বিশেষ নিবন্ধ

বিরোধীদের ছত্রভঙ্গ করার গেরুয়া ব্লুপ্রিন্ট
হিমাংশু সিংহ

এবারের বসন্তটা একেবারে আলাদা। ফাল্গুনে প্রকৃতির ফুল, রং, বাহার সবকিছুকেই ছাপিয়ে গিয়েছে বিরোধীদের কোণঠাসা করার মোটা দাগের গেরুয়া কৌশল। বেআব্রু নরেন্দ্র মোদির তৃতীয়বার কেন্দ্রের গদি দখলের ব্লুপ্রিন্ট। ভোটের আগে এজেন্সি লাগাও, আর ফল বেরলে টাকার থলি নিয়ে এমপি-এমএলএ ভাঙাও। আপাতত ক্ষমতা দখলের এটাই নিরাপদ ফর্মুলা দীনদয়াল উপাধ্যায়ের শিষ্যদের। সামনাসামনি লড়াই যত কঠিন হচ্ছে, বিজেপি যত বন্ধু শরিক হারাচ্ছে, ততই নানা অজুহাতে এজেন্সি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিরোধী নেতানেত্রীদের উপর। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধের রাজনৈতিক উপকারিতা কম নয়। মোদি রাজত্বে ভোটের দামামা টের পাওয়ার আগেই পৌঁছে যায় কেন্দ্রীয় এজেন্সি। এটাই দস্তুর। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, সর্বত্র। শ্যেনদৃষ্টি বাংলা, বিহার, ওড়িশায় আসন বাড়ানোর দিকে। দু’দিন আগেই পালিত হল দোল উৎসব। কিন্তু এবার বাংলার দোলযাত্রা পর্যবসিত হয়েছিল বীরভূমের বাঘের দিল্লি যাত্রায়। রং-আবির সব ওই ইভেন্টের কাছে নিতান্তই ফিকে লাগছিল বসন্ত পূর্ণিমার সকাল থেকে সন্ধ্যায়। ভোর থেকেই ফাগ, গুলাল, পিচকারি ছাপিয়ে বঙ্গের মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল কলির কেষ্টর রাজধানী যাত্রার উচ্চকিত ধারাবিবরণীতে!
দুর্নীতি থাকলে এজেন্সি নামবে, তাতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু গত এক দশক ভোটের ঠিক আগে একই ঘটনার রিপ্লে দেখতে দেখতে মানুষ বড্ড ক্লান্ত। দল ভাঙা আর বিরোধীদের গারদে পোরার ফাটা রেকর্ড বেজেই চলেছে অবিরাম। ত্রিপুরায় তিপ্রা মথা এখনও লাইনে না এলেও এই ফাগুনে নাগাল্যান্ডের একমাত্র জেডিইউ বিধায়ক গেরুয়ায় নিজেকে রাঙিয়ে নিয়েছেন ফল বেরতেই। গেরুয়া রাজত্বে একজন বিরোধী নেতা ক’বার গ্রেপ্তার হন? এ কোনও চাকরির পরীক্ষার অবজেক্টিভ টা‌ইপ কোয়েশ্চেন নয়, একেবারে সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্নটা এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছে। কারণ একবার নয়, হেফাজতে থাকাকালীনও আরও অন্তত দু’থেকে তিনবার অন্য তদন্তকারী সংস্থা হাতকড়া পরাচ্ছে ভোটে বেগ দিতে পারে এমন বিরোধী নেতানেত্রীকে। একটার পর একটা মামলায় জড়িয়ে আগামী একবছর জেলযাপন নিশ্চিত করতে পারলেই জোটের দফারফা। হালের চকমকি অ্যাওয়ার্ড ফাংশনের ঘোষক-ঘোষিকার মতো আগামী বছর মে মাসের দাবদাহ ভরা ঘর্মাক্ত দুপুরে নির্বাচন কমিশনও ইনিয়ে বিনিয়ে জানাবে, ‘ফর দ্য থার্ড টাইম ইন এ রো কুর্সি গোজ টু নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি!’ ব্যস কেল্লা ফতে। অমৃতকালের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিতে মজে যাবে দেশের মানুষ। গ্যাসের দাম, বেরোজগারি, মন্দা সব ভেসে যাবে সেই ভক্তি রসের জোয়ারে। এর নামই ভারতবর্ষ!
বলা বাহুল্য, আগামী কয়েকমাস ভোট বসন্ত যত এগিয়ে আসবে ততই তালিকাটা দীর্ঘ হবে। আচমকাই এজেন্সির কর্তারা সাতসকালে বিরোধীদের দরজায় হাজির হয়ে গান ধরছেন ‘খোল দ্বার খোল’! দরজা খুলতেই তল্লাশি। আটঘণ্টা টানা অভিযানের পর শেষে গ্রেপ্তার। এই হল কেন্দ্রীয় এজেন্সির নিখাদ বাহাদুরির ট্রেডমার্ক। দিল্লিতে আপকে কোণঠাসা করতে মণীশ সিশোদিয়া গ্রেপ্তার হলেন দু’বার। প্রথমে সিবিআইয়ের জালে, তারপর ইডির হাতে। বৃহস্পতিবার অপরাহ্নে দ্বিতীয়বার তাঁকে গ্রেপ্তার করে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা আশু জামিন পাওয়ার পথে কার্যত চোনা ছিটিয়ে দিল। তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী ইদানীং বিরোধী জোট নিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করছিলেন। রাজ্যের ভিতরে তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো ক্ষমতা নেই বিজেপির। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুলটা বাঁকাও...। সবক শেখাতে মুখ্যমন্ত্রী কন্যা কবিতাকে তাই গারদে পুরতে সক্রিয় ইডি, সিবিআই সবাই। বারবার ডাকা হচ্ছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রথমে ধরে সিবিআই। তারপর আসে ইডি। একদম শেষে আয়কর। আবার উল্টোটাও দস্তুর। অকেজো কিডনি বদলে বিহারের রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য ব্যক্তিত্ব লালু এখন দ্রুত সুস্থ হওয়ার পথে। নীতীশের সঙ্গে তাঁর ফের জোট হলে বিপদ নিশ্চিত। লালুপুত্র তেজস্বী যাদব এবং স্ত্রী রাবড়িদেবীও তাই এজেন্সির রাডারে। রাবড়ির পর তেজস্বীর বাড়িতেও তল্লাশি চলছে। সংযুক্ত জনতা দলের একমাত্র বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় নাগাল্যান্ডে নীতীশের দলের বিস্তার বিশবাঁও জলে। জোট ভুলে বিহার নিয়েই তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হবে। ঝাড়খণ্ডে শিবু সোরেনের ছেলে হেমন্ত, কেরলে মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন ঘনিষ্ঠ রবীন্দ্রনকেও ইতিমধ্যেই একাধিকবার জেরা করা হয়েছে। নিজের দলের ভিতরেই নানা অভিযোগে বিদ্ধ কেরলের সিপিএম দলের মুখ্যমন্ত্রী। ক্ষমতার খুড়োর কল ঝুলিয়ে মহারাষ্ট্রে শিবসেনা দলটাকেই আড়াআড়ি ভেঙে দিয়েছেন অমিত শাহরা। প্রতীক নিয়ে মামলায় কমিশনে হেরে গিয়েছেন বালাসাহেব পুত্র উদ্ধব। পরিস্থিতি এমন যে ভোটের আগে শিবসেনার একটা অংশ বিজেপিতে যোগ দিতেও পারে। এজেন্সি নোটিস ধরিয়েছে দেশের প্রবীণতম বিরোধী নেতা শারদ পাওয়ারকেও। পাশাপাশি অদ্ভুত সেমসাইড গোল দেখছে তামিলনাড়ু। বিজেপির অপারেশন লোটাসের ধাক্কায় হিমশিম খাচ্ছে একমাত্র ‘বেঁচে থাকা’ শরিক প্রয়াত জয়ললিতার এআইডিএমকে। ইন্দিরা গান্ধী নাকি প্রায় ৮০ বার ৩৫৬ প্রয়োগ করে রাজ্যে রাজ্যে সরকার ভেঙেছিলেন। মিসায় বিরোধীদের গ্রেপ্তার করেছিলেন। গণতন্ত্রকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিলেন। সব সত্যি। কিন্তু এজেন্সি লাগিয়ে বিরোধীদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন এমন নজির নেই। সম্ভবত এই নয়া কৌশলের মধ্যে দিয়ে আগের সব দৃষ্টান্তকেই ম্লান করার পথে হাঁটছে নরেন্দ্র মোদির ইডি, সিবিআই ও আইটি উইং! ধরপাকড়, উইচহান্টিংয়ের আড়াল থেকে বিরোধীদের কোমর ভেঙে দেওয়ার একেবারে মোক্ষম স্ট্র্যাটেজি!
এর বিপরীত ছবিটাও একইরকম উদ্বেগজনক। কর্ণাটকে বিজেপি বিধায়কের বাড়ি থেকে ৬ থেকে ৮ কোটি টাকা পাওয়া গেল। বিধায়কের ছেলেও সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৪০ লক্ষ টাকা ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়লেন। কিন্তু বিধায়ক এখনও বহাল তবিয়তে। তাঁকে গ্রেপ্তার করে কার সাধ্য। ব্যাপম নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকারের কোনও কেষ্টবিষ্টুর জেলযাত্রার কথাও কেউ শোনেনি। আসলে উন্নয়ন নয়, মোদিজির প্রকাণ্ড ব্যক্তিত্বও নয়, আকর্ষণের আসল কারণ বিজেপিতে নাম লেখালেই সাতখুন মাফ! এটাই তবে আধুনিক ডাবল ইঞ্জিনের আসল কামাল? 
মোদি সরকার আজ থেকে ন’বছর আগে যখন ক্ষমতায় আসে, তখন প্রথমটায় সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে কম শোরগোল হয়নি। হিমন্ত বিশ্বশর্মা তখন কংগ্রেসে। দাবাং নেতা। তাঁকে নিয়ে বিস্তর টানাপোড়েন চলছিল। বিপদ বুঝে হিমন্ত লাফ মারলেন বিজেপিতে (২০১৬-’১৭)। নিমেষে কলঙ্ক ধুয়ে গেল। আজ উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপির সাংগঠনিক প্রসারের প্রধান মুখ হিমন্ত। সফল সংগঠক। সারদা মামলা নিয়ে প্রথমটায় বিরাট ঝড় উঠলেও সবটাই এখন চলে গিয়েছে ঠান্ডা ঘরে। প্রায় এক দশক কেটে গেলেও বিচারই শুরু হয়নি। অধিকাংশই গ্রেপ্তার হয়ে আবার ছাড়াও পেয়ে গিয়েছেন। এখনও বাকি যাঁরা জেলে আছেন, তাঁরাও নিরাপত্তার খাতিরে ভিতরে থাকাটাই পছন্দ করছেন। এ বড় অদ্ভুত রসায়ন, যা বোঝা ভগবানেরও অসাধ্য! এসব দেখতে দেখতে বিচারের বাণীর নীরব কান্নায় গলা শুকিয়ে কাঠ, সুবিচার নিভৃতে গুমরে মরে অন্ধকারে!
নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের হিসেব খুব স্পষ্ট। পরিস্থিতি যা তাতে কংগ্রেসের দাদাগিরি মেনে আপ, তৃণমূল, কেসিআর, জগন, শারদ পাওয়ার, নীতীশ—কারও পক্ষেই সার্বিক জোট করা সম্ভব নয়। কংগ্রেসের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুচর এই মুহূর্তে শুধু বামেরা আর লালুপ্রসাদ ও তাঁর পরিবার। নীতীশকুমার তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারে বারবার রং বদলেছেন। মোস্ট আনপ্রেডিক্টেবল প্লেয়ার। কে যেন বলেছিল, গিরগিটিরা রাজনীতিতে সবচেয়ে নিরাপদ জীব! আজও তা সমান সত্য। তাই তিনি শেষ পর্যন্ত কী করবেন, তা এখনও রহস্যাবৃত। সিপিএম জাত ধর্ম বিবেক যতই বিসর্জন দিক, কেরলে কংগ্রেসের সঙ্গে সন্ধি করলে ক্ষীয়মাণ লালপার্টির একমাত্র প্রদীপটাও অচিরেই নিভে যাবে। তাই জোটের কথা কেউ মুখেও আনছে না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সেই অনৈক্যের সুযোগে হাজারো সঙ্কট সমস্যা সত্ত্বেও একমাত্র জাতীয় দল হিসেবে কিস্তিমাত করার কৌশল নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে প্রচার শুরু করে দিয়েছে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার। নিশ্চিতভাবে উগ্র হিন্দুত্বের তাস খেলতেও তারা পিছপা নয়। বছরের শেষ থেকে অযোধ্যা, বারাণসী, মথুরা থেকে সোমনাথ মোদিজির মন্দির রাজনীতির আগ্রাসী চেহারা দেখতে পাওয়া যাবে। প্রথম দফার ৫৬টি জনসভায় যার আঁচ পাবে জনগণ।
এবারের মতো ফাল্গুনের যাওয়ার পালা। পরের বছর বসন্ত সমাগমে যখন পলাশ শিমুল বকুল পারিজাতরা ফুটবে তখন ফুল আর রঙের বন্যায় নয়, দেশের রাজনীতি আগুন হবে ভোটের উত্তাপে। অষ্টাদশ সাধারণ নির্বাচন। রাজনীতির দাপাদাপির আতিশয্যে প্রকৃতির রং উপভোগের ফুরসত বড় একটা থাকবে না। তবে দ্বিধাবিভক্ত বিরোধীরা ২০১৪ ও ২০১৯ সালের মতো এবারও আত্মসমর্পণ করলে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো কিন্তু বিপন্ন হতে বাধ্য। সেদিন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে নির্বাচন কমিশন সবই চলে যাবে ষোলোআনা সরকারি নিয়ন্ত্রণে। কলেজিয়াম ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখাবে নির্বাচিত সরকার। গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রাখতে অবিলম্বে বিরোধীদের রুখে দাঁড়াতে হবে। নাহলে গণতন্ত্রের সংবিধানের অপূরণীয় ক্ষতি অপেক্ষা করছে। কারও নিস্তার নেই। সাগরদিঘিতে তৃণমূলকে হারিয়ে যারা উদ্বাহু, তাঁরাও বাঁচবেন না সাম্প্রদায়িকতার উগ্র আস্ফালন থেকে। তখন কী পরিণতি হবে বাম-কংগ্রেস মডেলের?
16Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা