বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

এখন বিজেপি ও দ্বিচারিতা শব্দের অর্থ একই
সন্দীপন বিশ্বাস

এ যেন এক অবিশ্বাস্য ঘটনা! মনে হয়, এ আবার হয় নাকি! কিন্তু সেটা যে সম্ভব, তা করে দেখিয়েছে নেদারল্যান্ডস। গত কয়েক বছরে ধীরে ধীরে সেখানে জেল উঠে গিয়েছে। ২০১৮ সালে পুরোপুরি জেল উঠে যায়। বিশাল বিশাল জেলগুলি এখন নানা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। কোনওটি হয়েছে ব্যবসা কেন্দ্র, কোনওটাকে করা হয়েছে শরণার্থীদের মাথা গোঁজার জায়গা। এখন কেউ অপরাধ করলে শাস্তি হিসাবে তাদের আর জেলে না পাঠিয়ে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। গৃহবন্দি থাকাকালীন তাদের পায়ে একটা যান্ত্রিক বেড়ি পরিয়ে রাখা হয়। সেটা একটা ইলেট্রনিক ট্যাগিং। কতটুকু এলাকার মধ্যে সে যাতায়াত করতে পারবে, তার বৈদ্যুতিন ছাড়পত্র সেটা। তার বাইরে বেরলেই সরকারের মনিটরিং সিস্টেমে তা ধরা পড়ে যায় এবং সে তৎক্ষণাৎ ধরা পড়ে। অন্য দাগী অপরাধীদেরও এভাবে বৈদ্যুতিন বেড়ি পরিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারা সেভাবেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। 
একটা হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সমগ্র ইউরোপেই ধীরে ধীরে ক্রাইম রেট কমছে। আমাদের দেশেও অপরাধের সংখ্যা কমেছিল। ২০২১ সালের রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, ২০২০ সালে আমাদের দেশে ক্রাইমের সংখ্যা কিছুটা কমেছিল। এর কারণ করোনার লকডাউনের ‘বন্দিদশা’। কিন্তু সেই করোনাকাল আমাদের ঠেলে দিল আরও বড় দুর্দশার দিকে, অভাবের দিকে, অন্নহীনতার দিকে। লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মচ্যুত হলেন, রোজগার হারালেন। দেশের অকর্মণ্য সরকারের নির্বুদ্ধিতায় মানুষের দিশাহারা অবস্থা হল। একদিকে মানুষের যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, তখন দেশের মোদি সরকার বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে ডাবল ইঞ্জিন বানানোর ‘ভ্রষ্ট’ খেলায় মেতে উঠল। তারা হিন্দুত্বের নাম বিলিয়ে সমাজে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করে ভোটে জেতার দামামা বাজিয়ে চলল। আর রাষ্ট্রের সেই ব্যর্থতার জেরে বেড়ে গেল দেশের ক্রাইম। কী নিষ্ঠুর পরিহাস! অন্য দেশ যখন কারাগার তুলে দিয়ে দেশকে অপরাধমুক্ত করায় প্রয়াসী হচ্ছে, আমরা তখন আরও জেলখানা বানাতে উঠে পড়ে লেগেছি। বছর তিনেক আগের এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সারা দেশে আরও ১৯৯টি জেল বানাতে কেন্দ্র খরচ করবে ১৮০০ কোটি টাকা। পাঁচশো টাকা চুরি করা অপরাধী সাজা পায়, অথচ দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে বিদেশ পালানো অপরাধীদের টিকিও ছুঁতে পারে না সরকার। উল্টে সরকারি সহায়তায় তাঁদের বিদেশ পালানো নিয়ে অভিযোগ ওঠে। এ পর্যন্ত দেশের ৩০-৩২ জন ‘শিল্পপতি’ তকমাধারী ব্যক্তি দেশের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা প্রতারণা করে বিদেশে পালিয়ে সুখের জীবন ভোগ করছেন। তাঁদের ব্যাপারে মোদি সরকার কিস্‌সু করতে পারেনি। মাঝে মাঝে আমরা তাঁদের ধরে আনার ব্যাপারে কিছু ফাঁপা বুলি শুনি। অচিরে প্রমাণিত হয়, মোদির অন্য প্রতিশ্রুতির মতো এটিও একটি গালগল্প। আর একটি তথ্য বলছে, পলাতকদের মধ্যে অধিকাংশেরও বেশি  গুজরাতের ভূমিপুত্র। এও এক কাকতালীয় ব্যাপার! 
শুধু জেল নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কিছু কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বানানোর চিন্তাও রয়েছে মোদি সরকারের। ২০১৯-এ দেশের সাধারণ নির্বাচনের পর সিএএ যন্ত্রকে মজবুত করার চেষ্টা করেছিল মোদি সরকার। দেশের মানুষের সামগ্রিক চাপের মুখে পিছু হটতে হয়েছে কেন্দ্রকে। লক্ষ্য এখন ২০২৪ সালের নির্বাচন। এই নির্বাচনে জিতে আসতে পারলে ফের সেই সিএএ যন্ত্রে তেল দেওয়া হবে। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পও ভরিয়ে ফেলার ভাবনা রয়েছে বিজেপির অন্দরে। এছাড়াও ভোট যত এগবে, ততই ভক্তদের নব দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করবে বিজেপি। সব ছক প্রকাশ্য নয়। 
গত সপ্তাহে তুরস্কের ভূমিকম্প নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিপর্যয় মোকাবিলায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা দরকার। কিন্তু যোশীমঠ নিয়ে তিনি কোনও উচ্চবাচ্য করলেন না। অপ্রীতিকর ব্যাপার চিরকালই তিনি এড়িয়ে যান। অপ্রীতিকর প্রশ্ন রাজা পছন্দ করেন না। তাই তিনি সাংবাদিক সম্মেলনও করেন না। কোনও সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখিও হন না। 
সকলেরই মনে আছে, এরাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের পর সন্ত্রাস নিয়ে হেরো বিজেপির সে কী চিৎকার! কেন্দ্রের প্রতিনিধিরা পর্যন্ত সন্ত্রাস ধরতে দৌড়ে এলেন। অথচ ত্রিপুরায় কী ঘটছে? সেখানে জেতার পর বিরোধীদের ধুনে দিচ্ছে বিজেপি। অনেকের বাড়ি ভাঙচুর করেছে, আগুন লাগিয়ে দিয়েছে বহু বাড়িতে। বিরোধী নেতা ও কর্মীরা দলে দলে ঘরছাড়া। কয়েকদিন আগে কংগ্রেস ও সিপিএমের এক প্রতিনিধি দল গিয়েছিল সন্ত্রাস কবলিত এলাকা পরিদর্শনে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আটজন সাংসদও। বিজেপির পেটোয়া গুণ্ডারা তাঁদের পথ আটকায়। প্রতিনিধি দল গুণ্ডাদের হাতে আক্রান্ত হয়। 
দেখা গিয়েছে, বারবার প্রধানমন্ত্রী নানা বিষয়ে একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার জেরে বিপাকে পড়তে হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষকে। তাঁর অসংখ্য পদক্ষেপের মধ্যে ‘হামসে বড়কর কৌন’ জাতীয় ভাবনার প্রকাশ মেলে। প্রতিবার সমালোচিত হলেও ভুল স্বীকার তাঁর অভিধানে নেই। বেশ কয়েকবার সুপ্রিম কোর্টও সরকারের কাজের সমালোচনা করেছে। কয়েকদিন আগে ফের মুখ খুলতে হল সুপ্রিম কোর্টকে। শীর্ষ আদালতের নির্দেশে স্পষ্ট হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে কাউকে আর নির্বাচন কমিশনের সদস্য করতে পারবেন না। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সেই মামলায় কার্যত হার হল সরকারের। সেই নিয়োগ কমিটিতে থাকবেন দেশের প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী নেতা। বলা যায়, আগামী বছরের নির্বাচনের আগে আর একটি ধাক্কা খেল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। আগামী বছরের নির্বাচনে জেতার জন্য যে কয়েকটি কৌশল বিজেপি অবলম্বন করেছিল, তার মধ্যে একটি ছিল বশংবদ নির্বাচন কমিশন। এটা তো জলের মতো পরিষ্কার যে, নির্বাচন কমিশনে নিজের লোক থাকলে অনেক সুবিধা হয়।
এরাজ্যে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করছে সিবিআই। বহু শিক্ষক ও স্কুলকর্মীর চাকরি গিয়েছে হাইকোর্টের নির্দেশে। পূর্ব মেদিনীপুর থেকে এমনই ৫৫ জনের নাম আছে তালিকায়। পূর্ব মেদিনীপুরে কার হাতযশে এইসব চাকরি হয়েছে, তাই নিয়ে গত কয়েকদিনে বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু তাঁকে কেন সিবিআই তলব করে জেরা করে না, সেই বিষয়টা মোটেই কোনও রহস্যের ব্যাপার নয়। তাই নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।  
এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে রাজ্যের বিজেপির এক ‘দায়িত্বশীল’ নেতা ইংরেজি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে হইচই বাধিয়ে দিলেন। অথচ বিজেপি শাসিত অসমে দশম শ্রেণির জেনারেল সায়েন্সের পরীক্ষায় সত্যিই প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গেল। অসমের বোর্ড সেই কথা স্বীকার করে নিয়ে পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা করল। বিজেপি চুপ। মেঘালয় ভোটের আগে ভাষণে মোদি ও অমিত শাহ বলেছিলেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে সেরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমাকে দুর্নীতির অভিযোগে জেলে ভরবেন। কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁদের কথা গিলে ফেলতে হল। সেই কনরাডের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মেঘালয়ে সরকার গড়তে আর কোনও অসুবিধা হল না বিজেপির। ইতিহাসের নির্মম জবাব এভাবেই ফিরে ফিরে আসে আর দ্বিচারিতার পর্দা ফাঁস করে দেয়। 
বিজেপির বিরুদ্ধে দ্বিচারিতার এমন তালিকা বানালে হাজার পাতার চার্জশিট হয়ে যেতে পারে। বিজেপি নিজেদের ঘরে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত একগাদা নেতাকে নিয়েও অন্যের দুর্নীতি খুঁজে চলেছে। আসলে নিজস্ব এজেন্সিকে ব্যবহার করার সুযোগ নিয়ে চেষ্টা চলছে বিরোধী শিবিরকে চূর্ণ করে দেওয়ার। চেষ্টা চলছে বিরোধী নেতাদের বশ মানানোর জন্য ভয় দেখানোর খেলা। অরণ্যের একটা প্রবাদ হল, বাঘের আগে ফেউ যায়। এখন প্রমাণ হচ্ছে ভোটের আগে বিরোধীদের বাড়ি বাড়ি সিবিআই, ইডি, ইনকাম ট্যাক্সও যায়। বিজেপি বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমার নিরাপদ ছত্রছায়ায় এলে তুমি গঙ্গার মতো পবিত্র হয়ে যাবে। কোনও তদন্তই আর তোমাকে ছুঁতে পারবে না। শুধু তাই নয়, তিনি মুখ্যমন্ত্রীও হয়ে যেতে পারেন। সারদা এবং ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ছিলেন যথাক্রমে অসমের হিমন্ত বিশ্বশর্মা এবং মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিং চৌহান। তাঁরা এখন দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। 
দিন কয়েক আগেই রিপোর্টে প্রকাশ, বিজেপির তহবিলে হাজার হাজার কোটি টাকা আছে, যার আয়ের উৎস নেই। এর উৎস জানতে কেন তদন্ত হবে না? গোপনে যাঁরা টাকা দিয়েছেন, পরিবর্তে তারা কী কী সুবিধা পেয়েছে, অবিলম্বে সেটা ইডির জানার চেষ্টা করা দরকার। সেই ‘আননোন সোর্স’-এর টাকা নির্বাচন কমিশনের বাতিল করা উচিত। বারবার এভাবেই দ্বিচারিতার পথেই হেঁটেছে বিজেপি। আর নিজে চালুনি হয়েও সবসময় ছুঁচের পিছনে ছিদ্র খুঁজতে তৎপর হয়েছে। 

15th     March,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ