বইমেলার প্রসঙ্গ উঠলে মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স-এর প্রয়াত কর্ণধার ইন্দ্রাণী রায় মিত্র শোনাতেন তাঁর দাদুর কথা। সেই কথাজুড়ে থাকত পাঠকের অনুভূতি। সাহিত্যিক গজেন্দ্রকুমার মিত্র তাঁকে বলতেন, ‘প্রত্যেক পাঠকের একটা নিজস্ব গল্প থাকে। বইমেলায় বহুদিন এক নাগাড়ে বসার সুবাদে আমি এরকম বহু গল্প দেখেছি। কী করে ভুলি পাইকপাড়া থেকে নিয়মিত বইমেলায় আসা মধ্যবয়স্কা মানুষটিকে। যিনি একটি অতি সাধারণ পোশাকে এসে এক একদিনে শুধু আমাদের বিপণি থেকেই পাঁচ-ছ হাজার টাকার বই কেনেন। শেষদিনে বিদায় নেবার আগে নিয়ম করে আমায় বলে যান, এ বছরের মতো আমার কেনাকাটা শেষ, আগামী বছর আবার দেখা হবে। না থাকতে পেরে আমি যখন তাঁকে শুধোই, বছরে আপনার বই কেনার বাজেট কত? তখন কিছুমাত্র না ভেবে সেই মানুষটি বলে ওঠেন দেড় থেকে দু’লাখ টাকা, তিন লাখও হয়ে যায় কোনও কোনও বছর। আমি তো দামী শাড়ি গয়না কিনি না, কিনি শুধু বই। কী করেই বা ভুলি সেই দম্পতিটিকে, যাঁরা দুধের শিশু কোলে নিয়ে সুদূর ব্যারাকপুর থেকে তিন চারদিনের ব্যবধানে পনেরো-ষোল হাজার টাকার বই কিনে ভারি ভারি ব্যাগ হাতে একগাল হাসি নিয়ে ফিরে যান নিজেদের বাড়ি...।’
আসলে কলকাতা বইমেলায় বই-পার্বণ আজ শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের চতুর্দশ পার্বণ। ১৯৭৬-এর ৩ মার্চ ৫৪টা স্টল নিয়ে বিড়লা তারামণ্ডলের উল্টোদিকে ছোট মাঠটায় যে বইমেলা শুরু হয়েছিল তার এই ৪৯ বছরের যাত্রাটা কেমন? তথ্য বলবে ক্রমশ ফুলতে থাকাই সেই যাত্রার চরিত্র। ৪৯ বছর ধরে বইমেলা মানে দৃশ্যটা একই। চারদিকে কাতারে কাতারে মানুষ। চলেছে যে যার গন্তব্যের দিকে। গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে অভীষ্ট স্টলের লাইনে। হাতে ম্যাপ। পাবলিশারদের ক্যাটালগ বা লিখে আনা বইয়ের উইশলিস্ট। মায়ের আঁচল ধরা খুদেদের চোখ তখন টিনটিন কিংবা নন্টে-ফন্টের দিকে। স্টলের গায়ে বুক উঁচিয়ে হাঁদা-ভোঁদা কিংবা বাঁটুলের কীর্তি। আর ফেমাস রথী মহারথীর সম্ভার। স্টলে স্টলে ম্যাজিক, ভেন্ট্রিলোক্যুইস্ট, বল ছুড়ুন প্রাইজ পান, টিপ করুন প্রাইজ পান। কোথাও লেখককে ঘিরে ফ্যান। কোথাও ফ্যানের সঙ্গে ফলোয়ার। এদিকে সুলেখা কালির সম্ভার তো ওদিকে ফ্রি গিফট বলে বিলোনো বাইবেল। তারই মধ্যেও আঁতাত আছে। মিছিল আছে। স্লোগান আছে। রাজনীতির কথা আছে। আর আছে বহুদিন পর দেখা হয়ে যাওয়া। অনেকের সঙ্গে প্রথম আন্তরিকতা। আছে বড় সেলেব লেখক নিয়ে হুটোপুটি। মেজ সেলেব লেখকদের সই সংগ্রহ। ছোট সেলেব লেখকদের কূটকাচালি। আর হাজার হাজার পাঠক। যেন এই পুণ্যভূমির ধুলো মেখে নেওয়ার শেষ সুযোগ। বইমেলা মানেই পাঠকের মুক্তাঞ্চল, বাঙালির স্বাধীন পৃথিবী। হয়তো তাই ‘থিম কান্ট্রি’ জার্মানির রাষ্ট্রদূত ফিলিপ আকারমান বলেছেন, বইমেলা ‘বাঙালি ঘরানার কুম্ভমেলা’। ঠিক তাই— ওখানে পুণ্য অর্জিত হয়, এখানে জ্ঞান।
এই জ্ঞান বিকোতেই প্রকাশকরা আজ হিমশিম। পাঠকের চাহিদা বুঝতে রীতিমতো গবেষণায় নামতে হয় তাঁদেরও। এক প্রকাশক তো বলেই ফেলেছিলেন, এই নতুন জগতের একটি বড় অংশ জেনারেশন-জি এবং ৪০-এর নীচের বয়সি মিলেনিয়ালদের বোঝাই কঠিন। তাঁদের চাহিদা, মনোজগৎ ছুঁতে গেলে
হয়তো সাহিত্যজগৎ থেকেই ছিটকে যেতে হবে। আসলে গত কয়েক বছরে ওটিটি মঞ্চে হাতে হাতে সিরিজ, সিনেমা দেখার চল বেড়েছে। মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্তের কাছে দু-তিনটে ওটিটির সাবস্ক্রিপশন আর টেলিগ্রামের হরেক চ্যানেলে পাওয়া বিভিন্ন সিরিজ, সিনেমা তো আছেই। প্রায় ৯০ শতাংশ সিরিজ, সিনেমার বিষয়বস্তু থ্রিলার— খুন, একের পর এক খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, ঘিনঘিনে অপরাধ, দাবাং পুলিস, ভূতুড়ে অভিশাপ ইত্যাদি। এর বাইরে আর কিছু নেই। সেই দর্শকরাই তো দলে দলে বইমেলায় আসছেন। বেড়ে যাওয়া থ্রিলার-খিদে আর স্ক্রুয়ের থেকেও প্যাঁচালো টুইস্টের পোঁচ লাগানো হরর-থ্রিলারের খিদের জোগান দিতে লেখক-প্রকাশক মুখিয়ে রয়েছেন। উপন্যাসের আখ্যান ধর্ম যেন ওটিটি-সিরিজের পর্ব ভাগ মেনে চলে এবং সম্ভাব্য অডিও-স্টোরির মারকাটারি ‘কন্টেন্ট’ হয়ে উঠতে পারে, লেখকও সেই ব্যাপারে খুবই সচেতন। কোনও কোনও স্টল তো সাজানোই হয় ভৌতিক পরিবেশের আঙ্গিকে। যাকে সবাই বলে ‘থিম’। এইসব বীভৎস হরর আর লোমখাড়া থ্রিলারে মোড়া বইমেলার সন্ধ্যায় শিহরন জাগে বইকি!
বইমেলা বাঙালিকে চেনার হাতছানিও। আশ্চর্য ভাষার মানুষ বাঙালি— যাঁরা যত ক্ষমতাশালী বা ধনীই হোন না কেন, যত বড় নেতা নেত্রী মন্ত্রী আমলা, যত বড় সাধক, গায়ক, নায়ক, বিজ্ঞানী, খেলোয়াড়ই হন, তাঁর লেখা যদি কোনও বই না থাকে বইমেলায়, তাঁর সমস্ত জীবন যেন এক লহমায় মনে হতেই পারে সম্পূর্ণ অর্থহীন। অনেকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন একদিন তিনি থাকবেন না, কিন্তু বইটি তো থেকে যাবে। ইহজীবনে সে বইয়ের সাফল্য জুটুক বা না জুটুক। লেখক জানেন, আজকের দুনিয়ায় কমেন্ট আর সেলফি আর সইমাখা বইয়ের ‘রিচ’ বেশি। এই ‘রিচ’ অতি বিষম বস্তু। ‘রিচ’ অর্থে সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকা বন্ধুতালিকার কতজনের কাছে নিজেকে বিজ্ঞাপিত করা গেল। বইমেলার ভিড়ে ‘রিচকামী’ হতে হয়, নইলে ভিড়ে হারিয়ে যেতে হয়।
‘বেস্টসেলার’ বইয়ে ছেয়ে যাওয়া বইমেলায় বিগত কয়েক বছরে ইতিহাস আর ধর্ম, ইতিহাস আর বিশ্বাসকে গোঁজামিলে চুবিয়ে পাঠক মগজে ঠুসে দেওয়ার চেষ্টাটা বেশ চোখে পড়ার মতো। ফেসবুকের বইয়ের গ্রুপগুলিতে ‘তান্ত্রিক থ্রিলার’, তন্ত্রকাহিনির চাহিদা-জোগানের বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। ‘তারানাথ তান্ত্রিক’-এর পাঠপ্রিয়তা বিগত কয়েক বছরে হঠাৎ পুনর্জাগরিত হয়েছে এবং কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের কয়েক শতাব্দী পুরনো ‘তন্ত্রসার’ খুঁচিয়ে তুলে বাংলা সাহিত্যকে গ্রাস করার চেষ্টা চলছে। নিষিদ্ধ ও গুপ্ত বস্তু/পদ্ধতির প্রতি সব বয়সের মানুষেরই আগ্রহ থাকে। তবে, ধর্মের সর্বগ্রাসী গতিপথ যখন রীতি-সংস্কৃতি-ইতিহাস-মিথ-সাহিত্য সবকিছুকেই গিলে নিতে চায়, তখন ওই আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। পাঠক ‘খায়’ বলে বাজারও ‘খায়’, আর প্রকাশকরাও তন্ত্র-গুণিন-ধর্ম-রোমাঞ্চ-মিথ্যে মিশিয়ে বই নিয়ে হাজির। গেরুয়া শিবিরের অনেক ল্যাজ-প্রতিষ্ঠান হিন্দুত্ববাদের পুনরুত্থানের জন্যে বিশ্বাস, গালগল্পের রসদ জুগিয়েই চলেছে। বিশ্বাসে কোনও প্রমাণ লাগে না, ধর্মীয় প্রচারে কোনও বিজ্ঞান খাটে না। গুজবে গুজবে ছড়িয়ে যায়, যদি তা উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে হয় তাহলে তো কথাই নেই। কারণ, উপন্যাসের বা ফিকশনের কিছু প্রমাণের দায় নেই। অথচ সংখ্যাগুরু মতামতকে উস্কে দেওয়া যায়।
আজ থেকে কুড়ি বছর আগেও লেখক-প্রতি যতজন পাঠক ছিল, সেই সমীকরণ আজ আর নেই, বরং ফাঁকটা এতটাই কমে গিয়েছে যে, পাঠক-লেখক অনুপাতটা প্রায় সমান-সমান হয়ে গিয়েছে। এতে একশ্রেণির প্রকাশকের হয়েছে মস্ত লাভ। প্রকাশকদের একাংশ বছরভর যতই শুকনো কথা শোনান না কেন, বইয়ের বাজার এক বিপুল সম্ভাবনার মুখে দাঁড়িয়ে। বইমেলায় পা রাখলেই তা টের পাওয়া যায়। একটা সাদামাটা হিসেব দিই— তিরিশ লক্ষ পাঠক যদি মাসে একশো টাকার ননটেক্সট-বই কেনেন তাহলে তা হয় মাসে তিরিশ কোটি। বছরে সাড়ে তিনশো কোটির উপর। এবং মাথায় রাখতে হবে এটি কিন্তু ব্যক্তিগত সংগ্রহ। এরপরে আছে ইনস্টিটিউশনাল সংগ্রহ। সেই অঙ্কটাও কম নয়। বছরের অন্তত দেড়শো কোটির উপর। মানে বাংলা ননটেক্সট বইবাজার কমপক্ষে বছরে পাঁচশো কোটির। পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালের বইমেলায় ২৫ লক্ষ মানুষ এসেছিলেন, ২০২৪-এর বইমেলায় তাঁর থেকে অনেক বেশি মানুষ এসেছেন। প্রায় ২৯ লক্ষের কাছাকাছি। এবং এই কয়েকদিনে মেলাপ্রাঙ্গণ থেকে বই বিক্রি হয়েছে প্রায় ২৭ কোটি টাকার। এ বছর নাকি সেই রেকর্ডও ভেঙে যাবে।
যতই এআইয়ের দাপট বাড়ুক না কেন, যতই বর্তমান প্রজন্ম কম্পিউটার গেমস বা অ্যাপস-এ মেতে থাকুক না কেন, তাঁরা বইও পড়ছেন— এটা প্রমাণিত সত্য। কারণ, বর্তমান প্রজন্ম যদি বই-এর জগতে প্রবেশ না করত তাহলে বইয়ের বিক্রি এই হারে বাড়ত না। বইমেলায় গিয়ে পেল্লায় সব লাইনে দাঁড়িয়ে বই উল্টেপাল্টে যারা দেখেনি, পাঁজরা ভরে নতুন বইয়ের গন্ধ যারা নেয়নি, মানিব্যাগ এমনকী স্যালারি অ্যাকাউন্ট অবধি ফাঁকা করে গুচ্ছের বই বাড়ি এনে যারা বৌয়ের বকুনি খায়নি, তারা আর যাই হোক, বাঙালি পদবাচ্য হতে পারে না।
বিমল মিত্রের সেই গল্পটা মনে পড়ে? ভাইঝির বিয়ে ঠিক করতে এক পণ্ডিতমশাই গিয়েছিলেন জমিদার বাড়িতে। তাঁর সব পছন্দ, তবু বিয়ে দিতে রাজি হলেন না। কারণ একটাই, এত বড় ঘর, এত বৈভব, কিন্তু ঘরে কোথাও বইয়ের চিহ্ন নেই। এটাই বাঙালির ইতিহাস। অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া, দেশভাগ, অনুন্নয়ন, একদা উদ্বাস্তু সমস্যাদীর্ণ বিপুল জনসংখ্যার ভারে আজও জর্জরিত একটা জাতি, তার শেষ সামর্থ্যটুকু নিংড়ে দিয়ে যেটুকু পেরেছে, সেটুকুও কম বড় অর্জন বলা যায় না। হয়তো তাই বইমেলা আজ হয়ে উঠেছে বঙ্গের জাতীয় উৎসব। বইমেলা বাঙালিকে হাতছানি দেয়, এই সর্বব্যাপ্ত অবক্ষয়ের যুগে আজও স্বপ্ন দেখায়।