বিশেষ নিবন্ধ

আজও আক্রোশের
অভিমুখ সেই বাংলা...
হিমাংশু সিংহ

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ২৩ জানুয়ারি এলেই মনটা কেমন আনচান করে ওঠে। একটা আশ্চর্য শ্রদ্ধা মাখা সম্ভ্রমে মাথাটা আপনি হেঁট হয়ে যায়। আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়েই যিনি অন্তর্ধানে হারিয়ে গিয়েছেন। তাঁর লক্ষ্যপূরণ হলেও আসব আসব করে আর অসেননি এই বাংলায়। ৭৭ বছর পার করেও সুভাষ ঘরে ফেরেননি। দেখতে আসেননি তাঁর প্রাণ বাজি রেখে অর্জন করা স্বাধীন ভারতের আলপথ, পুকুর, নদী, গাছপালা, মানুষ কেমন আছে! সত্যিকারের স্বাধীনতার মানে ও দ্যুতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে কি না। নাকি কখনও একটা পরিবারের আড়ালে আবার কখনও নিষ্ঠুর ধর্মের ব্যবসার ফাঁদে হারিয়ে গিয়েছে আসল উদ্দেশ্যটাই! নিঃসন্দেহে তাঁর এই না ফেরায় হাসি চওড়া হয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে লুটেপুটে খাওয়া নেতানেত্রীদের। ভোটে জনগণের মন জিতে আখের গোছানোয় আর বাধা হয়নি কেউ। অনেকেই কামাতে ব্যস্ত। শৃঙ্খলা আর চরিত্র শুদ্ধির কথা তিনি ছাড়া বলবে কে? ফল, ৭৫ বছরের স্বাধীনতার পরিক্রমায় পরিবারবাদ থেকে ধর্মীয় বিভাজনের আবর্তে বন্দি হয়েছে দেশ। ভাঙা সেই রেকর্ড চলতে চলতে নৈতিকতার মাথা খেয়ে খেলাটা আজ ক্রমেই জটিল। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছেয়ে যাচ্ছে দুর্নীতি। ভোট পাটিগণিতকে যেকোনও মূল্যে নিয়ন্ত্রণ করাই কি স্বাধীনতার আসল মানে? এই স্বাধীনতারই কি স্বপ্ন দেখেছিলেন সুভাষ, চিত্তরঞ্জন, বিনয়, বাদল, দীনেশ ও বাঘাযতীনের মতো বাংলার একদল দামাল ছেলে? দেশের জন্য জীবন দিয়ে তাঁরা সত্যি কী পেলেন? নাকি বাংলার বঞ্চনার ভারই শুধু বাড়ল!
স্বাধীনতার ৭৫ বছর এবং একইসঙ্গে বাংলার বীর সন্তান নেতাজি সুভাষের অর্ন্তধানেরও ৭৭ বছর। এই সমাপতনের সময়টা নিঃসন্দেহে ভারতের ইতিহাসে ক্রান্তিকাল। সরকার একে অমৃতকাল আখ্যা দিলেও দেশবাসীর প্রকৃত অমৃতলাভ দূরঅস্ত। এই সাড়ে সাত দশকের অভিযাত্রায় শাসক আর শাসিতের দূরত্বই শুধু বাড়েনি। সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, আজ প্রতি মুহূর্তে দেশে ধনী-গরিবের ফারাক চওড়া হচ্ছে বিপজ্জনকভাবে। দেশের ৪০ শতাংশ সম্পদ আজ মাত্র ১ শতাংশ মানুষের হাতে। শুধু ভোটে জেতা নেতা নয়, নব্য পুঁজিপতি সমাজও সব দখলের নেশায় মত্ত। এই একটা মাত্র সরল পরিসংখ্যান প্রমাণ করে স্বাধীন দেশে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দারিদ্র্যের ছোবলের চেয়েও বড় সমস্যা—গরিব আরও গরিব হচ্ছে। আর বড়লোক হাওয়াই জাহাজ কিনে রাতারাতি আরও আমির বনে যাচ্ছে! তাঁর প্রাসাদের প্রধান ফটকের পাশেই নিরন্ন মানুষের ভিড়। সমাজে যখন এই বৈষম্য তৈরি হয়, তখন তার অনিবার্য পরিণতি শোষণ এবং স্বেচ্ছাচার। ৭৫ বছরের এই অভিযাত্রায় দুর্নীতির পাশাপাশি অন্ধকারে ভরা ওই দিকটাও সমান উদ্বেগজনক।
আর পূর্বভারতের এককোণে পড়ে থাকা অবহেলিত বাংলা। শতসহস্র বীর স্বাধীনতা সংগ্রামীর উত্থান এই পবিত্র বীরভূমি থেকে। অথচ ইতিহাসের পরতে পরতে বাংলা ও বাঙালিকে টেনে নামানোর ষড়যন্ত্রটা এক মুহূর্তের জন্য থামেনি। বরং যত দিন যাচ্ছে, ততই সেই চক্রান্ত আরও গভীর হচ্ছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে সবার আগে থেকেও এই ৭৫ বছরের ইতিহাসে বাঙালি যে শুধু একটা প্রধানমন্ত্রী পায়নি তা নয়, পদে পদে তার অগ্রগতিকে রুদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে। চক্রান্ত হয়েছে। ভাতে মারার চেষ্টা হয়েছে, এবং তা এখনও চলছে। দেশভাগের বিষ ছড়িয়ে দেওয়া থেকে হালে একশো দিনের কাজের বরাদ্দ বন্ধ করার মধ্যে দিয়েই তা বারে বারে প্রমাণিত। দেশভাগের শিকার পাঞ্জাবও। কিন্তু তার উন্নয়ন একবারের জন্য থমকে যায়নি। গুজরাত, মহারাষ্ট্রও এগিয়েছে জেট গতিতে। অথচ মাশুল সমীকরণ নীতির কোপে এবং দিল্লির কর্তাদের একচোখামোয় বাংলায় বরাদ্দ আসেনি। দিল্লির শাসকরা উদার দৃষ্টিতে চোখ মেলে দেখেননি। তবু বিধানচন্দ্র রায় কিছু একটা করার চেষ্টা করেছিলেন। তারপর থেকে দীর্ঘ ৩৪ বছরের সিপিএম আমলে বাংলা রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কারণে ও উগ্র ইউনিয়নবাজির ধাক্কায় শুধুই বঞ্চিত হয়েছে। পেয়েছে যৎসামান্য। কল-কারখানা, শিল্প বিনিয়োগ থেকে হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ সব ক্ষেত্রেই আজ বাংলার চেয়ে উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের বৃহৎ অংশ অনেক এগিয়ে। নেতাজি সময়মতো ফিরলে শুধু কানাকড়ি নিয়েই বাংলাকে খুশি থাকতে হতো না। একশো দিনের আটকে থাকা কোটি কোটি টাকা থেকে জিএসটির ক্ষতিপূরণ পেতে মমতাকে লড়াই করতে হতো না। বাংলাকে আটকে রাখার হিম্মত হতো না কারও।
নেতাজি ফিরে আসুন, হয়তো নেহরুর মেন্টর গান্ধীজিও চাননি। কারণ, তিনি ফিরে এলে ভারতের ইতিহাস আজ নতুন খাতে বইত। বাঙালির অগ্রগতির খতিয়ান সোনার কলম দিয়ে লিখতে হতো। শুধু একটি পরিবারই অর্ধশতাব্দীরও বেশি দেশের শাসনযন্ত্রকে নিজেদের তাঁবে রাখতে পারত না। ধর্মের নামে ভোট ভাগাভাগির নাটক পর্যন্ত কুৎসিত চেহারায় সামনে আসতে পারত না। নেতাজি ফিরে আসেননি বলেই দেশটা কখনও পরিবারবাদ, আবার কখনও ধর্মোন্মাদদের হাতে বন্দি। এই ৭৫ বছরে কখনও কোনও প্রধানমন্ত্রীকে সংসদে বসেই ঘুমোতে দেখেছি। আবার কেউ দাবি করেছেন, অষ্টপ্রহর তিনি দেশের কথা ভাবেন। ছুটি বলে কিছু তাঁর অভিধানেই নাকি নেই! বিভাজনের বিষ যাঁর হাতে, তাঁর ত্যাগ আত্মস্থ করতে হলে জনগণকেও যে নীলকণ্ঠ হতে হবে।
আজ নরেন্দ্র মোদি যখন তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ নিষ্কণ্টক করার জন্য বলেন, আর ৪০০ দিন বাকি। তখন একটা কথাই মনে হয়, স্বাধীনতা সংগ্রামীরা কিন্তু একটা অনির্দিষ্টকাল লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। তাতে সাফল্য আসবে, গদি মিলবে এমন কোনও লাভ দেখে তাঁরা ঝাঁপাননি। তাঁরা শুধু একটা কথাই জানতেন, দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার চেয়ে পবিত্র কর্তব্য আর কিছু নেই। কাউকে ইতিহাস থেকে মুছে নিজের কীর্তি স্থাপনের জন্য নয়, নেতাজিদের লড়াই ছিল দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনের। আর আজ ভোটের ৪০০ দিন বাকির কথা যখন মোদিজি বলেন, তখন দেশ নয়, অগ্রাধিকার পায় ব্যক্তিগত রেকর্ড। তাতে দেশের ভালোর চেয়েও গুরুত্ব পায় পরাক্রমী ভিতরের ‘আমি’টা। 
তাই ১৯৪৩ সালে বিদেশের মাটিতে নেতাজি যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়ার কথা বলেছিলেন, তখন তাঁর স্লোগান ছিল ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা...।’ সম্বোধন ছিল দেশবাসীকে। আর দেশের অষ্টাদশ সাধারণ নির্বাচনের আগে মোদির স্লোগান সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক। নিজের কেরামতি তুলে ধরার ‘উসসে গুমা হ্যায় কি মেরি উড়ান কুছ কম হ্যায় মুঝে ইয়েকিন হ্যায় কি ইয়ে আসমান কুছ কম হ্যায়...।’ যার বাংলা অর্থ, ‘আরও অনেক কিছু করার বাকি আছে, কিন্তু আমাদের সম্ভাবনা অসীম।’ এখানেই বোঝা যায় পার্থক্যটা। একজন দেশের জন্য উৎসর্গপ্রাণ। দেশমাতৃকার জন্য বলিপ্রদত্ত। অন্যজন ব্যক্তিগত রেকর্ড ও ক্ষমতা জাহির করতে মরিয়া। তার চেয়েও সাংঘাতিক হচ্ছে স্বাধীনতার আন্দোলনে যে সঙ্ঘ পরিবারের ভূমিকা ছিল সন্দেহজনক। আতশকাচের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নিয়ে সেই সঙ্ঘ পরিবারই এখন নতুন করে দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস লিখতে মরিয়া। সঙ্ঘের এই বীরত্ব জাহির করাটা বাঙালি মেনে নিতে প্রস্তুত তো! চারপাশটা দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আর তাই সেদিনের বীরশ্রেষ্ঠ সাভারকার আর নেতাজির স্থান হচ্ছে এক পঙ্‌ক্তিতে। বাঙালিকে তা মেনেও নিতে হচ্ছে মুখ বুজে। কারণ, স্বাধীনতার লড়াইয়ে সবার আগে থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার বাঙালির ভাগ্যে জোটেনি। তাই ইতিহাস বদলের প্রতিটি বাঁকে এই বঙ্গের বীর সন্তানদের ভূমিকার ক্রমশ অবমূল্যায়ন ঘটে গিয়েছে নিঃশব্দে। তবুও কি ইতিহাসকে মুছে ফেলা এত সহজ? ষড়যন্ত্র সেদিনও হয়েছিল, আজও চলছে—বাঙালিকে টেনে নামানোর, ভাতে মারার। তার বিরুদ্ধেই বাংলার আজকের অগ্নিকন্যা লড়ছেন।
অনেক তত্ত্ব খাড়া করেও এখনও তাঁকে ভোলানো যায়নি। বাঙালি প্রধানমন্ত্রী হয়নি, তাতে কী? ১৯৪৭ সালের পর যাঁরা ওই আসনে বসেছেন, তাঁদের ক’জনকে শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় আজ এতদিন পরও মনে রেখেছে দেশের মানুষ? মনে রাখেনি। ক’জনের জন্মদিন এভাবে গোটা দেশে পালিত হয় সসম্মানে? আজকে যিনি সর্বশক্তিমান, তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর যাবতীয় কীর্তি মুছে নিজেকে আরও আগুয়ান দেখতে চান। গান্ধী পরিবারের কৌলীন্য মুছে দিতে চান। অথচ প্রধানমন্ত্রী না-হলেও নেতাজির প্রভাব ও ভূমিকাকে ছোট করে দেখানোর হিম্মত কারও হয় না। কারণ, তিনি আছেন ও থাকবেন প্রতিটি দেশবাসীর রক্তবিন্দুতে। পরপর পাঁচবার কেউ প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার দখল করলেও নেতাজির সমকক্ষ হতে পারবেন না। যতদিন ভারত থাকবে, তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের সমার্থক হিসেবেই সম্মান ও পুজো পাবেন। আরও একশো বছর পরেও, ২৩ জানুয়ারির আগের দিন তা সমান আগ্রহে স্মরণ করতে হবে কোনও কলমচিকে। তাঁকে স্মরণের মধ্যে দিয়ে চক্রান্তকে হারিয়ে বাংলা ও বাঙালির জয়ও ঘোষিত হবে সম্মিলিত গর্জনে।
18Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা