বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ

চালের দাম বাড়ছে, কিন্তু ফিক্সড ডিপোজিটের সুদ?
শান্তনু দত্তগুপ্ত

আয়করে ছাড়ের সীমা ১২ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা হওয়ার পর সবকটা এলআইসি সারেন্ডার করে দিয়েছে সমরেশ। পুরনো কাঠামোয় আয়কর দেওয়ার তো আর প্রশ্নই ওঠে না। মাসে ৯০ হাজার টাকার উপর মাইনে পায় সে। মানে বছরে ১২ লাখের নীচেই থাকবে। এবার টাকা শেয়ার বাজারে খাটাবে বলেই ঠিক করেছে সমরেশ। কিন্তু সমস্যা একটাই, মার্কেটটা সে এতটুকু বোঝে না। লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে যা বুঝেছে, তাতে এসআইপি দিয়ে শুরু করাই ভালো। মানে সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান আর কী। গোদা বাংলায় সে বুঝেছে, এটা অনেকটা রেকারিংয়ের মতো। মাসে মাসে একটা নির্দিষ্ট অঙ্ক কেটে নেবে অ্যাকাউন্ট থেকে। তারপর সেই টাকা তার হয়ে সেই কোম্পানি খাটাবে বাজারে। খুব ধস না নামলে রিটার্ন যা পাওয়া যাবে, রেকারিংয়ের থেকে বেশি। 
দীনেশবাবু ছেলেকে অনেক শখ করে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, টেনে দিতে পারবেন। কোভিড এসে তাঁকে পথে বসায়নি ঠিকই, কিন্তু ফুটপাতে অবশ্যই দাঁড় করিয়েছে। কোভিডের সময় বেতন কাটা গিয়েছিল। এখনও সেই মাপকাঠি ছুঁতে পারেননি তিনি। মাঝে হু হু করে বেড়ে গিয়েছে ছেলের স্কুলের মাইনে। এখন সে পড়ে ক্লাস এইটে। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে চাল ডালের দাম। কোম্পানির অ্যাকাউন্টস দপ্তরে কাজ করেন দীনেশবাবু। অঙ্কটা বোঝেন। সাধারণ পাটিগণিতের হিসেব ধরলেও এই চার বছরে ৫ শতাংশ গড়ে মূল্যবৃদ্ধি ২০ শতাংশ বেড়েছে। স্কুলের মাইনে বছরে ১০ শতাংশ হারে বেড়েছে ৪০ শতাংশ। মানে নিজের এবং পরিবারের সব শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েও তাঁর মাসের খরচ বেড়েছে ৬০ শতাংশ। আর বেতন? সেই তিমিরে। এখন প্রতিদিন অফিস থেকে বেরিয়ে টিউশন পড়াতে যান দীনেশবাবু। তাতে কিছুটা ইনকাম হয় ঠিকই। কিন্তু রুমাল দিয়ে কি আর চাদরের বন্দোবস্ত হয়? অগত্যা হর্ষবর্ধন ফর্মুলা... এর কাছ থেকে ধার নিয়ে ওকে শোধ করেন। আর ওর থেকে ধার নিয়ে একে। 
প্রতি তিনমাসে একবার করে সাইকেল নিয়ে চরতে বেরন বিমল চক্রবর্তী। অবসর নিয়েছেন বছর দুয়েক। বেশ কিছু টাকা পেয়েছিলেন রিটায়ার করার পর। ভেবেছিলেন, সুদেই দিব্যি চলে যাবে। সংসার বলতে তো দুটি প্রাণী, তিনি আর স্ত্রী। কী আর খরচ? কিন্তু মাস ছয়েক যেতেই টনক নড়ল তাঁর। সুদের টাকায় যে আর চলছে না! খাওয়া খরচের থেকে ওষুধের বোঝা অনেক বেশি। ছমাস আগে দুই বুড়ো বুড়ির ওষুধে লাগত হাজার তিনেক টাকা। এখন প্রায় চার হাজার। চালের দাম হঠাৎ কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে গিয়েছে। স্ত্রী অনুরাধাকে এতকিছু বলেননি। তিন মাস অন্তর সাইকেল চালিয়ে ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে ঘোরেন। যেখানে বেশি সুদ পাওয়া যায়, সব টাকা তুলে সেখানে নিয়ে গিয়ে রাখেন। যা বেশি পাওয়া যায়, সেটাই লাভ। 
সেদিন বিমলবাবু কাগজে পড়েছেন, ফিক্সড ডিপোজিটে সুদের হার কমাচ্ছে না ব্যাঙ্কগুলো। হাঁফ ছেড়েছেন তিনি। এমনিতেই ব্যাঙ্কে টাকা রেখে লাভ যে হয় না, সেটা বোঝা হয়ে গিয়েছে তাঁর। সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য স্টেট ব্যাঙ্ক সুদ দেয় ৭.৭৫ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোতে সামান্য বেশি। তাও কোথাও ৮.৬৫ শতাংশের উপর খুঁজে পান না বিমলবাবু। সেক্ষেত্রে আবার সময়সীমার কম-বেশি আছে। এর বেশি পেতে হলে অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বারস্থ হতে হবে। ভরসা পান না বয়স্ক মানুষটা। কিন্তু ছ’মাস অন্তর যেভাবে সংসার আর চিকিৎসা খরচ বাড়ছে, তা চোখে অন্ধকার দেখানোর জন্য যথেষ্ট। এই ক’টা টাকা তো সুদ! আসলে হাত পড়েই যাচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম যে হারে বাড়ছে, তার সঙ্গে ব্যাঙ্কের সুদ কোনওমতেই পাল্লা দিচ্ছে না। দেবেও না। বরং যত দিন যাবে, সেটা আরও কমবে। ২০১৪ সালে একজন সিনিয়র সিটিজেন ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট করলে ৯.২৫ শতাংশের আশপাশে সুদ পেতেন। মূল্যবৃদ্ধির হার ৫-৬ শতাংশ থাকলেও সংসার চালাতে অসুবিধা হতো না। এখন ভাবছেন বিমলবাবু... এভাবে আর কতদিন! শেয়ার বাজারে টাকা খাটাতে ভয় পান তিনি। ভাবেন, যদি সব টাকা ডুবে যায়? তাহলে তো আত্মহত্যা করা ছাড়া গতি থাকবে না। ব্যাঙ্ক সুদ কম দিতে পারে, টাকাটা তো সুরক্ষিত! এটুকুই না হয় প্রাপ্তি। তিনি জানেন না, ব্যাঙ্ক কিন্তু তাঁর মতো প্রবীণ নাগরিকদের কথা ভেবে ফিক্সড ডিপোজিটের সুদে তালা মেরে রেখেছে, এমনটা নয়! তারা আসলে পড়েছে উভয় সঙ্কটে। মূল্যবৃদ্ধির বাজারে সঞ্চয় প্রায় ভুলেই গিয়েছেন দীনেশবাবুরা। তাঁদের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরনোর দশা। ব্যাঙ্কে টাকা জমাবেন কী! আর আম জনতা যদি ব্যাঙ্কে টাকা না রাখে, তাহলে তাদের ডিপোজিট ধাক্কা খাবে। জমা টাকা পর্যাপ্ত না থাকলে লোন দেবে তারা কোথা থেকে? ইদানীং তো লোন নেওয়ার মতো লোকও খুঁজেপেতে আনতে হচ্ছে। ব্যাঙ্কের এই ভাঁড়ে মা ভবানী দশার প্রভাব কিন্তু পড়ছে শেয়ার বাজারেও। গত কয়েক মাসে শুধুমাত্র ব্যাঙ্কিং সেক্টরের শেয়ারের দাম কত পড়েছে, সেই পরিসংখ্যান দেখলেই ছবিটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। বহু বিশেষজ্ঞ দাবি করছেন, আমেরিকার নতুন সরকারের নীতির জন্যই ভারতের শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে। সেটা একটা কারণ হতে পারে, কিন্তু একমাত্র নয়। তলানিতে থাকা ব্যাঙ্কের ডিপোজিটও আর একটা কারণ। এছাড়া রয়েছে উৎপাদন ক্ষেত্রের হাতে হ্যারিকেন দশা। বাজারে চাহিদা না থাকলে উৎপাদন বাড়বে না। তাকে সঙ্গত করবে মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্ব। তার প্রভাব দেশের আর্থিক বৃদ্ধি বা জিডিপির উপর পড়বেই। আর জিডিপি ৬-৬.৫ শতাংশে থমকে থাকলে শেয়ার বাজার কার ভরসায় বাড়বে? বিদেশি লগ্নিকারীরাও এখন ভারতের মার্কেট থেকে ডলার তুলে নিয়ে চীনের শেয়ার মার্কেটে ঢেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে জমা আমানতের উপর সুদের হার কমিয়ে দিলে সাধারণ মানুষ আরও বেশি করে ব্যাঙ্ক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। অর্থাৎ ফিক্সড ডিপোজিট করবে না। তখন ব্যাঙ্কের হবে আরও শোচনীয় দশা। তাই আরবিআই রেপো রেট কমানোর পর বহু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক গৃহঋণের উপর সুদ কমিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ফিক্সড ডিপোজিটে হাত দেয়নি। 
এখন প্রশ্ন হল, ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে এই মানুষগুলো রাখছেন কোথায়? ডাকঘরের এমআইএস বা মান্থলি ইনকাম স্কিমে কেউ কেউ রাখেন। তাতেও সুদের হার কিন্তু সেই সাড়ে সাত শতাংশের আশপাশে। মাসে মাসে সুদটা অ্যাকাউন্টে ঢুকে যাচ্ছে, এই যা। বাড়তি কোনও লাভ নেই। ২০১৪ সালে কিন্তু এই সুদের হারই ছিল প্রায় সাড়ে আট শতাংশ। সাদা চোখে অঙ্কটা স্পষ্ট—মূল্যবৃদ্ধির হার যতটা ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে, সঞ্চয়ের উপর সুদ ততই কমেছে। মানুষকে বাধ্য করা হয়েছে শেয়ার বাজারে লগ্নিতে। অর্থাৎ, ঝুঁকিহীন বিনিয়োগে রাষ্ট্র আর আমার-আপনার পাশে নেই। স্টক মার্কেটে বেশি টাকা ঢুকলে কর্পোরেট তো বটেই, লাভ বাজার অর্থনীতিরও। তাই এখানে কাদের টেনে আনতে হবে? চাকরিজীবীদের। এবং অবশ্যই যাঁদের বেতন বছরে ১০ লক্ষ টাকার বেশি। সমরেশ দেখে নিয়েছেন, পুরনো কাঠামোয় কর দিতে গেল তাঁকে ৩০ শতাংশ গুনতে হচ্ছে। স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন এবং বিনিয়োগের ছাড় জুড়েও লাভ হচ্ছে না। অথচ নতুন কাঠামোয় এবার তাঁকে আয়কর কিছুই দিতে হবে না। যে টাকাটা বেঁচে যাবে, সেটা দিয়ে এসআইপি তিনি করতেই পারেন। বয়স কম। ঝুঁকি তাই নিতেই পারেন। পাঁচ বছর মিউচুয়াল ফান্ডে টাকা ঠিকমতো খাটলে রিটার্ন ব্যাঙ্কের থেকে বেশিই মিলবে। কিন্তু ধীমানবাবুর সেই সঙ্গতি নেই। তিনি ভাবছেন, কবে আয়ত্তে আসবে চাল-ডালের দাম। কবে মাস-মাইনেটা লাফিয়ে আর কয়েক ধাপ উঠবে। কবে ছেলের বোর্ড পরীক্ষা মিটবে, আর পড়ার খরচের বোঝা খানিক হালকা হবে। চারদিকে তিনি বিজ্ঞাপন দেখেন, রিটায়ারমেন্ট বেনিফিটের কথা ভাবুন। দিনে ১৫০ টাকা জমালে অবসরের পর দেড় কোটি টাকা ঘরে নিয়ে যান। অলীক স্বপ্ন মনে হয় ধীমানবাবুর। দিনে ১৫০ টাকা মানে মাসে সাড়ে চার হাজার। কোথায় পাবেন তিনি? ধীমানবাবু জানেন, শূন্য হাতে অবসর নিতে হবে। তারপর কী? ভাবতে পারেন না। 
ভাবতে পারেন না বিমল চক্রবর্তীও। রোজ দিনের শুরুটা করেন একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে। আর সাত-দশ বছর বাঁচলে ঠিক আছে। কিন্তু তারপর? তিনি চলে যাওয়ার পর যদি অনুরাধা বেঁচে থাকে? ও কীভাবে চালাবে? পাশের বাড়ির গৌতমের কাছে শুনছিলেন বিমল চক্রবর্তী... ওর এজেন্সিতে নাকি লোক নেবে। সিকিওরিটি গার্ডের কাজটা এখনও চালিয়ে দিতেই পারবেন তিনি। ঘরে বসে থেকে হবেটা কী?
3h 3m ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কর্মক্ষেত্রটি অনুকূল। নূতন কর্মের সন্ধান প্রাপ্তির যোগ। উপযুক্ত ক্ষেত্রে পরিবারের কারও বিবাহ স্থির হতে পারে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৬.৫৩ টাকা৮৮.২৭ টাকা
পাউন্ড১০৮.২৪ টাকা১১২.০২ টাকা
ইউরো৮৯.৩৩ টাকা৯২.৭২ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা