গল্পের পাতা

সেকালের শীতের আমোদ

শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র এমন সুলভ হয়ে ওঠার আগের যুগে, শীতের মৌতাত উপভোগ করার জন্য  মানুষকে অপেক্ষা করতে হতো ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসের জন্য। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে এদেশে আসা ভাগ্যান্বেষী সাহেবদের সেই আকুলিবিকুলি ছিল আরও প্রবল। এদেশের গ্রীষ্ম ও বর্ষার সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরী পেরিয়ে শীতের কলকাতা আক্ষরিক অর্থেই ছিল তাদের নতুন জীবনলাভের উদযাপন। সাধারণত এদেশে সাহেবদের খানা-পিনা আমোদ আহ্লাদের অভাব ছিল না। কিন্তু শীত পড়লেই সেই ফুর্তির গাঙে যেন জোয়ার আসত। ডিসেম্বরের শুরুতেই কলকাতার ইংরেজ উপনিবেশ মেতে উঠত ইংল্যান্ডের রাজার জন্মদিনকে উপলক্ষ করে। সেই আমোদের রেশ কাটতে না কাটতেই এসে পড়ত বড়দিন আর নতুন বছরের হুল্লোড়। 
প্রতিটি উৎসবেই সরকারি ভোজের ব্যবস্থা হতো। ১৭৮৬ সাল পর্যন্ত সেই সরকারি পার্টির আয়োজন করতেন খোদ গভর্নর জেনারেল। এছাড়াও সে সময়ের কলকাতার উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে ছিল সেন্ট জন’স গির্জার উদ্বোধন, রাজার রোগমুক্তির উদযাপন, মহীশূরের যুদ্ধ জয়, প্রশাসনিক তদন্তে ওয়ারেন হেস্টিংসের সসম্মানে মুক্তি পাওয়া ইত্যাদি। মানে, খুব সহজ করে দেখলে ইংল্যান্ডের দরবারি জীবনের আনন্দ-বিষাদের জোয়ার ভাটার উপর নির্ভর করত কলকাতার ইউরোপীয়দের জীবনও। তবে এইসব অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া নিয়ন্ত্রণ করত সাহেবদের সামাজিক অবস্থান। যেমন খোদ ইংল্যান্ডেশ্বরের কাজে বহাল থাকা আধিকারিকরা অগ্রাধিকার পেতেন কোম্পানির কর্মচারীদের তুলনায়। তার পরে সুযোগ আসত অন্যান্য সাহেবদের। এমনকী, মেমসাহেবদের বসার জায়গাও নির্দিষ্ট হতো তাদের স্বামীর পদাধিকারের উপর। সেটা নিয়ে ইউরোপীয় সমাজের বিস্তর অসন্তোষের খবরও পাওয়া যায় সেকালের নানা নথিতে। 
পার্টি আর ভোজসভা বাদ দিয়েও নানা ধরনের প্রমোদ অনুষ্ঠানের সাক্ষী থেকেছে সেকালের কলকাতার ইউরোপীয় বাসিন্দারা। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহের নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সুযোগ নিতে সদস্য সংগ্রহের কথাও জানা যায়। সেই চাঁদার হার ছিল মাথাপিছু একশো টাকা। এই সব আয়োজকরা শ’খানেক সদস্য জোগাড় করতে পারলেই প্রতি সপ্তাহে বা পনেরো দিনে আয়োজন করতেন  ভোজ, নাচের আসর ও কনসার্ট। 
হুল্লোড়ের এই তালিকায় নাটক দেখা নতুন করে যুক্ত হল ১৭৭৪ সালে। নতুন করে বলছি, কারণ ১৭৫৪ সাল থেকেই আজকের লালবাজারের কাছে তৈরি হয়েছিল কলকাতার প্রথম নাট্যালয়। কিন্তু সিরাজের কলকাতা আক্রমণের সময় সেই ইমারতটি শহরের প্রতিরক্ষার অন্যতম ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার পর যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির জন্য বাড়িটি উধাও হয়ে যায় শহরের বুক থেকে। প্রায় কুড়ি বছর পর নতুন রঙ্গালয় শহরের আনন্দ উল্লাসের নতুন ঠিকানা হয়ে উঠল। 
আঠারো শতকের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে শ্বেতাঙ্গ নবাবদের হাতে যে প্রচুর অর্থ এল, তার অন্যতম ফল হিসেবে দেখা গেল বিভিন্ন রকমের জুয়া ও ফাটকার খেলা। এই সময়ে শীতের বিনোদন হিসেবে শহরে প্রথম এল ঘোড়দৌড়। ইংল্যান্ডেও সে সময় শুরু হয়ে গিয়েছে এই খেলা। হিকির বেঙ্গল গেজেট ১৭৮১ সালের নভেম্বরে একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে যে, শহরের ফ্যাশন দুরস্ত মহিলা ও স্মার্ট পুরুষেরা মিস্টার প্রিন্সেপের ‘নিউ পাইস’ এবং মিস্টার টুচেটের ‘নিউ রম’ নামক দু’টি ঘোড়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হাজার হাজার টাকার বাজি ধরেছিলেন। পরের বছর কলকাতা রেস কোর্সের ঘোড়দৌড়ের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, সে সময়ে এই বিনোদন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে প্রচুর অশ্বেতাঙ্গ মানুষও যোগ দিচ্ছেন খেলায়। অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকেই কলকাতার নিয়মিতভাবে বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার সকালে ঘোড় দৌড় আয়োজিত হতো এবং তারপর অতিথিদের জন্য ব্যবস্থা থাকত এলাহি ভোজ ও বাজনার আসরের।    
ইংরেজ অভিজাত শ্রেণির আরেকটি খেলা কলকাতার শীতের অতিথি হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। সেটি ছিল ক্রিকেট। আজকাল সারা বছর ধরে দেশ-বিদেশে নানা ক্রিকেট টুর্নামেন্টের দাপট দেখে নিজেদেরই কেমন অদ্ভুত লাগে ভাবতে যে, গত শতকের শেষের দিকেও ক্রিকেট ছিল মূলত শীতের খেলা। কটন সাহেব তার কলকাতার ইতিকথার পাতায় জানিয়েছেন যে, ১৮০৪ সালের ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি কলকাতায় একটি ক্রিকেট ম্যাচ খেলা হয়েছিল। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল ইটনিয়ান সিভিলিয়ান ও কলকাতার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের নিয়ে তৈরি দলের মধ্যে। তবে বেঙ্গল গেজেটের তথ্য মানলে, ১৭৮০ সালের ২৩ ডিসেম্বর বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে প্রথম সংগঠিত হয় ক্রিকেট ম্যাচ।  
বাংলা তথা ভারতের শীতে ইউরোপীয়দের সব থেকে পছন্দের আমোদ ছিল শিকার খেলা। বাংলায় শিকারের মরশুম চলত নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। বিশেষ করে পরিযায়ী পাখি শিকারে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়তেন সাহেবরা। অনেক সময় সপরিবারে। কলকাতার উপকণ্ঠেও এমন বহু জায়গা ছিল, যেখানে ভালো শিকার মিলত।  নীলকর, সামরিক অফিসার অথবা কলকাতার মার্চেন্ট— অন্তত এই একটি জায়গায় অংশগ্রহণে সামাজিক অবস্থান খুব একটা বাধা হয়ে দাঁড়াত না। হেস্টিংসের বন্ধু ও গভর্নিং কাউন্সিলের সহকর্মী রিচার্ড বারওয়েল বারাসতের কাছে একটি হান্টিং লজের মালিক ছিলেন। কলকাতায় কিছু ক্লাব ছিল, যারা নিজেদের সভ্যদের জন্য রবিবার শহরের কাছেপিঠে শিকারের আয়োজন করত। সাহেবদের এই আউটডোর বা প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাটানোর আকর্ষণ থেকেই এদেশে তাঁরা শুরু করলেন আরেক ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ড— যার নাম হল পিকনিক। অনেক সময় শিকার করা জন্তু দিয়েই সারা হতো পিকনিকের ভোজপর্ব। 
উনিশ শতকে এদেশীয় মানুষের সঙ্গে আরও নানা ভাবে সাহেবদের মেলামেশার সুযোগ বাড়ল। ফলে তাদের নানা আচরণ প্রভাব ফেলল আমাদের সামাজিক ব্যবহারে। গত শতক থেকেই শীতটা একটু জাঁকিয়ে পড়লেই দলে দলে মানুষ খাবার-দাবার গুছিয়ে নিয়ে চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া বা ব্যান্ডেল চার্চের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তেন। তার পেছনেও মনে হয়  খানিকটা এই প্রভাব কাজ করেছে। সব মিলিয়ে শীতের কলকাতার অন্যতম পরিচয় হয়ে উঠল তার বিনোদন ও আমোদের পসরা। 
6Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা