অবশেষে জঙ্গিদের উপর খড়্গহস্ত হয়ে উঠেছে সরকার। রবিবার যৌথ বাহিনীর আট-ন’ঘণ্টার অপারেশনে নিকেশ করা হয়েছে অন্তত ৪০ জন জঙ্গিকে। এখানে প্রশ্ন রয়ে যাবে, দেশেরই এতগুলি ‘মানুষ’ যে ‘জঙ্গি’ তকমা নিয়ে মরে গেল, তার দায় রাষ্ট্র নেবে না কেন? দেশটাকে মোদি সরকার গত ন’বছরে নানাভাবে ভেঙেছে: হিন্দু মুসলমান, আমিষাশী নিরামিষাশী, সাধারণ আমিষাশী গোমাংস ভক্ষণকারী, হিন্দিভাষী অহিন্দিভাষী, ধনী গরিব, বিজেপি অবিজেপি, সিঙ্গল ইঞ্জিন ডাবল ইঞ্জিন প্রভৃতি সংখ্যাহীন গোষ্ঠীতে। এই পরিকল্পিত বিভাজনের চূড়ান্ত গন্তব্যের নাম স্বৈরশাসন। সেটাই এখন চলছে, অংশত। একনায়ক চান, তার সাংবিধানিক বৈধতাসহ সমগ্রটা।
মোদির ভারত স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব উদযাপনে মশগুল। ইতিমধ্যে আকাশবাণী মারফত বিশ্ববাসীকে শুনিয়ে ফেলেছেন তাঁর ১০১তম ‘মন কি বাত’। এমনকী, রবিবার সাভারকারের জন্মদিনে মহাসমারোহে তিনি উদ্বোধন করেছেন নতুন সংসদ ভবনের। এমন অনুষ্ঠানে ব্রাত্য ছিলেন দেশের পয়লা নম্বর নাগরিকই। প্রথম আদিবাসী মহিলা রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর এই অপমানের প্রতিবাদে প্রথম সারির ২১টি রাজনৈতিক দল সংসদের এই আলো ঝলমলে অনুষ্ঠান বয়কট করে। তার আগের দিন, নীতি আয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকও বয়কট করেন দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দশজন মুখ্যমন্ত্রী। বস্তুত মোদিকে রাজনৈতিকভাবে ‘একঘরে’ করে দেওয়ারই আন্দোলন জারি রয়েছে দেশজুড়ে। কারণ তাঁর জমানায় সংবিধান, সংসদ, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র পঞ্চত্বপ্রাপ্তির দশায় পৌঁছে গিয়েছে। রাজধানীর রাজনৈতিক মহলে এই কথাও চালু আছে, মন্ত্রিসভা একটি আছে বটে, তবে বাস্তবে সব দপ্তরেরই মন্ত্রী একজন—প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং। 
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, সেকালের বিখ্যাত কার্টুনিস্ট‍ শংকরের আঁকা ‘বিধান রায়ের ক্যাবিনেট’ শীর্ষক এক কার্টুনের কথা। ছবিটিতে দেখানো হয়েছিল যে, একটি টেবিল ঘিরে অনেকগুলি চেয়ার, কিন্তু সবগুলি চেয়ারে উপবিষ্ট একজনই—এক ও অদ্বিতীয় বিধানচন্দ্র রায়! ছবিটির প্রেক্ষিতে তাঁর মন্ত্রিসভার এক মন্ত্রী পরে ঘনিষ্ঠমহলে বলেছিলেন যে, খাওয়া-দাওয়া সেরে বেলা ১২টা নাগাদ আমরা কচ্ছপের মতো গুটি-গুটি পায়ে অফিসে ঢুকি। তারপর বিধানবাবু এসে আমাদের সবাইকে চিৎ করে দেন। তখন আমরা একটু হাত-পা নাড়ি আর গলা বাড়িয়ে ইতিউতি তাকাই। আবার বিকেল ৪টের পর মুখ্যমন্ত্রীই আমাদের সোজা করে বসান। আমরাও একইভাবে ধীরেধীরে যে যার বাড়ি ফিরে যাই। বিধানবাবুর সঙ্গে আজকের ভারতেশ্বরের মানসিকতার মিল কিছু নেই, দু’জনের মধ্যে তুলনাও টানছি না। তবে, শংকরের স্মরণীয় ওই কার্টুনের অবতারণা আজকের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার করুণ দশার প্রসঙ্গেই। বিরোধী দল ও রাজ্য সরকারগুলিকে দমনের অছিলায় মোদি শুধু সাধারণ দেশবাসীকে দুরমুশ করছেন না, দল এবং সরকারের অভ্যন্তরেও প্রশ্বাস গ্রহণের অবকাশটুকু রাখেননি। 
নয়া সংসদ ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিরোধীদের অনুপস্থিতির  প্রসঙ্গে আমাদের খেয়াল করা উচিত—স্বাধীনতা ঘোষণার ‘আনন্দ-মুহূর্তে’ গান্ধীজি কোথায় ছিলেন, কী করছিলেন? সাভারকারের অনুগামীদের হিংসার বলি তিনি তখনও কিন্তু হননি। শোনা যায়, কোনও এক জ্যোতিষীর পরামর্শে স্বাধীনতার ঘোষণার মুহূর্তটিকে মধ্যরাত্রি অব্দি গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আগেই চাউর হয়েছিল যে, দিল্লিতে ঐতিহাসিক উৎসবে মহাত্মা গান্ধী থাকছেন না। ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭, রাত ১২টায় জওহরলাল নেহরুর আগেবঘন কণ্ঠ ভেসে এসেছিল বেতারে, ‘বহু বছর আগে আমাদের ভাগ্যদেবতার সঙ্গে যে অভিসারের সংকল্প আমরা নিয়েছিলাম তা পূর্ণ করার সময় উপস্থিত।’ ‘আমরা আজ স্বাধীন’—সেই মুহূর্তে দেশবাসীর মনে অন্যকোনও ভাবনার জায়গা হয়নি। সবার মনে এই আশাই গাঢ় হয়ে উঠেছিল যে, এবার সমস্ত ধরনের বিভেদ, বৈষম্য ঘুচে যাবে, দেশজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায়ের শাসন। 
কিন্তু গান্ধীজির মনে কি সংশয় ছিল? তিনি কি বুঝেছিলেন, এই রোমান্স বাষ্পীভূত হয়ে যাওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা? হয়তো সত্যি অথবা নয়। বাস্তবে যেটা দেখা গিয়েছিল, স্বাধীনতা উদযাপনের মুহূর্তে তিনি কলকাতায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতিরক্ষায়। এদিকে কলকাতা এবং অন্যদিকে নোয়াখালি ধর্মীয় ভেদাভেদকে কেন্দ্র করে চরম অশান্ত তখন। শান্তি ফেরানোর দায়িত্ব নিয়ে ৯ আগস্ট কলকাতায় এসে পৌঁছন গান্ধীজি। আমরা জানি, তার পরেও আর কখনও স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেননি তিনি, অথচ ভারতের স্বাধীনতাই ছিল তাঁর আজীবনের সাধনা। এই প্রসঙ্গে আরও জানানো যায়, ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি দিল্লির এক প্রার্থনাসভায় মহাত্মা নিহত হন। ‘সুসংবাদ’ পেয়েই কলকাতার এক বিখ্যাত পণ্ডিত-অধ্যাপক বহুজনকে মিষ্টিমুখ করিয়েছিলেন! পরে তিনি অবশ্য জায়গা মতো গান্ধীজিরই প্রশস্তি গাইতেন শতমুখে! 
এর মধ্যে দেশের আজকের শাসকদের মিল খোঁজার চেষ্টা করুন, আশা করা যায়, নিরাশ হবেন না। মোদিকে দেখে মনে হয়, আধুনিক ভারতকে রাজা বেণ কিংবা পৃথুর যুগেই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বপালনে ব্রতী তিনি। 

31st     May,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ