বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মোদিবাবুর আপন দেশে, গণতন্ত্র সর্বনেশে
সন্দীপন বিশ্বাস

আজ থেকে ঠিক দু’শো বছর আগে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের প্রতিবাদে রাজা রামমোহন রায় তাঁর ফারসি ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্র ‘মীরাৎ-উল-আখবার’-এর পাতায় এক অগ্নিস্রাবী নিবন্ধ লিখেছিলেন। ইংরেজদের সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন যখন গণতান্ত্রিক স্বরের কণ্ঠরোধ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, তখন তিনি তাদের একেবারে ধুয়ে দিয়েছিলেন। ১৮২৩ সালের ৪ এপ্রিল প্রকাশিত সেই লেখার তীব্র কশাঘাত যুগ যুগ ধরে অমর হয়ে থাকবে। বিস্তৃত সেই নিবন্ধে রামমোহন রায় লিখেছিলেন, ‘আব্রু কে বা সদ্‌ খুন ই জিগর দম্ভ্‌ ঩দিহদ্‌ / বা উমেদ্‌ ই করম এ খাজা, বা দারবান মা ফরোশ’। এর মূল বক্তব্য হল, হৃদয়ের শত রক্তবিন্দু ও সোজা শিরদাঁড়া দিয়ে মানুষ যে সম্মান অর্জন করে, রাষ্ট্রের অনুগ্রহে তাকে কখনওই বিকিয়ে দেওয়া যায় না। 
দু’শো বছর পরে আজ দেশের গণতন্ত্র যখন দারুণভাবে নিপীড়িত, যখন ভয়ঙ্কর এক হাত দেশের গণতন্ত্রের কণ্ঠরুদ্ধ করতে মরিয়া, তখন বারবার রামমোহনের সেই লেখার কথাই মনে পড়ছে। এই সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে যে কোনও শুভবোধসম্পন্ন মানুষের মনে হতে পারে, যে দেশে আমার জন্ম, যে দেশের প্রতিটি অংশকে আমি চিনি, মোদিজির আমলের এই দেশ, আমার সেই দেশ নয়। হিংসা, কুৎসার আবর্জনায় ভরা এই দেশ, যেন আমার দেশ নয়, বিলকিস বানোর সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীরা যে দেশে মুক্তির উল্লাসে ঘুরে বেড়ায়, সেই দেশ আমার দেশ নয়। ক্রমেই কনসেনট্রেশন ক্যাম্প হয়ে ওঠা এই দেশের আত্মার ভিতরে একই সঙ্গে ধ্বনিত হচ্ছে ক্রন্দন ও প্রতিবাদ। আমরা সেই ভারতকে ফিরে চাই।  
সেই ২০১৪ সাল থেকে গণতন্ত্রের দমবন্ধ করা পরিবেশের শুরু। বিপথগামী এই গণতন্ত্রে লক্ষ্য শুধু হিংসা, বিচ্ছিন্নতা আর মিথ্যার বেসাতির মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের খেলা। সঙ্গে রয়েছে বিপুল টাকার তহবিলের আত্মম্ভরিতা। তাই বিপন্নতা বাড়ছে, রক্তাক্ত হচ্ছে গণতন্ত্র। বিশ্বজুড়ে ধ্বনিত হচ্ছে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা। সব দেশের রিপোর্টই বলছে, মোদিবাবুর আপন দেশে, গণতন্ত্র সর্বনেশে। মোদিরাজ আজ ক্রমেই মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে খাদের কিনারে। এখন সামনে বিজেপি, পিছনে মৃত্যু। দু’টোই বোধহয় আজ সমার্থক হয়ে উঠেছে। 
একদিন যাঁরা বুকের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতার লড়াই করেছিলেন, তাঁদের আজ প্রায় সকলেই পিছনের সারিতে। আর সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় ইংরেজদের কাছে ‘ প্রভু, আর কোনওদিন করব না, আমাকে রেহাই দিন’ ধরনের ক্ষমাভিক্ষা চেয়ে পাঁচবার চিঠি লেখা নেতারা আজ বিরাট বড় দেশভক্ত হিসাবে স্বীকৃত হচ্ছেন! তাঁদের পার্টিই মানুষকে দেশভক্তি শেখাচ্ছে। ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দেশকে যখন ধর্মের মৌলবাদে মুড়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, তখন বোঝাই যায় এর পিছনে বিজেপির কোনও নিজস্ব এজেন্ডা আছে। ভারতাত্মার সুরের সঙ্গে সেই এজেন্ডা না মিললেও জোর করে তার প্রয়োগ করার চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। বিজেপি জানে স্বৈরতন্ত্রের প্রথম শর্তই হল বিরোধী স্বরকে স্তব্ধ করে দাও, তাদের হেনস্তা কর এবং দ্বিতীয় শর্ত হল গোয়েবলসের মতো অহরহ মিথ্যা প্রচার চালিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে দাও। হিটলারের সেই অলিখিত নিজস্ব সংবিধানই আজ বিজেপির উত্থানের পথ। তার প্রক্রিয়া গোড়া থেকে ধীরে ধীরে শুরু হয়েছিল। তখন তার স্বরূপ বোঝা যায়নি। আজ সেই ঝুটা গণতন্ত্রের নখ, দাঁত বেরিয়ে এসেছে। এই দেশে রাজভক্ত ছাড়া কেউ আর গলা তুলে কথা বলতে পারবেন না। বিরুদ্ধ স্বরকে স্তব্ধ করতে একের পর এক জেলের দরজা খুলে দিচ্ছে বিজেপি সরকার। আগামী দিনে সারা দেশটাই হয়তো একটা জেলখানা হয়ে উঠবে।  
আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলেন রাহুল গান্ধী। তাঁর দু’বছরের সাজা ঘোষণা হল। এরপর আদালত ৩০ দিনের মধ্যে তাঁকে উচ্চ আদালতে আবেদন করার সুযোগ দেয়। কিন্তু বিজেপি সরকার সেই সুযোগ দিতে রাজি নয়। তড়িঘড়ি রাহুল গান্ধীর সংসদের সদস্যপদ কেড়ে নেওয়া হল। প্রশ্ন উঠেছে, যে পদ্ধতিতে রাহুলকে সংসদ থেকে সরিয়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বিজেপি, সেখানে তাদের পদক্ষেপ কতটা যথার্থ ছিল! আইনজ্ঞদের একাংশ সাজা শুরু হওয়ার আগেই এমন চরম পদক্ষেপ নেওয়ার প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলেছেন। আসলে ভারত জোড়ো যাত্রার সাফল্য এবং সংসদে আদানি নিয়ে নানা পর্দা ফাঁসের উদ্যোগ ভালো চোখে দেখেনি বিজেপি। তাই অত্যন্ত সুকৌশলে রাহুল গান্ধীর কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা হল। সেইসঙ্গে আরও একটা চাল দিয়ে রাখল বিজেপি, আগামী ৬ বছর নির্বাচনে যাতে রাহুল গান্ধী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারেন, তারই চেষ্টা করা হল। 
আচ্ছা, মোদিজির কি বাবুভাই বোখিরিয়ার নামটা মনে পড়ে? না মনে পড়ার কিছু নেই। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বাবুভাই তাঁরই মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ছিলেন। খনি কেলেঙ্কারির ঘটনায় ৫৪ কোটি টাকা চুরির অভিযোগে তাঁর তিন বছরের সাজা হয়। ২১১৩ সালে সেই সাজা পাওয়ার পর সেদিন কিন্তু নরেন্দ্র মোদি তাঁকে পদত্যাগ করতে বলেননি বা তাঁর সদস্যপদ কেড়ে নেওয়া হয়নি। অনেক পরে অবশ্য বোখিরিয়া সাজা থেকে রেহাই পান। গণতন্ত্রের ‘প্রকৃত উপাসকদের’ মধ্যেও তাহলে এই ধরনের দ্বিচারিতা দেখা যায়?    
আচ্ছা, বিজেপি যাঁকে মাঝেমধ্যেই ‘পাপ্পু’ বলে মস্করা করে, তাঁকে এত ভয় কেন মোদিজির? কেন তাঁকে সরানোর জন্য বিজেপির এই মরিয়া চেষ্টা? জানি না, আগামী দিনে এই হঠকারী সিদ্ধান্ত বিজেপির অনুতাপের কারণ হয়ে উঠতে পারে কি না! আসলে বিজেপি কী করল? আগুনকে নেভাতে গিয়ে উস্কে তার তেজ আরও বাড়িয়ে দিল। রাহুলের সদস্যপদ কেড়ে নেওয়া নিয়ে সারাদেশে বিরোধীদের মধ্যে প্রবল প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে। বিধানসভায় দাঁড়িয়ে কেজরিওয়াল এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, স্বাধীন ভারতে সবথেকে ‘ভ্রষ্ট’ প্রধানমন্ত্রী মোদি, স্বাধীন ভারতে সবথেকে কম লেখাপড়া জানা মানুষ নাকি আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী। অহঙ্কার তাঁকে গ্রাস করেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর কাজ মানুষকে শুধু জেলে ভরো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তীব্র ভাষায় বলেছেন, মোদির নতুন ভারত লাগাতার নিশানা করছে বিরোধীদের। অথচ অপরাধ করেও বিজেপি নেতাদের জায়গা হচ্ছে মন্ত্রিসভায়। 
আজ আমরা গণতন্ত্রের এক অন্ধকার অধ্যায়ের সাক্ষী। যেখানে নীরব মোদিদের মতো ছাপ্পা মারা চোরেরা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াবে আর রাহুল গান্ধী সহ বিরোধী নেতাদের জেলে পোরা হবে। মমতা যথার্থ কথাই বলেছেন, বিশুদ্ধতার প্রতীক হতে চাওয়া বিজেপির মন্ত্রিসভা ও পরিষদীয় দলে কেন থাকবেন ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তরা? বিজেপি নেতারা কোনও জবাব দেন না। শুধু তাঁরা বলেন, চুপ, গণতন্ত্র চলছে! 
কেমন সেই গণতন্ত্রের স্বরূপ? কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় মানুষকে উত্তেজিত করে বলেন, দেশ কি গদ্দারো কো...। সমবেত জনতা দেশাত্মবোধের বাষ্পে ফুঁসে উঠে বলে, গোলি মারো শালোকো। ভক্তদের উত্তেজিত করে গণতন্ত্রের পুজো করার এ কোন ব্যুমেরাং খেলা? বিজেপির আর এক মহিলা সদস্য তিনি শত্রু নিধনের জন্য ঘরে ঘরে ছুরি শানিয়ে রাখতে বলেছেন। চারিদিকে শুধু হেট স্পিচ, সেখানে ভালোবাসার নিরুদ্ধ দ্বার। এই হেট স্পিচের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে হয়েছে সুপ্রিম কোর্টকেও। ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই হিংসা ছড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার অশুভ চক্রান্ত রুখে দিতে না পারলে সোনার ভারতকে একদিন এরা ছিবড়ে করে ছেড়ে দেবে। 
আসলে বিজেপি সরকারের বিভিন্ন হঠকারী এবং অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত ধীরে ধীরে সমস্ত বিরোধী শক্তিকে এক ছাতার তলায় এনে দিল। নতুন এক উদ্দীপ্ত বিরোধী শক্তিকে দেখা যাচ্ছে। আজ সকলেই বুঝেছেন, ২৪-এর লড়াইয়ের মূল মন্ত্রই হল বিরোধীদের কাছে ‘ডু অর ডাই’। এই লড়াইকে পাথেয় করে হাতে হাত ধরে এগলে বিজেপির প্রস্থানের পথ মসৃণ হয়ে উঠতে পারে। মনে রাখা দরকার, বিজেপি ২০১৯ সালে ৩৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।  সম্মিলিত বিরুদ্ধ স্বরের সামনে বিজেপি কিন্তু সংখ্যালঘু শক্তি। মাত্র পাঁচ-ছয় শতাংশ ভোট সুইং করলেই বিজেপির পতন অনিবার্য। 
সত্যকে জেলবন্দি করলেই যদি সমস্যা মিটে যেত, তাহলে তো পৃথিবীর কোনও স্বৈরশাসকেরই পতন হতো না। মধ্যযুগে স্বৈরশাসকরা সফল হয়নি, আধুনিক সময়েও তা হয়নি। হিটলাররা কিছুদিন দমন করতে পারে, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বানাতে পারে, কিন্তু বিনাশ তাদের হবেই। এভাবেই বুঝি বারবার ‘বিনাশ কালে বুদ্ধিনাশ’ কথাটা সত্যি হয়ে ওঠে। তাই দেশে গণতন্ত্রের যে বহ্ন্যুৎসব শুরু হয়েছে, সম্মিলিত বিরোধী শক্তির উত্থানে শেষ পর্যন্ত তা হয়ে উঠতে পারে খাণ্ডবদহন পালা। 
 

29th     March,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ