বঞ্চনা। অবহেলা। উপেক্ষা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। এসব কারণের উল্লেখ করে বহুবার নানা সমালোচনা করা হয়েছে। সুতরাং এই একই অভিযোগে আবার সরব হওয়ার সত্যিই অর্থ হয় না। কিন্তু একটানা এগারো বছর ধরে লাগাতার একই প্যাটার্ন দেখার পর বঙ্গবাসীর মধ্যে একটি বিস্ময়কর প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। প্রশ্নটি হল, বাংলাকে এভাবে এগারো বছর ধরে ১৩ টি বাজেটে ক্রমাগত নিয়ম করে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে বঞ্চনার ইতিহাসের রেকর্ড সৃষ্টি করে যাওয়া কীভাবে সম্ভব হল? আমাদের সিরিয়াসলি জানতে ইচ্ছা করছে যে, এই সুপরিকল্পিত উপেক্ষা ও বঞ্চনার পিছনে প্রকৃত রহস্য ঠিক কী? কেন করা হচ্ছে? বাংলা এগারো বছর ধরে বারংবার প্রত্যাখ্যান করছে রাজনৈতিকভাবে, সেই কারণে বাঙালিকে কিছু না দিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি, এটা তো সরলীকৃত একটি বিশ্লেষণ! এই মনোভাব কমবেশি সকলের মনে এসেছে। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে এটাই একমাত্র নয়। আরও যেন বৃহত্তর কোনও পরিকল্পনা কাজ করছে। পরিকল্পনা? নাকি চক্রান্ত? এটা কি স্লো পয়জনিং ফর্মুলা? অর্থাৎ আর্থিকভাবে বঞ্চিত করে করে সম্পূর্ণ পঙ্গু করে দাও এই রাজ্যকে? তারপর আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে? অথবা যতদিন না আমাদের ভোটে জয়ী করে সরকার গঠন করতে দিচ্ছে, ততদিন এই রাজ্যকে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনও সহায়তা করা হবে না?
২০১৪ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৩টি বাজেট তথা ভোট অন অ্যাকাউন্ট হয়েছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের আমলে। পৃথকভাবে বাংলার নাম উচ্চারণ করে, বাংলার জন্য বিশেষ এক অথবা একাধিক প্রকল্প, কারখানা, স্কিম, পরিকাঠামো, এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন এয়ারপোর্ট, নতুন বন্দর, কর্মসংস্থানমুখী কোনও একটি প্রোজেক্ট, বড়সড় লগ্নি, শিল্প করিডর, শিল্পতালুক…কিছুই হয়নি। কোনও বছরের বাজেটে বাংলা আজ পর্যন্ত এই তালিকাভুক্ত স্কিমের একটিও পায়নি। অথচ বাকি সব রাজ্য পেয়েছে। কিছু না কিছু জুটেছে বিরোধী শাসিত অন্য রাজ্যে। অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ব্যতিক্রম বাংলা।
মোদি সরকারের বাজেটে সম্পূর্ণ নিয়ম করে এভাবে বাংলাকে বঞ্চনা করে চলাকে রহস্য বলছি কেন? সত্যিই এই আচরণের কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। এই সিদ্ধান্তের পিছনে মোদি সরকারের মনস্তত্ত্ব কী? সেটার কোনও আঁচ পাওয়া যাচ্ছে না। বিজেপি মহাশক্তিশালী একটি জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক দল। তার সর্বোচ্চ নেতৃত্ব নরেন্দ্র মোদিও অবশ্যই মহাশক্তিধর। তিনি অত্যন্ত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। দশ বছর ধরে লক্ষ্য করার পর তিনি অনেক আগেই বুঝে গিয়েছেন বঙ্গবিজেপির সংগঠন দুর্বল। সর্বজনগ্রাহ্য নেতা ও সেনাপতি হয়ে ওঠার মতো ব্যক্তিত্ব একজনও নেই। বরং একাধিক নেতা নিজেদের মধ্যেই ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে চরম মতান্তরে জড়িয়ে। বিজেপির সাধারণ কর্মীরা যে প্রবল হতাশ বঙ্গবিজেপির রকমসকম দেখে, সেটা নিয়েও সংশয় নেই। এই রাজ্য নেতৃত্বকে দিয়ে যে বাংলা দখল করা যাবে না এটা সকলেই কমবেশি বুঝে নিয়েছে।
কিন্তু রহস্যটা এই কারণেই আরও বেশি। সেটি হল, বিজেপি গোটা দেশের প্রতিটি রাজ্য দখল করতে চায়। যা স্বাভাবিক। যে কোনও জাতীয় দলই সেটা চাইবে। কিন্তু বিস্ময়কর হল, দশ বছর ক্ষমতাসীন থাকা বিজেপির পক্ষে বাংলা দখল করা রাজনৈতিক তথা সাংগঠনিক ভাবে কঠিন জেনেও উন্নয়ন অথবা আর্থিক সহায়তা কিংবা সরাসরি প্রভূত বাজেট পরিকল্পনা দিয়ে বাংলাকে খুশি করার চেষ্টা করতেই পারত! অথচ সেরকম করল না। কোনও উদ্যোগই দেখা গেল না কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে যে, কোনও একটি ভোটের আগে বাংলার জন্য কল্পতরু হয়ে গিয়ে বাজেটে অথবা বাজেট ছাড়াই প্রচুর উপহার দিয়ে বঙ্গবাসীর মন জয় করি! সেই চেষ্টায় কাজ হয় কি না সে তো পরের ব্যাপার। কিন্তু সেই প্রয়াস কিংবা সদিচ্ছাই দেখা গেল না মোদি সরকারের পক্ষ থেকে? কেন? কারণ কী? ওটাই তো সহজ পথ হওয়ার কথা ছিল। এই তো বিহারে ভোট ২০২৫ সালের শেষার্ধে। বিহারকে দু তিন বছর ধরেই অঢেল উপহার দেওয়া হচ্ছে। এরকম উপহার প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই দেওয়া হয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলা।
বাংলাকে কেন এভাবে বঞ্চনা করা হচ্ছে? এই অভিযোগ তুলে সংসদে তৃণমূলের এমপিরা আক্রমণ করছিলেন সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে। অর্থমন্ত্রী সেই আক্রমণের মোকাবিলা করে বাংলাকে এগারো বছর ধরে কেন্দ্র কী কী দিয়েছে, তার যে তালিকা বললেন, সেটা আরও বেশি করে যেন প্রমাণ করে দিল বিপুল বঞ্চনার অভিযোগের সত্যতাকে। বললেন, এইমস দেওয়া হয়েছে (যা ইউপিএ আমলেই অনুমোদিত হয়েছিল। রায়গঞ্জের বদলে কল্যাণীতে স্থানান্তর হয়েছে শুধু)। একটি কার্গো টার্মিনাল। একটি রাস্তাকে ফোর লেন করা হয়েছে। ১০১ রেলস্টেশনকে সংস্কার করা হয়েছে। ৯টি বন্দেভারত দেওয়া হয়েছে। এরকমই আরও কিছু।
১০ কোটি জনসংখ্যার একটি রাজ্য, যে রাজ্য জিএসটি প্রদানে প্রথম সারিতে। ধান সব্জি আলু ক্ষুদ্রশিল্প উৎপাদনে প্রথম অথবা দ্বিতীয় হয়, পণ্য রপ্তানিতে যথেষ্ট অগ্রগণ্য, কেন্দ্রকে বিপুল পরিমাণ ট্যাক্স তুলে দেয়, সেই রাজ্যের জন্য দশ বছরে কেন্দ্রীয় উন্নয়নের এই তালিকা? পাশাপাশি কর্ণাটক থেকে উত্তরপ্রদেশ। গুজরাত থেকে বিহার। অন্ধ্রপ্রদেশ অথবা রাজস্থানের দিকে তাকিয়ে দেখলে পার্থক্যটা চোখে পড়বে। নিছক বিরোধী শাসিত রাজ্য বলে বাংলাকে বঞ্চনা করা হচ্ছে, এরকম হলে তো বিরোধী শাসিত অন্য রাজ্যগুলির ক্ষেত্রেও একই কৌশল প্রযুক্ত হবে? সেটা তো হল না! আজ পর্যন্ত সব বাজেটেই বাংলার নামোল্লেখ অনুচ্চারিত। বাকি সব না হয় বাদ দেওয়া যাক। অন্তত মেট্রো রেল সম্প্রসারণকে তো বৈপ্লবিক গতিতে ত্বরান্বিত করা যেত?
নরেন্দ্র মোদি জানেন যে, তাঁর দলের বর্তমান রাজ্য শাখা এখনও যেভাবে রাজনীতি করে, সেটা দিয়ে বাংলাজয় সম্ভব নয়। শেষ চেষ্টা হিসেবে তাঁর তো উচিত ছিল বিপুল উন্নয়নে বাংলাকে ভাসিয়ে দেওয়া? তাঁর নামে বঙ্গবাসী ধন্য ধন্য করবে এটা তিনি চান না? অথচ কই তিনি তো সেরকম উদ্যোগ নিলেন না! বরং বাংলাকে বঞ্চনার রেকর্ড করেই চললেন। গোটা শাসনকালে। কেন? মোদি কি চান না বাংলা দখল করতে? তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই কিন্তু নিজের দলকে ডুবিয়ে চলেছেন। কেন?
বঙ্গবাসী এইসব অভিযোগে সঙ্গতভাবে সরব হবে। তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপিকে এই বঞ্চনার প্রশ্নগুলি তুলে অবশ্যই আক্রমণ করছে। সেসব স্বাভাবিক। তবে এখন এগারো বছর পর সময় এসেছে বঙ্গবিজেপির কাছে। বঙ্গবিজেপির নেতারা এবার চিন্তা করুন যে, তাঁদের এভাবে পথে বসাচ্ছেন কেন নরেন্দ্র মোদি? আগামী বছর ভোট। অথচ বাজেটে এগারো বছর ধরে বাংলাকে মোদি সরকার কিছুই প্রায় দিল না। আগামী বছরের বাজেটে না হয় তর্কের খাতিরে ধরা গেল কিছু উপহার দেওয়া হল। কিন্তু সেটা তো এগারো বছরের ক্ষতিপূরণ হতে পারে না। বঙ্গবিজেপি তাঁদের শীর্ষ নেতৃত্বকে সাহস নিয়ে প্রশ্ন করুক যে, বাংলাকে এভাবে বঞ্চনা করা হচ্ছে কেন? তাদের তো বলার মতো মুখই থাকছে না!
বাংলায় বিজেপির যথেষ্ট ভোটশেয়ার আছে। সিপিএমের ভোটব্যাঙ্ক যুক্ত হওয়ায় সেটি আরও জোরদার হয়েছে। সেইসব বিজেপি ভোটারের ভাগ্যেও বঞ্চনা, উপেক্ষা আর অবহেলাই জুটছে। তৃণমূল সমর্থকরা যেখানে রাজ্য সরকারের নানাবিধ প্রকল্প ও জনকল্যাণমুখী আর্থিক সাহায্যের কথা জোর গলায় বলে জয়ধ্বনি দিচ্ছে, তাদের পাল্টা বিজেপি সমর্থকদের মুখরক্ষার জন্য কিছু বলার মতো অস্ত্রই তো থাকছে না। যেন হারার লড়াই লড়ছেন বিজেপি সমর্থকরা। তাদের মুখ চেয়েও তো কেন্দ্রীয় সরকারের বাংলার উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত ছিল। কেন সেরকম হল না?
রহস্য টহস্য সম্ভবত কিছু নয়। রাজনীতি নয়। উপেক্ষা নয়। প্রতিহিংসাও নয়। প্রকৃতপক্ষে বাংলা ও বাঙালি জাতিকে সম্ভবত আর্থসামাজিকভাবে শায়েস্তা করার একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্র থেকে কোনও টাকা দেব না। যাতে আর্থিক সঙ্কটে পঙ্গু হয়ে যায় উন্নয়ন। আর পাশাপাশি ধর্মীয় উন্মাদনায় মদত দিয়ে একটি লাগাতার সামাজিক অস্থিরতা জিইয়ে রাখব। দুয়ে মিলে ক্রমেই পিছিয়ে যাক বাংলা! কী সেই গোপন মিশন? মিশন হল, সবথেকে অনগ্রসর রাজ্য হিসেবে পিছিয়ে দেওয়া বাঙালিকে! নচেৎ এগারো বছরের বাজেট বঞ্চনার অন্য কোনও কারণ হতেই পারে না!