বিশেষ নিবন্ধ

বাঙালিকে বিভাজিত করার চক্রান্ত চলছেই
সমৃদ্ধ দত্ত

১২০ বছর কেটে গেল। বদলে গেল শাসক। অথচ একটিমাত্র জাতির প্রতি শাসকের ক্রোধ একইভাবে রয়ে গেল। এটা বেশ আশ্চর্যের। সকলেই অবগত যে, লর্ড জর্জ নাথানিয়েল কার্জন ১৮৯৮ সালে ভারতের ভাইসরয় হয়ে আসার পর থেকে তাঁর প্রধান কাজই যেন হয়ে দাঁড়ায় বাঙালি নামক জাতিকে শায়েস্তা করা। ভাইসরয়ের সিংহাসনে বসে প্রথমেই ১৮৯৯ সালে তিনি কলকাতা কর্পোরেশন আইনের মাধ্যমে ভারতীয় সদস্যদের প্রবেশাধিকার কমিয়ে দিলেন। অর্থাৎ স্বশাসিত কোনও পরিচালন ব্যবস্থায় যেন ভারতীয়দের সংখ্যা বেশি না হয়। এরপর ১৯০৪ সালে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন এনেছিলেন। যেখানে সরকার তথা শাসকগোষ্ঠীর শিক্ষা ব্যবস্থার উপর অধিকার বাড়ানো যায়। যে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার। যে কোনও নীতির সংশোধন অথবা বদল ঘটাতে পারে। লর্ড কার্জনের মেয়াদ যখন সমাপ্ত হবে, সেই চলে যাওয়ার আগেও তিনি এক বিরাট ধাক্কা দিয়ে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করে গেলেন। এবং সফল হলেন। বঙ্গ ভাগ। 
সকলেই অবগত যে, বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগ এবং রূপায়ণকারী কার্জনই। কিন্তু তারও আগে ১৯০৩ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রসচিব স্যার হার্বার্ট হোপ রিসলে একটি সরকারি নোট তৈরি করেছিলেন। সেই নোটের প্রস্তাব ছিল বাংলাকে ভাগ করা দরকার। কিন্তু বাঙালি সম্পর্কে ব্রিটিশ তথা শাসক গোষ্ঠীর মনোভাব প্রকাশ পায় ওই নোটের ভাষায়। সেই নোটে স্যার হার্বার্ট হোপ লিখেছিলেন, ‘অখণ্ড বাংলা হল শক্তিরই নামান্তর। তাই দ্বিখণ্ডিত করা গেলে নানারকম ভাবে সেই শক্তির ক্ষয় করা যাবে।  আমাদের শাসনব্যবস্থার অন্যতম প্রতিপক্ষ যারা হয়ে উঠতে পারে, তাদের শক্তিশালী অবয়বকে দুর্বল করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে দেওয়া। ’ অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে যে, লর্ড কার্জন যতই এই বিরাট রাজ্যকে প্রশাসনিকভাবে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য রাজ্যভাগ করা দরকার বলে একটি অভিমত পোষণ করুন সরকারিভাবে, আদতে তাঁদের অনেক আগে থেকেই মনোভাব ছিল এই জাতিকে দ্বিখণ্ডিত করে দেওয়া। একটি বিদ্বেষ ও ভয় কাজ করেছে। ঐক্যকে বিনাশ করাই ছিল লক্ষ্য। আকারে ছোট হয়ে গেলে অর্থনৈতিকভাবেও দুই রাজ্য গুরুত্বহীন হয়ে যাবে। 
লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ভারতসচিব (সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়া) স্যার জন ব্রডরিককে যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, সেখানে প্রথমে যে দুটি প্রস্তাবের খসড়া পাঠানো হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল বাংলার একটি অংশকে বিভাজিত করে উত্তর পূর্ব প্রদেশসমূহ করে দেওয়া হবে। আর অন্য একটি অংশকে সংযুক্ত প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ শুধু পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ নয়। আরও বেশি করে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়াই ছিল খসড়ার প্রতিপাদ্য। যা পরে সংশোধন হয়। 
বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের প্রবল বিরোধিতায় কোনও লাভ হয়নি। প্রস্তাব কার্যকর হয়। তবে আবার ১৯১১ সালে বাংলাকে একদিকে যেমন সংযুক্ত করে দেওয়া হল, আবার তার সঙ্গেই বাঙালি জাতিকে চিরতরে শাস্তি দেওয়ার জন্য কলকাতা থেকে সরিয়ে নেওয়া হল দেশের রাজধানীকে। ৬ বছরের মধ্যেই সিদ্ধান্ত বদল হলেও বঙ্গভঙ্গের মূল উদ্দেশ্যটির বীজ কিন্তু রয়ে গেল ব্রিটিশের মধ্যে। তাই ১৯৪৭ সালে অবশেষে তারা সত্যিই জয় পেল। বঙ্গভঙ্গের স্বপ্ন সার্থক হল।  
লর্ড কার্জন প্রজাদের জন্য যতই ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন না কেন, রাজাদের জন্য অর্থাৎ শাসকের জন্য তিনি একটি চিরকালীন ফর্মুলা তৈরি করে গিয়েছেন। যে ফর্মুলাটি বিদেশি অথবা স্বদেশি, উভয় শাসকের কাছেই খুব জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য। সেটি হল, ডিভাইড অ্যান্ড রুল। প্রজাদের মধ্যে বিভাজন বাড়াও। এবং স্বস্তিতে তুমি শাসন করো। প্রজারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বিভেদ করে ব্যস্ত থাকুক। এই রোলমডেল আজও চলছে। ইংরেজ চলে গিয়েছে। তাদের ফর্মুলা রয়ে গিয়েছে। তাই কখনও ধর্মের ভিত্তিতে, কখনও জাতপাতের ভিত্তিতে বিভাজন চলছেই। আর বিভাজনের সবথেকে বড় অভিঘাত এসেছে বাঙালির কাছে। পাঞ্জাব ছাড়া ভারতের অন্য কোনও রাজ্যবাসী অথবা জাতি এই চরম বেদনা, হাহাকার আর দুর্ভাগ্যের শিকার হয়নি।
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি তাৎপর্যপূর্ণ এক গতিপ্রকৃতি তৈরি হয়েছে। এক বাঙালিকে ভারতীয় জনতা পার্টি নিজেদের অন্যতম প্রধান দিশারী হিসেবে সম্মান দেয়। ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তাঁর নির্মাণ করা রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনসঙ্ঘই হল আজকের ভারতীয় জনতা পার্টির পূর্বজন্মের নাম। ভারতীয় জনতা পার্টির তাবৎ প্রতিষ্ঠাতা ওই ভারতীয় জনসঙ্ঘের দ্বারাই সৃষ্টি। ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হিন্দু বাঙালির অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সর্বস্ব পণ করেছিলেন। তিনি হিন্দু বাঙালির স্বজাত্যভিমানের জন্য বঙ্গভঙ্গ চেয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ পেয়ে তিনি সবথেকে বেশি খুশি হয়েছিলেন। অথচ তাঁর উত্তরাধিকারী আজকের বিজেপির একাংশ সেই শ্যামাপ্রসাদবাবুর সাধের পশ্চিমবঙ্গকে আবার দুভাগ করার চক্রান্তে নেমেছে। এবারের স্লোগান দক্ষিণবঙ্গ বনাম উত্তরবঙ্গ। দুদিকে হিন্দুরাই সংখ্যাগুরু। শ্যামাপ্রসাদবাবু কি খুশি হতেন? 
উত্তরবঙ্গকে পৃথক রাজ্য কিংবা কিয়দংশ নিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হবে বলে মাঝেমধ্যেই একটি করে প্রচার ও ধুয়ো তোলা হয়। বিশেষত যখনই কোনও নির্বাচন আসে, তখনই এই প্রচারটি বৃহৎ উচ্চগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। বিজেপির উত্তরবঙ্গের কিছু নেতা পৃথক রাজ্যের দাবি তুলে অবাধে বলে থাকেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সঙ্গে তাঁদের নাকি কথা হয়ে গিয়েছে। এবার উত্তরবঙ্গকে পৃথক রাজ্য করা হবে। এই বছরই  পঞ্চায়েত নির্বাচন হতে চলেছে। আবার এখন থেকেই এই রাজ্যভাগের প্রচারটি মাত্রা পেয়েছে। এই প্রচারের সঙ্গেই কখনও কামতাপুর, কখনও জঙ্গলমহল ইত্যাদি পৃথক রাজ্যের দাবিগুলিও সুকৌশলে উত্থাপিত করা হচ্ছে। অর্থাৎ বিভিন্ন স্থানিক আবেগকে প্ররোচনা দিয়ে আদতে কিছু স্বার্থান্বেষী চক্র আবার বাঙালি জাতিকে ভেঙে দিতে চাইছে। যত বিভাজন ততই শক্তিহীন। 
দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক দুরবস্থা চরম আকার নিতে শুরু করে। কারণ লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু আগমন। আজ পর্যন্ত গত ৭৫ বছরে কোনও কেন্দ্রীয় সরকারই বাংলার উদ্বাস্তু সমস্যার নিরসন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। বাংলাকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার কোনও মরিয়া চেষ্টা করা হয়নি কংগ্রেস অথবা বিজেপি কোনও সরকারের পক্ষ থেকেই। বরং মাশুল সমীকরণ থেকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। বাংলাকে লাগাতার বঞ্চনা করাই যেন কেন্দ্রীয় শাসকদের একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। এসবের উপর যদি আবার বাংলাকে দক্ষিণবঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গ নামক দুই অংশে পুনরায় বিভাজিত করা হয়, তাহলে বাঙালি জাতির অগ্রগতির সম্ভাবনা চিরতরে নিমজ্জিত হবে কালের সমুদ্রে। 
বিজেপির সকলে কি এই দাবি করছে? একেবারেই না। দক্ষিণবঙ্গের বিজেপি নেতৃত্ব স্পষ্টভাবে বলেছে যে, বাংলা ভাগের দাবি তারা সমর্থন করে না। কিন্তু আমাদের দুটি প্রশ্ন, ১) একবার, মাত্র একবার প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেন স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছেন না যে, বাংলাকে ভাগ করা হবে না? রহস্য, অনিশ্চয়তা জিইয়ে রাখা হচ্ছে কেন? ২) পশ্চিমবঙ্গের নাম বদল করে ‘বঙ্গ’ করার প্রস্তাব রাজ্যের বিধানসভায় অনুমোদিত হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে পাঠানো হয়েছে। বছরের পর বছর সেই সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছে কেন? তাহলে কি অখণ্ড ‘বঙ্গ’ নামক কোনও রাজ্য তাঁরা চাইছেন না? 
ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অনুগামীরা এবার কি তাহলে হিন্দু বাঙালিকেই দ্বিখণ্ডিত  করতে উদ্যত?
18Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা