কী শেখাল ট্যাংরার সম্পন্ন ব্যবসায়ী পরিবারের মাত্র এক রাতে শেষ হয়ে যাওয়ার মর্মন্তুদ কাহিনি। নিঃসন্দেহে এই বাংলায় হালের অন্যতম বড় পারিবারিক বিপর্যয়ের ঘটনা। এ নিয়ে দু’সপ্তাহ পরও শহর থেকে প্রত্যন্ত জেলা, মানুষের প্রশ্নের অভাব নেই। খণ্ড খণ্ড উত্তর মিললেও এখনও পুরো বিষয়টি স্পষ্ট নয়। হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া বাঁধা ছিল দে বাড়িতে। চারতলা বাড়ি, এদিক ওদিকে ছড়ানো জমি, সম্পত্তি। নতুন গাড়ি, সাজানো সংসার। পেল্লায় বাড়ির অদূরেই আধুনিক কারখানা। সোনাদানা। কম ছিল না কিছুই। বিরল হলেও এ যুগেও প্রণয় ও প্রসূন শুধু একছাতার তলাতেই থাকতেন না, দুই ভায়ের পরিবারের মধ্যে বোঝাপড়াও ছিল ঈর্ষণীয়। আগাগোড়া সুসম্পর্কই ছিল বলা যায়। কোথাও অভাব কিংবা অবিশ্বাস ছিল, একথা বলবে না অতি বড় নিন্দুকেও। তবু মনুষ্য চরিত্র ও ব্যবহার কখন কোনদিকে বাঁক খায় কেউ বলতে পারে না। মনের চাহিদাও বদলে যায় সময়ের সঙ্গে। ওইটুকুতেই খুশি থাকতে না পেরে আরও আরও দেনার পাঁকে ডুবে যাওয়ার জটিল রসায়ন পুরোটা বেআব্রু হওয়া এখনও বাকি। প্রশ্ন একটাই, মন্দা গ্রাস করছে টের পেয়েও বিলাসে ফুর্তিতে, দেদার খরচে রাশ টানা গেল না কেন?
ব্যবসা যাঁরা করেন তাঁরা জানেন, সবদিন সমান যায় না। লাভক্ষতি, ওঠাপড়া এই যাত্রার নিত্যসঙ্গী। দেনাও একদিনে হয় না। দে পরিবারের ব্যবসা দীর্ঘদিনের। দুই পুরুষের। সাময়িক ধাক্কা আসতেই পারে। অতি বড় সফল ব্যবসায়ীরও বাজারে দেনা থাকে। চেকও যে বাউন্স করে না এমন নয়, কিন্তু রাতের অন্ধকারে নিজেদের শেষ করে দেওয়ার এমন নির্মম প্ল্যান রচনা এবং তা নিয়ে একসঙ্গে বসে আলোচনা, শেষে হাতের শিরা কেটে, পায়েস খাইয়ে বাড়ির দুই বউ ও কন্যা সন্তানকে খুনের ঘটনা বিরল। অবশেষে তিন তিনটে লাশ বাড়িতে ফেলে রক্তাক্ত কিশোরকে সঙ্গে নিয়ে চলন্ত গাড়ির ধাক্কা মেট্রোর পিলারে! হঠাৎ কী হল? নাকি লোভ, লালসা আর রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে মানুষের মনও ক্রমেই অপরাধপ্রবণ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। চাহিদা ও সামর্থ্যে না মিললেই পথ শেষ। তারপর দুয়ে দুয়ে চার, হিসেব মেলাতে না পেরে নিজের আত্মজকে খুন করে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া ছাড়া উপায় কী?
আমি মনস্তত্ত্ববিদ নই, তবে এটুকু বুঝি যে অল্পে সন্তুষ্ট থাকতে আমরা সবাই ভুলে গিয়েছি। অধিকাংশ সমস্যার উৎস এই কারণেই। সেলফিসর্বস্ব ভোগবাদী জীবন অজানার পিছনে ছুটতে ছুটতে আমাদের দু’শো গুণ ঋণ নির্ভর করে তুলেছে। অনেকের পকেটে চারটে করে ক্রেডিট কার্ড! বড় দোকানে ঢুকলেই জিনিস পছন্দ হওয়ার আগেই ঋণ মঞ্জুর। ফাঁকা পকেটেও চাইলেই কিনতে পারি বিলাস সামগ্রী। কোনও বাধা নেই। তবু শান্তি আর সন্তুষ্টি আজকের নাগরিক জীবনে ব্রাত্য। আরও পাওয়ার নেশায় মন উচাটন। আমাদের মা কাকিমাদের দেখেছি পুজোয় সামান্য একটা শাড়িতেই কত আনন্দ! শীতের দুপুরে ছাদে বসে সামান্য কতবেল মাখা আর আচারে কী তৃপ্তি! আর আজ মধ্যবিত্ত ঘরে দশহাজারি দামি শাড়ি, হীরের গয়না আর প্রসাধনেও মন ওঠে না। ‘আরও চাই’, দীর্ঘশ্বাস প্রবাহিত হয় ঋজু মেরুদণ্ড দিয়ে। এর নিট ফল, পাওনাদারের তাগাদা, বাজারে দেনার পাহাড়, ক্রেডিট কার্ডের কিস্তি মেটাতে না পারার গ্লানি। শেষে সামলাতে না পেরে আপনজনকে মেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার চেনা ফর্মুলা। এই প্রজন্ম আকাশ ছুঁতে গিয়ে থামতে ভুলে যাচ্ছে। বিশ্বায়ন যেমন অনেক দিয়েছে, তেমনই কেড়ে নিয়েছে স্বস্তি। একইসঙ্গে আমাদের পরাধীনও করে দিয়েছে বাজারি ঋণের কাছে! স্বপ্নালু চোখে প্রত্যাশায় দাঁড়ি টানতে ভুলে যাচ্ছি আমরা। তারপর যখন সংবিৎ ফিরছে তখন দেখছি, দেরি হয়ে গিয়েছে অনেক। পায়ের তলার মাটি কতটা শক্ত পরখ করে পা ফেলতে ভুলে গিয়েছে এই প্রজন্ম। সমস্যাটা এইখানেই।
গত একমাসে এ রাজ্যের বিভিন্ন কোণে, কলকাতা থেকে জেলায় একটার পর একটা ঘটনা বলে দিচ্ছে, রোজগার থাকুক আর নাই থাকুক, এই সমাজ কারও জন্যই আর নিরাপদ নয়। চাকচিক্য, বিলাসিতা, বাহারি আলোর ধুম, মার্বেলে ঘেরা চকমেলান ফ্ল্যাট সব বাহ্যিক। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শুধু আর ক’টা ইএমআই বাকি আছে তার হিসেব কষা। ভিতরে ভিতরে সমাজটা কেমন যেন ফোঁপরা। সবাই আপস করছি। মনের বাঁধন আলগা হলে, সহ্যশক্তি কমতে বাধ্য। মানবিক সম্পর্কগুলো ক্রমেই ভঙ্গুর। কারও জন্য এক মুহূর্ত দাঁড়াবার সময় নেই। প্রিয়জনের মৃত্যু সংবাদ পেলেও না। রাজনীতিতে যেমন অতি তুচ্ছ কারণে দলবদল অভ্যাসে পরিণত। তেমনি সংসারেও সম্পর্ক আজ বড্ড ক্ষণস্থায়ী। এক সম্পর্ক ভেঙে ঢুকে যাচ্ছি আর এক সম্পর্কে। পুরনো মূল্যবোধ, পারিবারিক অতীত, আমি কী ছিলাম আর কী হইলাম—তা অতি সামান্য কারণেই ছত্রখান হতে বাধ্য। লক্ষ্য যেখানে আকাশচুম্বী, চারদিকে শুধু রঙিন জীবনের হাতছানি। আকাশ সমান উচ্চাশা এবং তা ছুঁতে না পারলেই নিকষ হতাশায় ডুব। শেষে ঘর বন্ধ করে বিষপান কিংবা গলায় দড়ি। হাতের শিরা কাটা। মুক্তির এই সহজ উপায়ই বলে দেয়, আমরা কেউই নিরাপদ নই, টাকা থাকলেও নয়, না-থাকলেও নয়। কারণ বড় হতে গিয়ে প্রথমেই আমরা শিকড়টাকে কেটে ফেলছি। তাই দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াবারও কেউ নেই!
ট্যাংরার পরিবারে তো বাড়ি, গাড়ি, কারখানা, বৈভবের কোনও অভাব ছিল না। দুই ভায়ের সাজানো সংসার। সেখানে দুই ছেলে ও মেয়ের অত্যন্ত নিরাপদে পড়াশুনো শিখে হয় বড় চাকরি কিংবা বাবা-কাকার ব্যবসার হাল ধরার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎই যত্নে বেড়ে ওঠা দুই কিশোর কিশোরীর উপর নেমে এল প্রাণঘাতী হামলা। বাইরের কোনও দুষ্কৃতী নয়, বাবা-কাকার মিলিত পরিকল্পনায়! যার ব্লুপ্রিন্ট একসঙ্গে বসে চূড়ান্ত করেছিল দু’টি পরিবার। মেয়েটি মারা গিয়েছে মা ও কাকিমার সঙ্গেই। হাতের শিরা কাটা। পায়েসের বিষ। ছোট ছেলেটিও মারাত্মক জখম। কে তার দেখভাল করবে, খুঁজেই পাচ্ছে না প্রশাসন। ভেবে দেখুন তো কী নির্মম পরিণতি একটা বিত্তবান পরিবারের। তাহলে অভাবী সংসারের সঙ্গে যাদের অনেক আছে, তার পার্থক্য কোথায়? ওই ছেলেটি হাসপাতালে শুয়ে কোন ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এমন আঘাতের মধ্যেও। ও তো ঝুপড়ির বাসিন্দা নয় যে ওর জন্য হোমের খোঁজ করতে হবে? কিন্তু তবু পরিণতি কি সেদিকেই যাচ্ছে? এই ট্রমা কাটলেও ওই ছেলের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় এতবড় ঘটনা কী প্রভাব ফেলবে তা বলবে ভবিষ্যতই। ভগবানের কাছে প্রার্থনা, অন্তত ছেলেটি যেন দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।
আমাদের মনোবৃত্তি আজ কোথায় পৌঁছেছে তার আরও একটা উদাহরণ, বাড়িতে পিসি-শাশুড়িকে খুন করে দেহ ফেলে রেখে তাঁর এটিএম কার্ড দিয়ে গয়না কিনতে বড়বাজার ছুটছি। যেটুকু জানা গিয়েছে, ওই পরিবারটিও একেবারে গরিব হতদরিদ্র নয় যে পিসি-শাশুড়ির টাকাটা না পেলে ভাত জুটবে না। বরং যিনি এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন, সেই ফাল্গুনীদেবীর স্বামীরও ব্যবসা আছে। আত্মীয়স্বজনও প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তবু পিসি-শাশুড়ির ৭০ ভরি সোনা আর ব্যাঙ্কে গচ্ছিত চার লক্ষ টাকায় নজর। গয়না কিনে ফিরে বাড়িতে মৃতদেহ পিস পিস করে কেটে মধ্যমগ্রাম থেকে কুমোরটুলির গঙ্গার ঘাটে ফেলতে আসা। ভেবে দেখুন, কোন অন্ধকারের দিকে যাত্রা করছে আমাদের মেকি সভ্যতা। পড়াশোনা, শিক্ষার অহঙ্কার, মনুষ্যত্ব সব জলে। আসলে একসঙ্গে অনেক ইনফরমেশনই আমাদের মাথায় চক্কর কাটছে, যা আজ থেকে পাঁচ দশ বছর আগেও ছিল অভাবনীয়। কিন্তু এই ‘সব জানা’টাই আমাদের ভীষণ স্বার্থপর, আত্মমুখী বর্বর মানুষে পরিণত করছে। অন্যের সর্বনাশ দেখলে আমরা শান্তি পাচ্ছি। মনটা ফুরফুরে হচ্ছে। আত্মসুখের এই চক্রব্যূহে আমরা ক্রমেই বন্দি হয়ে যাচ্ছি। এখানে ঢোকার মন্ত্র জানি, বেরবার মন্ত্র অজানা!
সুতন্দ্রা চট্টোপাধ্যায় একটি নাচের দল চালাতেন। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থার কর্ত্রী। গয়ায় যাচ্ছিলেন। পথে দু’টি গাড়ির রেষারেষিতে উল্টে গিয়ে প্রাণ গেল তাঁর। ইভটিজিং ছিল কি না, দোষ কার—এসব প্রশ্নে যাচ্ছি না। চন্দননগরের একটা মধ্যবিত্ত পরিবার। যে পরিবারের গৃহকর্তা মাত্র কয়েক মাস আগে মারা গিয়েছেন। রোজগেরে ওই একমাত্র মেয়েটিকে ঘিরেই আবার সংসারটা নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিল। সেখানে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে বেদনার। যদি অপর গাড়ির কোনও দোষই না থাকবে তাহলে অভিযুক্ত গাড়ি ব্যবসায়ী বাবলু যাদব ঘটনার পর পালালেন কেন? কেন তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই বলা হল, চেজ করছিল সুতন্দ্রার গাড়িটিই? এমন অনেক প্রশ্নেরই উত্তর নেই। সব অপরাধের উত্তর মেলে না। কিন্তু অপরাধীর যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় তা প্রশাসনকে দেখতে হবে।
একটা জিনিস ক্রমেই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, আমরা সাধারণভাবে বাঁচতে ভুলে যাচ্ছি। যেমন আমার ছেলেকে ক্লাসে ফার্স্ট হতেই হবে, নাহলে সমাজ সংসার সব মিছে হয়ে যাবে! তেমনি পাড়ায় মহল্লায় সব ব্যাপারে আমাকে টেক্কা দিতেই হবে, এই সুপ্ত আকাঙ্ক্ষার নিঃশব্দ ইঁদুর দৌড়ই সর্বনাশ ডেকে আনছে। এ থেকে মুক্তির পথ খুঁজে না পেলে এরকম ঘটনা আর দেনার ফাঁদে পড়ে আত্মহনন বাড়তেই থাকবে। এর থেকে পরিত্রাণের একটাই উপায়, সহজ সামান্য হয়ে বেঁচে থাকা। ব্যক্তিগত চাহিদাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই দেখবেন পৃথিবীটা আবার সুন্দর হয়ে গিয়েছে।