বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

জোট করে ভোট? নাকি
ভোটের পর জোট?
সমৃদ্ধ দত্ত

বিজেপি বনাম বিরোধীদের মধ্যে রাজনৈতিক লড়াইয়ে বিরোধীদের বারংবার পরাস্ত হতে হচ্ছে এক ও একটিমাত্র মানদণ্ডে। সেটি হল প্রচার অথবা প্রোপাগান্ডা। প্রচারকে বিজেপি একটি ৩৬৫ দিনের প্রকল্প হিসেবেই গ্রহণ করেছে। পরিণত করেছে উন্নত শিল্পে। প্রতিদিন বিজেপির নানাবিধ প্ল্যান নির্মাতাদের প্রধান কাজ হয়, আজ অথবা ইদানীং কোন প্রচারটি বেশি করে করব। আজকের নাগরিক সমাজ গভীরভাবে তলিয়ে কোনও ঘটনা অথবা পরিণতি কিংবা কার্যকারণকে বিশ্লেষণ করে না। তারা  ইনস্ট্যান্ট ডেমোক্রেসি এবং ইনস্ট্যান্ট ইস্যুর ভক্ত।
বিজেপি দুটি বিষয়কে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে সর্বদাই উন্মুখ। প্রথমত জোরদার বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, এখন আমরা সবাই খুব ভালো আছি। দেশবাসী প্রচণ্ড উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি উন্নত। চাকরি-বাকরি প্রচুর পাওয়া যাচ্ছে। ব্যবসার জন্য এটাই আদর্শ সময়। আন্তর্জাতিক মহল ভারতকে খুব সমীহ করে। চীন ভারতকে ভয় পায়। আর দ্বিতীয়ত, দেশের ভবিষ্যৎ আরও ভালো। এই হবে, সেই হবে, ভারত এক নম্বর হবে। ভারত মহাশক্তিধর হবে। সকলের জন্য জল হবে। সকলের মাথায় ছাদ থাকবে। ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সবথেকে বড় যে প্রচার সেটি হল, যে কোনও ক্ষুদ্র সাফল্যকে বিজেপি অশ্বমেধের ঘোড়ার বিশ্বজয় হিসেবে প্রচার করতে পারে সুনিপুণভাবে। বিরোধী দলগুলি এই প্রচারকে সঠিকভাবে পাল্টা প্রচার দিয়ে বিদ্ধ করতে পারছে না। বিজেপি এমন একটি ধারণা জনমনে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করে এবং সফলও হয় যে, কংগ্রেস দলটা আজ বাদে কাল উঠেই যাবে। কংগ্রেস গোটা দেশ থেকে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। কংগ্রেস এই প্রচারের পাল্টা কোনও যুক্তি কিংবা প্রোপাগান্ডা করতে পারছে না। অথচ বিজেপির প্রচারের প্রবল শব্দে ঢাকা পড়ে যায় যে, হিমাচল প্রদেশে বিজেপি সরকারের পতন ঘটেছে। কংগ্রেস সরকার গঠন করেছে। বিজেপি এককভাবে জয়ী হয়েছে কোনওমতে ত্রিপুরায়। কিন্তু প্রচারের মহিমায় গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, বিজেপি গোটা উত্তর পূর্ব ভারতই দখল করে নিয়েছে। এখন উত্তর পূর্ব ভারত বিজেপিময়। আর কংগ্রেস ও বিরোধীরা ধূলিসাৎ। 
কংগ্রেস অথবা বিরোধীরা কখনওই সেই একই বিক্রমে এই প্রচার তীব্র স্তরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় না যে, আদতে ভারতের মানচিত্রে বিজেপির অবস্থান ক্রমেই কমছে। উত্তর ভারতে খোদ রাজধানী দিল্লিতেই বিজেপি পরাস্ত হয় বারংবার। এমনকী অতি সম্প্রতি দিল্লি পুরসভা থেকে পর্যন্ত বিজেপিকে বিদায় করে দিয়েছে দিল্লিবাসী। উত্তরাখণ্ড, হরিয়ানা আর উত্তরপ্রদেশে বিজেপি সরকার। হিমাচল প্রদেশে কংগ্রেস। দিল্লিতে আম আদমি পার্টি। রাজস্থানে কংগ্রেস। গুজরাতে বিজেপি। মহারাষ্ট্রে হাফ বিজেপি। কারণ ভোটে বিজেপি পরাস্ত হয়েছিল। এখন শিবসেনা ভেঙে সরকারে রয়েছে। একই ফর্মুলা মধ্যপ্রদেশে। ভোটে পরাস্ত হয়েছে বিজেপি। কংগ্রেস ভেঙে সরকার গড়তে হয়েছে। ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস। কর্ণাটকে ভোটে হেরে যায় বিজেপি। পরে দল ভাঙার মাধ্যমে সরকার গঠন করেছিল। এবার আসন্ন ভোটে কর্ণাটক টালমাটাল বিজেপির কাছে। সমস্ত জনমত সমীক্ষা বলছে বিজেপি পরাস্ত হবে। সরকার গড়বে কংগ্রেস। দক্ষিণ ভারতের আর কোনও রাজ্যে বিজেপি নেই। হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত নেই। গোয়ায় বিজেপি। পূর্ব ভারতের কোনও রাজ্যে বিজেপি নেই। উত্তর পূর্ব ভারতের অসম ও ত্রিপুরায় এককভাবে। বাকি রাজ্যগুলিতে স্থানীয় দলের সঙ্গে জোট করে সরকারে। 
সুতরাং ভোটের ময়দানে বিজেপি অপ্রতিরোধ্য তো নয়ই, বরং যে কোনও সময় যে কোনও রাজ্যে হেরে যাচ্ছে। কিন্তু পরিসংখ্যান ধরে ধরে সেই প্রচারটি বারংবার, লাগাতার বিরোধীরা করে যেতে পারছে না। বেকারত্ব এবং মূল্যবৃদ্ধিকে এক ও একমাত্র অস্ত্র করে পাখির চোখের মতো তুঙ্গে নিয়ে যাওয়ার যে প্রচার সেরকম কোনও প্রয়াস আমরা দেখতে পা‌ই না। প্রতিটি দেশবাসীর কাছে কিন্তু এই দুই সঙ্কট ঘরে ঢুকে বসে আছে। কিন্তু একটির পর একটি নতুন ইস্যু আসছে, বিরোধীরা দিগভ্রান্ত, তাই এই ঘরে ঘরে যে ইস্যুটি সমর্থন পেতে পারে, সেই এজেন্ডা থেকে সরে যাচ্ছে। লক্ষণীয়, হিমাচল প্রদেশে কংগ্রেস সরাসরি বলেছে আমরা ক্ষমতায় এলে পুরনো পেনশন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনব। অন্য সব ইস্যুকে ছাপিয়ে এই একটি প্রচারেই বিজেপি ব্যাকফুটে চলে গিয়েছে। ঠিক সেরকম কোনও ইস্যু এখনও পর্যন্ত একমাত্র অস্ত্র হিসেবে বিরোধীরা চিহ্নিত করতে পারছে না, যা নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে তুফান তোলা সম্ভব। 
অন্যদিকে, বিরোধীদের কাছে সবথেকে বড় ধাক্কা হল, মোদি সরকার যে আর্থিকভাবে ভারতকে সফল ও শক্তিশালী করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেটা বিজেপিও বুঝতে পেরেছে। তাই সব ইস্যু ছাপিয়ে হিন্দুত্বকেই একমাত্র চালিকাশক্তি হিসেবে লোকসভা ভোটে ব্যবহার করবে সেটা ক্রমেই স্পষ্ট। যে ইস্যুকে সর্বাত্মকভাবে প্রতিরোধ করার মতো পরিস্থিতি কোনও রাজনৈতিক দলের কাছেই নেই। কারণ এই ইস্যুকে বিরোধিতা করার অর্থ হল, বিজেপিকে আরও সুযোগ পাইয়ে দেওয়া যে, বিরোধীরা হিন্দুবিরোধী। যা বিজেপির কাছে লাভদায়ক। সেই অভিযোগ যতই বিজেপি বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রচার করতে পারবে, ততই ভোটের ময়দানে পাবে সুফল। 
একমাত্র  মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বকে দেশজুড়ে চরম এক প্রতিবাদ বিক্ষোভে নিয়ে যেতে পারলে এবং বিরোধীরা নির্দিষ্ট কোনও প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষকে বিশ্বাস করাতে পারলেই বিজেপি অনেকটাই সমস্যায় পড়বে। রাজ্যের ইস্যুর পাশাপাশি এমনভাবে কেন্দ্রীয় স্তরের ইস্যুকে টার্গেট করা দরকার যেগুলি সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা ও সমস্যার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু বিজেপির পক্ষে সুবিধাজনক হল, বিরোধীরা স্থির হয়ে একটি বা দুটি ইস্যুতে নিজেদের সম্মিলিতভাবে আবদ্ধ রেখে মানুষের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করছে না। কী কী ইস্যুতে বিরোধীরা মোদি সরকারকে চেপে ধরছে? আদানিকে কেন বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে, ইডি সিবিআই কেন বিরোধীদের বেছে বেছে টার্গেট করছে, এলআইসির টাকা কেন শেয়ারমার্কেটে ডুবে গেল, বাক স্বাধীনতা কেন হরণ করা হচ্ছে, গণতন্ত্র কেন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নেই, মূল্যবৃদ্ধি, পেট্রল ডিজেলের দাম ইত্যাদি। 
এই এতগুলি ইস্যুর সঙ্গে সাধারণ মানুষ কখনও একাত্মবোধ করতে পারে? শুধু এমন ইস্যুকেই তীব্রভাবে বাছাই করা উচিত নয় যা সরাসরি মানুষের মনের কথা? ভারতে জোট রাজনীতির বড়সড় সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর সেই ছিল প্রথমবার কংগ্রেসের নেহরুহীন অবস্থায় ভোটের ময়দানে নামা। সেবার রাজ্যে রাজ্যে রামমনোহর লোহিয়ার উদ্যোগে মূলত জোট হয়েছিল। জোটের নাম ছিল সংযুক্ত বিধায়ক দল। সমাজবাদী ও হিন্দুত্ববাদী, দু’পক্ষই ছিল। একের পর এক রাজ্যে কংগ্রেস পরাস্ত হয়।
১৯৭৭ সালে ছিল জনতা দল নামক জোট। সেখানেও লোকসভা ও বিধানসভা দুই নির্বাচনেও পর্যুদস্ত হতে হয় কংগ্রেসকে। ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে একটিমাত্র ইস্যুতে জোট হয়। বোফর্স। তিনি পরাস্ত হন। ১৯৯৯ সালের ভোটে অটলবিহারী বাজপেয়ির নেতৃত্বের জোট পরাস্ত করে কংগ্রেসকে। ২০০৪ সালে সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে ইউপিএ জোট গঠিত হয় লোকসভা ভোটের পর। 
২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আর মাত্র এক বছর বাকি। জোট হবে কি না সেটা এখনও নিশ্চিত নয়। আবার এখন ভারতের রাজনৈতিক সমীকরণও অনেক বদলে গিয়েছে। এখন কংগ্রেস এককভাবে জোটকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো শক্তিধর জায়গায় নেই। কারণ বহু রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলিই আদতে বিজেপির সঙ্গে টক্কর দেবে। যেমন তৃণমূল, ডিএমকে, সমাজবাদী পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, এনসিপি শিবসেনা, আম আদমি পার্টি, ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতি, বিজু জনতা দল, ওয়াইএসআর কংগ্রেস অথবা সিপিএম। সরাসরি কংগ্রেসের একক শক্তি সীমিত রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, ছত্তিশগড়, হিমাচল, উত্তরাখণ্ড, গুজরাত ইত্যাদি রাজ্যে। তাও আবার কয়েকটি রাজ্যে সেই শক্তিও কমছে ক্রমেই। তাই ভোটের আগে জোট? নাকি জোট করে ভোট? এই ফর্মুলায় পৌঁছতে হবে বিরোধীদের। সর্বোপরি বিজেপি বিরোধী ইস্যু কী হবে?

17th     March,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ