বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মমতা রসায়নের তল পাবে বিরোধীরা?
হিমাংশু সিংহ

১৯৮৪ সালে ইন্দিরা হত্যার পর পর সাধারণ নির্বাচনে ধূমকেতুর মতো রাজনীতিতে উত্থান মমতার। যাদবপুরে সিপিএমের কুলীন ব্যারিস্টার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে তিনি যে অমন হেলায় হারাবেন তা বিশ্বাস করতে চাননি কেউ। ‘বর্তমান’ সংবাদপত্রের বয়সও তখন মাত্র এক-দু’মাস। মনে আছে ওই কেন্দ্রের প্রিভিউ লিখতে গিয়ে আমার বন্ধু তরুণ রিপোর্টার দেবাশিস চক্রবর্তী সেদিন মমতাকে এগিয়ে রেখেছিলেন বলে পোড়খাওয়া বাম নেতারা মুখ টিপে হেসেছিলেন। উপহাস করেছিলেন। ফল বেরতেই সবার অবাক হওয়ার পালা। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অনেক ঝড়ঝাপ্টা পেরিয়ে মমতা আজ প্রায় ১২ বছর এরাজ্যের সফল মুখ্যমন্ত্রী।
তাঁর জন-আকর্ষণী শক্তির জয় হয়েছে বারবার। পথের আন্দোলন থেকে দেড় বছর আগের কঠিনতম বিধানসভা নির্বাচনে। তবু ইদানীং অনেকেই বলছেন, এটাই মমতার রাজনৈতিক কেরিয়ারের সবচেয়ে খারাপ সময়। একাধিক নেতা মন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে জেলে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে গোরু, কয়লা পাচার প্রভৃতি দুশো দুর্নীতির খতিয়ান সামনে এনে রোজ ঝাঁপিয়ে পড়ছে নরেন্দ্র মোদির ‘দুগ্ধপোষ্য’ এজেন্সি! ইডি, সিবিআই, আয়কর আরও কত কী! সকাল থেকেই এখানে ওখানে জেরা, গ্রেপ্তার। ‘লুটের’ সম্পত্তির দুশো ফিরিস্তি, বাদ যাচ্ছে না কিছুই। সাগরদিঘির ফল বেরতেই সংখ্যালঘু ভোট পিছন থেকে সরে যাওয়ার ব্যাখ্যাও হাজির করা হচ্ছে যত্রতত্র। ইডির বলে বলীয়ান বিরোধীদের মোদ্দা বক্তব্য, চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলার জননেত্রীর গ্রাফ অবশেষে নাকি নীচে নামছে। ভাবমূর্তি টাল খাচ্ছে যেন। এটুকু বার্তাই এক আটপৌরে ঘরের মেয়ের কাছে গোল খেতে খেতে প্রায় নিশ্চিহ্ন তথাকথিত বিরোধী শক্তির অক্সিজেন, আত্মতুষ্টি। কিন্তু একটা কথা সবিনয়ে বলি, মমতার চলার পথ কোনওদিনই কি গোলাপ ছড়ানো ছিল? ‘একলা চলো’র সুরেই তার এগিয়ে যাওয়ার স্থায়ী-অন্তরা আগাগোড়া বাঁধা। ১৯৮৪, ১৯৯৩, ২০০১, ২০০৪ এবং অবশ্যই ২০১১ সালের পালাবদলের যাত্রাপথে ওই একটাই সুর বেজেছে ক্রমাগত। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঈর্ষণীয় সাহস আর ইচ্ছাশক্তির জয় হয়েছে। সেই তার ছেঁড়েনি এখনও। এক পায়ে খেলা হবে থেকে আসন্ন আম্বেদকর মূর্তির পাদদেশের ধর্না মঞ্চ, যে কোনও মুহূর্তে লড়াইয়ের রং বদলে দিতে আজও বঙ্গ রাজনীতিতে তাঁর জুড়ি নেই।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম তিন দশকেরও বেশি কেটেছে বজ্রমুঠি সিপিএম নামক জগদ্দল শাসকের মোকাবিলা করে। প্রতিবাদ করতে গেলেই জুটেছে চরম হেনস্তা। হাজরা মোড় থেকে চমকাইতলা। গোঘাট, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, ডানকুনি। মার, অপমান, পাঁজাকোলা করে রাইটার্স থেকে গলা ধাক্কা। ৩০ বছর আগে শহিদ মিনারে (পড়ুন ১৯৯৩) শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিসের গুলি। মৃত্যুমিছিল। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে এসেছে প্রতিনিয়ত। রাজ্যের বহু এলাকায় সেসময় বিরোধীদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। হ্যাঁ, আজ গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দেওয়া বামেদের আমলে। স্বজনপোষণ ও চিরকুটে কাছের লোকের চাকরি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়া ছিল জলভাত। শিক্ষায় অনিলায়ন থেকে হোলটাইমারদের পরিবার পরিজনের মাস মাইনের স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা। ভোট লুট, বুথের পর বুথ নির্বাচনের সকাল থেকেই বিরোধী এজেন্টদের মেরে বের করে দেওয়ার কথা কি আজ ১২ বছরের মধ্যেই বিমান বসুরা ভুলে গিয়েছেন? এত করেও মমতার বিজয় রথ থামানো যায়নি! এটাই সত্য। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের অভিঘাতে ঐতিহাসিক পালাবদল যখন সম্পূর্ণ হল, তখন শুরু হল উপহাস আর ক্রমাগত ছোট করা। সেই সঙ্গে ষড়যন্ত্র। তাঁর আঁকা, কবিতা, গান, এমনকী পরিবার পর্যন্ত এই চক্রান্তের হিটলিস্টে। সেই আক্রমণ অব্যাহত আজও। তবু সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও ২০১৬ ও ২০২১ সালের নির্বাচনে দাঁত ফোটাতে ব্যর্থ হয়েছে বাম-কংগ্রেস ও বিজেপি। সেই হতাশা তাদের কুরে কুরে খেতে বাধ্য। এবার তৃণমূলের ‘সবাই চোর’ এই প্রচারকে সামনে রেখে প্রথমে চব্বিশের লোকসভা ও পরে ছাব্বিশ সালের মেগা ফাইনালের অপেক্ষা।
প্রশ্ন একটাই, তাতেও কি চিঁড়ে ভিজবে? মুখের কথায় তো কিছুই প্রমাণ হয় না। কিংবা তল্লাশি আর ধরপাকড়ে। যাবতীয় অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে আদালতে। বিচার ব্যবস্থার চৌহদ্দিতে। ইডি, সিবিআইয়ের অভিযোগ প্রমাণ করে শাস্তি বিধানের শোচনীয় হার তো মানুষের অজানা নয়। বোফর্স মামলা থেকে কোটি কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পালানো নীরব মোদি, বিজয় মালিয়াদের কি ফেরাতে পেরেছে মোদিজির এজেন্সি। কিংবা মৃতপ্রায় দাউদকে। তাহলে কোথায় তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা। ২০১৩ সালের কথা মনে আছে। সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে ঝড় উঠেছিল। আজ এখানে, কাল ওখানে কত তল্লাশি, গ্রেপ্তার। আজ এক দশক পরেও শাস্তিবিধান, দোষী সাব্যস্ত করা দূরে থাক, বিচার প্রক্রিয়াটাই শুরু হল না কেন? কোনও  রাঘববোয়াল বিজেপিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন বলে? কিংবা নারদ কেলেঙ্কারি? স্থানীয় এক দলবদলুর সৌজন্যে সেই তদন্ত আর একটু এগলেই সেমসাইড গোল হয়ে যেতে পারে বলে আজ নারদ নিয়েও নীরবতা! আসলে কোনও মামলায় সিবিআইয়ের অতি সক্রিয়তার এক যুগ পর বোঝা যায় সবটাই প্রভুর নির্দেশে স্রেফ নাটক ছিল! তাই কাত্রোচ্চিরা নিরাপদে পালাতে পারে, বোফর্স মামলা মাঝপথে গুটিয়ে নিতে হয় ঝানু গোয়েন্দাদের!
নেতানেত্রীদের ভোটব্যাঙ্ক রসায়নের প্রমাণ মেলে একমাত্র নির্বাচনের পরিণামে। সারিবদ্ধভাবে বুথে গিয়ে ইভিএম যন্ত্রের বোতাম টেপায়। এরাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের এখনও তিন বছর দেরি। লোকসভা ভোটের জন্য অপেক্ষা করতে হবে চোদ্দো মাস। তার মধ্যে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে যাবে নিশ্চিতভাবে। খেলাও হবে প্রচুর। আপাতত সরাসরি যুদ্ধে না পেরে একটা ‘পারসেপশন ব্যাটল’ চলছে। মরিয়া হয়ে বিরোধীরা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে, তৃণমূল মানেই আসাধু। দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। এই দুর্নীতির জাল মাথা পর্যন্ত বিস্তৃত। উল্টোদিকে বিরোধীরা সবাই সৎ, সাধুপুরুষ। এক বিরোধী নেতা প্রায় রোজ জেলা থেকে কলকাতায় এসে জননেত্রীকে নিয়ম করে তোপ দাগছেন। কিন্তু একবারও বলছেন না, বিগত ১২ বছরের মধ্যে প্রায় দশ বছর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগ্রহেই তাঁর সকাল সন্ধে অতিবাহিত হয়েছে সগৌরবে। তাঁর পরিবারও কম পায়নি। তাঁর পরিবারের স্বাধীনতা আন্দোলনে যত বড় ভূমিকাই থাক আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি মমতারই সৌজন্যে, এই সত্যটা মানতেই হবে শয়নে স্বপনে। আর কংগ্রেস ও লেজুড় বামেরা তাঁদের শাসনে কী করেছেন। কোথায় কত আইনি নিয়োগ আর বেআইনি কর্মসংস্থান হয়েছে, তার শ্বেতপত্রও প্রকাশ হোক। তাহলেই দুধ কা দুধ পানি কা পানি হয়ে যাবে। কোন শর্তে কোথায় কত লাল পার্টির সম্পত্তি তাও বেরিয়ে আসুক দিনের আলোয়।
প্রকাশের দিন থেকে প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বরুণ সেনগুপ্তর ‘বর্তমান’ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। এজন্য ব্যক্তিগতভাবে অনেক মূল্যও চোকাতে হয়েছে তাঁকে। তাই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্তদের কঠোরতম শাস্তি চাই, এই আমাদের দাবি। কিন্তু বিচারটা যেন সমানে সমানে হয়। বারবার গোলপোস্টটা বদলে না যায়। রাজনৈতিকভাবে এঁটে উঠতে না পেরে এজেন্সি লেলিয়ে দেওয়ার নাটক চলবে না। বাংলার রাজনীতিতে তৃণমূলকে হেয় করার এই খেলা মোটেই নতুন নয়। একুশ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে এমনই গেল গেল রব তুলেছিল বিরোধীরা। ভাবটা এমন, যেন ক্ষমতা দখল হয়েই গিয়েছে। ফল বেরলেই রাজভবনে গিয়ে শপথ নেওয়ার অপেক্ষা। নেত্রীকে পেড়ে ফেলতে দু’বছর আগেও রাম-বাম সব একজোট হয়েছিল। কাঁচরাপাড়া থেকে কাঁথি, উত্তরপাড়া থেকে শিবপুর, মিলেছিল ক্ষমতা দখলের ডাকে। উল্টোদিকে ভাঙা পায়ে তিনি একা। দেদার টাকার খেলা, নিত্য দল ভাঙা ও যোগদান করানোর মেলা। কলকাতা থেকে জেলার সব প্রথম সারির হোটেল ভাড়া করে বহিরাগত নেতাদের মোচ্ছব, কী দেখেনি বাংলার মানুষ। শুধু প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিলেই সত্তরটারও বেশি সভা করেছিলেন। কিন্তু ফল বেরতে দেখা গেল দু’শো আসন দূর অস্ত! একশোর আগেই থেমে গিয়েছে বিজেপি। কংগ্রেস ও বামেরা রক্তশূন্য। বিধানসভায় একজনও নেই। ‘গেল গেল’ রব ওঠা তৃণমূলই রেকর্ড আসন জিতে ফের ক্ষমতায়। ২০১৬ সালে মাঠেই ছিল না বিজেপি। সেবার নেত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বাম ও কংগ্রেস জোট করেছিল। বিমানবাবুদের গলায় সে কী প্রত্যয়। যেন ক্ষমতায় ফেরা হয়েই গিয়েছে। কিন্তু মানুষ ৩৪ বছরের অত্যাচারের কথা মনে রেখে বামেদের সেবারও শূন্য হাতেই ফিরিয়ে দেয়। 
চিরদিনই সঙ্কটে তাঁর রাজনৈতিক উপস্থিতি আরও বড় ক্যানভাসে ধরা পড়ে। কঠিন চ্যালেঞ্জ তাঁকে আরও ধারালো করে। নব্বইয়ের দশকে বঙ্গের একপেশে অচলায়তন রাজনীতির অঙ্গনে তিনি সহসা একটা খোলা হাওয়া হয়েই সামনে এসেছিলেন। আর আজ নিজের ক্ষমতায় ডান বাম সবার টার্গেট। কিন্তু মমতাকে কোণঠাসা করাই কি এই মুহূর্তে জাতীয় রাজনীতির অগ্রাধিকার? এরাজ্যে সিপিএম ও কংগ্রেস বিপন্ন হয়ে ফ্যাসিবাদী শক্তির  সঙ্গে হাত মেলাতেও পিছপা  হচ্ছে না, এটা কি জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে খুব ভালো বিজ্ঞাপন? যখন বিজেপির সৌজন্যে দেশে গণতান্ত্রিক পরিসর ক্রমেই সংকুচিত, রাহুল গান্ধীর লোকসভার সদস্যপদ পর্যন্ত খারিজ হয়ে গিয়েছে, তখন বিরোধী জোট না গড়ে মমতার বিরুদ্ধে লড়ে কোন লাভটা হবে সোনিয়া গান্ধীর? এতো সেমসাইড গোল! কিংবা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বন্ধ হয়ে গেলে কোন  ফায়দাটা হবে গরিব মানুষের। সবার আপত্তি অগ্রাহ্য করে তিনি কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দেন, কারণ তিনি মানুষের রাজনীতি করেন। আর কে না জানে সত্যি বিজেপিকে  ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইলে মমতার মতো স্ট্রিট ফাইটারের প্রয়োজনই সর্বাগ্রে। সীতারাম ইয়েচুরিদের দিয়ে কোনও পরিবর্তন সম্ভব নয়।

26th     March,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ