বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ

‘আত্মঘাতী বাঙালি’র মুখের ভাষা আজ বিপন্ন
তাপসী দাস

কারও মাতৃভাষা যে ‘সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ’ হতে পারে তা বোধহয় বাঙালি হয়ে না জন্মালে টেরই পাওয়া যায় না। হিন্দি-ইংরেজি সেরা আর বাংলা ম্যাড়মেড়ে— এই হীনম্মন্যতাবোধে ভোগা কিছু বাঙালি আজ বিশুদ্ধ বাংলা বলতেও লজ্জা পান! অনেক বাঙালি তো মনে করেন, বাংলা ভাষার সঙ্গে ইচ্ছেমতো হিন্দি-ইংরেজি না মেশালে, ভাষাটা ঠিক ওজনদার ও অভিজাত হয়ে ওঠে না। আসলে কোন ভাষায় কথা বলব সেটা নিয়ে দোটানায় থাকি আমরা নিজেরাই। দু’একটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করলে নাকি লোকে আমাদের শিক্ষিত মনে করবে না। 
হয়তো তাই, নাগরিকদের বিশেষত তরুণ প্রজন্মের 
একটা অংশ পারতপক্ষে বাংলা বলেনই না। এবং সেই 
অংশটা ক্রমশই বাড়ছে। যাঁরা বলেন, তাঁদের কথাতেও অর্ধেক হিন্দি বা ইংরেজি শব্দের ছয়লাপ। আর, যদি বা বাংলা বলে তবে বাক্যের ছিরি-ছাঁদে যা উচ্চারিত হচ্ছে তা ঠিক কোন ভাষা তা নিয়ে তৈরি হচ্ছে ঘোর দ্বন্দ্ব। অন্য ভাষা থেকে নকল করা ভাষাভঙ্গির উৎকট অপপ্রয়োগ চলছে অকাতরে। নির্ভুল বানান তো দূর অস্ত, অভিধানে শব্দের নমুনা খুঁজতে গেলেও হয়রান।
ভাষা চলমান নদীর মতো। সময়ের স্রোতে সে অনেক ভাঙাগড়া প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। সমৃদ্ধ হয়। 
আবার কখনও কখনও তার প্রতি ভালোবাসা, অন্তরের আবেগের টান শুকিয়ে গেলে তা ধাক্কাও খায়। প্রাণের 
ভাষা, নিজের মুখের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে সংশ্লিষ্ট জাতির উদ্যোগও হেরিটেজ মর্যাদার থেকে বোধহয় বেশি দরকারি। সেই উদ্যোগ, কর্মসূচি কোথায়? বরং নেতিবাচক ছবিটাই প্রবল।
এ কথা ঠিক যে, প্রচলিত মূল ধারার বাংলা গদ্যরীতিতে ইংরেজি ছাঁচ অনেক দিনের আমদানি। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের প্রবণতা বাংলা ভাষায় অন্য ভাষার ক্রিয়াপদের মিশ্র ব্যবহার। যেমন— ‘ফোন’ করব শব্দটির নতুন প্রয়োগ ‘ফোনাব’। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ‘ট্যাগানো’ (‘ট্যাগ’ করার বদলে)-র মতো শব্দ কথ্য বাংলায় অনায়াসে জায়গা করে নিচ্ছে। এ রকমই অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়, যা টেবিল-চেয়ারের মতোই এখন বাংলা শব্দভাণ্ডারে ঢুকে পড়ছে। বাঙালির তা নিয়ে কোনও হেলদোল নেই। বহু অভিভাবক তো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, ছেলেমেয়ে বাংলা ভালো না জানলে কিচ্ছু যায় আসে না। কারণ, কেরিয়ারে তা নাকি কোনও কাজেই লাগে না। অথচ, এই বাংলারই ভূমিপুত্র রয়েছেন তিন তিনজন নোবেলজয়ী। রবীন্দ্রনাথ থেকে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই গরিমা বাঙালি ছাড়া আর কোনও ভারতীয় জাতির নেই। বাংলা ভাষার সিনেমা সত্যজিৎ রায়কে দিয়েছে অস্কারজয়ীর সম্মান। এই বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জনের বিনিময়ে মিলেছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর স্বীকৃতি।
তবু কেন আমাদের এই বিপন্নতা? ইংরেজি আর হিন্দির আগ্রাসনে কেন কোণঠাসা বাংলা? হিন্দি, ইংরেজি সুয়োরানি, বাংলা ঘরের কোণে পড়ে থাকা দুয়োরানি। আমাদের নতুন প্রজন্ম বড়ই হচ্ছে এমন পরিবেশে, যেখানে বাংলা ভাষার দর নেই। আত্মঘাতী বাঙালির ধারণা, রূপসী বাংলা ভাষার টানে আটকে থাকলে উপোসী হয়ে থাকতে হবে। নইলে চাকরির বাজারে আনফিট। ইংরেজি মানে বেশি মাইনে। ইংরেজি অর্থনৈতিক ভাষা— এই ধারণা বাঙালির মগজে সেই কবেই ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছেন ফিরিঙ্গি লর্ড মেকলে।
১৮৩৫ সাল। লর্ড মেকলে ঘোষণা করলেন ব্রিটিশ শাসনের শিক্ষানীতি। কী ছিল সেই শিক্ষানীতিতে? বলা হয়েছিল, ভারতীয়দের ‘একটি শ্রেণি’ তৈরি করা হবে যারা হবে রক্তে ভারতীয় কিন্তু চিন্তা-চেতনায় ইংরেজ। মেকলে মিনিটস- এর উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজি জানা কেরানি শ্রেণি তৈরি করা। তৈরি হল কিছু উঠতি বড়লোকও। যারা ইংরেজি ভাষাটা রপ্ত করে ঠাটে বহরে কলকাতার ভাগ্যবিধাতা হয়ে উঠলেন। সেই শুরু। তারপর নবজাগরণ, স্বাধীনতার লড়াই। কিন্তু ইংরেজি ভাষার প্রতি বাঙালির আনুগত্য কমেনি। কারণ, ব্রিটিশ আমলে ইংরেজি ভাষা না জানলে উচ্চশিক্ষা, প্রশাসন এবং চাকরির সুযোগ সীমিত ছিল। ফলে সাধারণ মানুষ বাংলা শেখার চেয়ে ইংরেজির দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়। পরাধীনতার গ্লানি মিটলেও চিহ্ন রয়ে গিয়েছে বাঙালির মনে। সেই ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই বাংলা ভাষাকে হেয় করার প্রবণতা শুরু হয়েছে। স্বাধীনতার পরও বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে ইংরেজিকে উচ্চস্তরের ভাষা হিসেবে দেখা হয়, যা ভাষার অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ।
আমাদের কাছে বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা একষট্টির উনিশে মে তারিখগুলি শুধু ইতিহাস। হ্যাঁ, একুশে ফেব্রুয়ারি আর উনিশে মে— বাংলা ভাষাকে নিয়ে পুজো করার দিন। কিন্তু ভুলে যাই আমাদের ভূগোল, আমাদের ইতিহাস। বাংলা ভাষাকে রোজ লড়তে হয় এই ভারতেরই আরও সরকার স্বীকৃত ২১টি আঞ্চলিক ভাষা সহ অসংখ্য ভাষার সঙ্গে। ভাষাভাষীর সংখ্যার নিরিখে বাংলার তুলনায় হিন্দি বেশ খানিকটা এগিয়ে। তার উপর রয়েছে ইংরেজির প্রবল চাপ। বাস্তবে বাঙালির কাছে আজ পেটের টানে ইংরেজি আর বিনোদনে হিন্দি। ‘শাসকের ভাষা’, এই অভিমানটা ইংরেজি ভাষার সঙ্গে এখনও যেন ভীষণ ভাবে জড়িয়ে আছে। এর ফলে ইংরেজি জানা, লিখতে ও বলতে পারার একটা প্রবল স্পৃহা কাজ করে। আর তার সমান্তরালে জেগে ওঠে মাতৃভাষা বাংলাকে তাচ্ছিল্য করার একটা প্রবণতা।
বাঙালি বরাবর গ্লোবাল জাতি। তাই বাংলা বিজ্ঞাপনেও ব্যবহৃত ভাষা হিন্দি আর ইংরেজি শব্দের মিশেলে জগাখিচুড়ি। অবাঙালি ঢঙে বাংলা উচ্চারিত হচ্ছে। ব্যাকরণও অশুদ্ধ। কিন্তু শিশুরা তো সেটাই শুনছে, সেটাই শিখছে। শহর কলকাতার আনাচে কানাচে প্রায় রুগ্ন যে বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলি চলছে, প্রায় সবগুলির দশাই করুণ। সেখানে এখন যায় সমাজের একেবারে প্রান্তিক অংশের নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরাই। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের দাপটে নাভিঃশ্বাস উঠেছে বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলির। অথচ, বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারত বুনিয়াদি স্কুলগুলি। বাংলাকে ভুলে ইংরেজি নয়, দু’টি ভাষাই সমান যত্নে শেখা ছিল শিক্ষার পরিচয়। কিন্তু সেই স্কুলগুলিকে যাবতীয় পরিকাঠামো দিয়ে শক্তিশালী করার উদ্যোগ কোথায় সরকারি স্তরে? 
অভিভাবকদের একটা বড় অংশ ভাবছেন, সাহেবদের ভাষা বিহনে এখন উচ্চশিক্ষার জগৎ অন্ধকার। শৈশব থেকে তাই ইংরেজি শিখতে হবে। কিন্তু তার সঙ্গে মাতৃভাষা বাংলা ভুলতে হবে কেন? তাকিয়ে দেখুন, দক্ষিণ ভারতের দিকে। ইংরেজি সেখানেও স্বমহিমায় বিরাজমান। তবে কখনওই মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। আজ দক্ষিণ ভারতের ছেলেমেয়েরা দেশ-বিদেশ সর্বত্রই উচ্চ পদমর্যাদার চাকরিতে বহাল। অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের সঙ্গে যদি ভাষাকে যুক্ত করা না যায়, তবে সেই ভাষা একদিন হারিয়ে যেতে বাধ্য। হারিয়ে যাবে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়। তাই শাসকশ্রেণির উদ্দেশ্য থাকে, তাদের ভাষা ছাড়া অন্যান্য মাতৃভাষার উপর আক্রমণ হেনে সেই ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের সব দিক থেকে পঙ্গু করে দেওয়া। ভাষাবিদদের হিসেব বলছে, শুধুমাত্র ভারতেই রয়েছে ৬০০টির মতো বিপন্ন ভাষা। গত ৫০ বছরে ২৫০টির মতো ভারতীয় ভাষার মৃত্যু হয়েছে।
আমরা নিজেরাই যে বালির ঘর বানিয়েছি, তা আজ মাটিতে মেশার জোগাড়। কে না জানে শিকড় উপড়ে নিয়ে গাছকে অন্য মাটিতে বসানো কোনও কাজের কথা নয়। মাটিতে থেকে তুলে নিয়ে বটগাছকে টবে বসিয়ে যতই যত্ন করা হোক না কেন সে ঝুরি সহ বামন গাছ হবে। বটগাছ নয়। তেমনই মাতৃভাষা থেকে মুখ সরিয়ে থাকলে বাইরে সব স্বাভাবিক কিন্তু অন্তরে ক্ষয়ক্ষতি প্রকট হবে। ১৯১৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তৎকালীন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতিকল্পের জন্য লিডস্ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মাইকেল স্যাডলারকে বলেছিলেন, ‘শিক্ষার উন্নতি করতে হলে সর্বাগ্রে চাই প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মাতৃভাষা আর দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে শেখাতে হবে ইংরাজী।’
ভাষা— যার সেতুবন্ধ হওয়ার কথা ছিল, তাকে আমরা করে তুললাম পাঁচিল। সাতচল্লিশ, বাহান্ন, একাত্তর... একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসপর্ব আমাদের সুযোগ দিয়েছিল বাংলা ভাষাকে তার আঞ্চলিক ও প্রামাণ্য-সহ সকল রূপকে মেলানোর, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির বহুস্তরী অন্তররূপটিকে দেখার, বোঝার। আমরা সে সুযোগ নিতে পারিনি। বরং ‘এক ভাষা, এক প্রাণ’ বলে প্রত্যেক একুশে ফেব্রুয়ারিতে শুধু উৎসবেই মেতে থাকি। আজ আমাদেরও আত্মসমীক্ষা করার সময় এসেছে।
 
20h 20m ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বিশেষ কোনও কর্মের আর্থিক সংস্থান নিয়ে মানসিক চিন্তা বৃদ্ধি পাবে। আর্থিক ঝুঁকি নেবার আগে দুবার...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার ৮৫.৮৩ টাকা ৮৭.৫৭ টাকা
পাউন্ড ১০৭.৩৭ টাকা ১১১.১৪ টাকা
ইউরো ৮৮.৭৮ টাকা ৯২.১৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা