বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ

যোগীর অপদার্থতা বিরলের মধ্যে বিরলতম
সন্দীপন বিশ্বাস

অমৃতের সন্ধানে গিয়ে জুটল গরলের স্বাদ! তার জন্য ধর্ম দায়ী নয়। আধ্যাত্মিকতার পরশ পেতে গিয়ে মিলল মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ! তার জন্যও ধর্ম দায়ী নয়। দায়ী ধর্মোন্মাদনার জিগির। দায়ী যাঁরা ধর্মকে কেন্দ্র করে সারা দেশজুড়ে রাজনীতি করছেন, ধর্ম নিয়ে ব্যবসা ফেঁদেছেন। এই ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিকরাই আজ ভারতকে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে চলেছেন। ভারতে তাঁরা এক অস্থির, অন্ধকার যুগ আনতে চাইছেন। ভারতাত্মার শুচিতা এঁরা দিনকে দিন নষ্ট করে দিচ্ছেন। কুম্ভমেলার আগে মুখ্যমন্ত্রী যোগীবাবু বুক বাজিয়ে বলেছিলেন, ‘কুম্ভে আসবেন ৪০ কোটি মানুষ। আমরা কিন্তু একশো কোটি মানুষের জন্য আয়োজন করেছি।’ এ যে মূঢ়তার কত বড় আস্ফালন, তা বুঝিয়ে দিয়ে গেল কুম্ভে পদপিষ্ট হয়ে শত শত মানুষের মৃত্যুর ঘটনা। অথচ দেখা গেল কী দেশের সরকার, কী উত্তরপ্রদেশের সরকার, কারও কোনও এ নিয়ে তেমন উৎকণ্ঠা নেই! এই অমানবিকতা, এই হৃদয়হীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দেশের মানুষ। যাঁরা প্রশ্ন করছেন, যাঁরা কাঁদছেন, যাঁরা রাগে রগরগ করছেন, তাঁরা কিন্তু সকলেই হিন্দু। আর এই চরম মুহূর্তে ‘পলায়নই শ্রেষ্ঠ ধর্ম’ বলে মনে করছেন হিন্দুধর্মের স্বঘোষিত মসিহারা। সুতরাং ধিক্কার জানানোর ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন শোকতপ্ত মানুষ।  
সাত-আট কোটি মানুষের জমায়েত সুষ্ঠুভাবে সরকার করতে পারল না। অথচ এমন কুৎসিত ব্যবস্থা নিয়ে মুখে কুলুপ আঁটলেন যোগী, যেন কিছুই হয়নি। আট-দশ ঘণ্টার মধ্যে শত শত লাশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ। কিন্তু ঠিক কতজন ধর্মের বলি হলেন? সেটা তো সরকারকে বলতে হবে। যে সরকার প্রতি মুহূর্তে কুম্ভে জনসমাগমের ফিরিস্তি দিচ্ছিল, তারাই মৃতের সংখ্যা ঘোষণা করতে একের পর এক মিটিং করেছে, কী সাফাই দেওয়া যায় তাই নিয়ে শলা করেছে। অবশেষে প্রায় বারো ঘণ্টা পর তিরিশ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হয়। 
কেন মৃত্যু? কেন এই অব্যবস্থা? তাই নিয়ে অবশ্য রয়েছে সত্যকে এড়িয়ে নানা ধরনের সাফাই। কুম্ভে উপস্থিত ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, পয়সাওয়ালা পুণ্যার্থীদের থেকে মোটা মোটা টাকা নিয়ে পুলিস প্রশাসন তাদের ভিআইপি সাজিয়ে আগে স্নানে পাঠাচ্ছে। আর তখন সাধারণ মানুষের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। জনজোয়ার রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এক সময় তা আছড়ে পড়ে পিষ্ট করে দিয়ে যায় শত শত মানুষকে। এরকম ঘটনায় বারবার প্রমাণিত, এঁরা বুক বাজিয়ে ‘হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা’ বলেন, কিন্তু বিপদের সময় ঘরে সেঁদিয়ে যান। বাইরে এসে সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার মতো দৃঢ়তা এঁদের মধ্যে দেখা যায় না। বিপদের দিনে মানুষ চেনা যায়। এই অভিজ্ঞতা দেশের মানুষের আছে। ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় ঠিক কী ঘটেছিল, মোদি সরকার আজও তার জবাব দিতে পারেনি। কোভিডকালে কতজন মারা গিয়েছেন? এখনও তা নিয়ে মোদি সরকারের মুখে কুলুপ। নোটবন্দি করে দেশের মানুষের কতটুকু উপকার হল? তারও জবাব মেলেনি। নির্বাচনী বন্ড নিয়েও কোনও উত্তর শোনা যায়নি। পুরোটাই চলছে জুমলাবাজি দিয়ে। মোদির যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে চুপ করে থাকার ধর্ম পালন করে চলেছেন যোগী আদিত্যনাথও। তিনি আবার স্বপ্ন দেখছেন, মোদির পর তাঁর কুর্সি দখল করবেন। কুম্ভমেলায় পুণ্যার্থীরা বলছেন, গোরু নিয়ে যোগীর যেটুকু মমত্ব, তা যদি মৃত ধর্মপ্রাণ মানুষগুলির প্রতি দেখাতেন, তাহলে তাঁদের এই দুর্দশা হতো না।   
সরকার তথ্য চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। প্রয়াগে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে যোগী সরকারের অপদার্থতায় পদপিষ্ট হয়ে অন্তত দুশো মানুষের মৃত্যুর খবর। এছাড়া দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ নিখোঁজ। মেলায়, হাসপাতালে, মর্গের সামনে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। ছবি হাতে তাঁরা তাঁদের নিখোঁজ আত্মীয়স্বজনদের খুঁজে চলেছেন। একদিন আশা ছেড়ে তাঁরা সকলেই যে যাঁর বাড়ি ফিরে যাবেন। পিছনে ফেলে রেখে যাবেন এক ডরপুক সরকারের বিরুদ্ধে চরম ঘৃণা ও অভিশাপ। 
হ্যাঁ, ডরপুক সরকার। যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের অনেকের আত্মীয়কেই মুচলেকায় সই করিয়ে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। পোস্টমর্টেম করা হয়নি, ডেথ সার্টিফিকেটও মেলেনি। কুম্ভে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা চাপা দিতে কী নির্মম, নিষ্ঠুর প্রয়াস। ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের কী চমৎকার পদক্ষেপ! মোদির মতো যোগী সরকারও বারবার তথ্য চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ২০১৭ সালে ২ সেপ্টেম্বর সেই নির্মম ঘটনার কথা মানুষ ভুলে যাননি। গোরক্ষপুরের শিশু হাসপাতালে একদিনে ৬৩ জন সদ্যোজাত শিশুর মৃত্যু হয়েছিল যোগী সরকারের অপদার্থতায়। হাসপাতালে অক্সিজেন সাপ্লাইকারী সংস্থা দীর্ঘদিন তাদের বকেয়া টাকা পায়নি। সেই টাকার পরিমাণ ছিল ৬৮ লক্ষ টাকা। সেই ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে যোগীর ভূমিকা যথার্থ ছিল না। তাঁর ভূমিকা যথার্থ ছিল না হাতরাসে দলিত ধর্ষণের ঘটনায়, উন্নাওয়ের ঘটনাতেও। এমনকী অযোধ্যার মতো তীর্থস্থানে নৃশংসভাবে দলিত কন্যাকে ধর্ষণ করার ঘটনাতেও তিনি গা বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। 
কুম্ভে স্নান খুবই পবিত্র এক স্নান বলে ধর্মীয় মানুষের বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের আর অবশিষ্ট রইল কোথায়? কুম্ভ হয়ে উঠল মৃত্যুপুরী! কয়েকজন বলে বসলেন, ‘কুম্ভে এসে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের মোক্ষলাভ হল’। কী নির্মম, জঘন্য এবং মৌলবাদী যুক্তি। যাঁরা এমন অশিক্ষিতের মতো কথা বলছেন, তাঁরা নিজেরাই তো মানুষের পায়ের তলায় গড়াগড়ি দিয়ে মৃত্যবরণ করে সস্তায় মোক্ষলাভের ভিসা জোগাড় করতে পারেন। হায়রে ধর্ম! আসলে সব ধর্মের মৌলবাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এই নির্বুদ্ধিতা। 
অথচ এই প্রয়াগ, এই সঙ্গম কত পবিত্র স্থান। আমাদের দেশে প্রাচীন কাল থেকে এই জায়গাটিকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মেনে আসা হচ্ছে। পুরাণে কিংবা ইতিহাসে বারবার এসেছে প্রয়াগ প্রসঙ্গ। সমুদ্র মন্থনে উদ্ভুত অমৃত নিয়ে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে বারোদিন ধরে লড়াই চলে। বিষ্ণু মোহিনীরূপ ধারণ করে সেই অমৃত নিয়ে পালানোর সময় অমৃতকুম্ভ থেকে চার ফোঁটা অমৃত পৃথিবীর চার জায়গায় পড়েছিল। এই স্থানগুলি হল প্রয়াগ, হরিদ্বার, উজ্জয়িনী ও নাসিক। মনে করা হয়, আদিগুরু শঙ্করাচার্য পুরাণের সেই কাহিনিকে স্মরণ করে কুম্ভমেলার প্রচলন করেন। ঋগ্বেদে প্রয়াগের উল্লেখ আছে। তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’-এ প্রয়াগের কথা পাওয়া যায়। 
শুধু পুরাণ নয়, ইতিহাসেও প্রয়াগের কথা বারবার এসেছে। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং লিখে গিয়েছেন প্রয়াগে রাজা হর্ষবর্ধনের দান-ধ্যানের কথা। ‘আইনি আকবরি’তে প্রয়াগকে বলা হয়েছে ‘হিন্দুদের তীর্থস্থানের রাজা’।  এছাড়া কামা ম্যাকলিন, জেমস লোৎসফেল্ড সহ বেশ কয়েকজন বিদেশি প্রয়াগ ও কুম্ভ নিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা লিখে গিয়েছেন। ইতিহাসের পরিক্রমণে এই পথে  গিয়েছেন বুদ্ধদেব, মেগাস্থিনিস, ফা হিয়েন, সমুদ্রগুপ্ত, মুঘল বাহিনী। এক সময় এই প্রয়াগের নাম ছিল বৎসদেশ। তার রাজধানী ছিল কৌশাম্বী। পরে আকবর এই শহরের নাম দিলে ইলাহাবাস। শাহজাহান এসে সেটা বদলে রাখেন ইলাহাবাদ। ১৮৯৫ সালে মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েনও এসেছিলেন কুম্ভমেলায়। কিন্তু সেই কুম্ভের সঙ্গে এই কুম্ভের পার্থক্য অনেক। যোগীজি ধর্মের সাইনবোর্ডের আড়ালে কুম্ভকে করে তুলেছেন কর্পোরেট কুম্ভ। যেখান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার মুনাফা তুলবে সরকার।
কুম্ভে দুর্ঘটনা কিন্তু এই প্রথম নয়। এর আগেও হয়েছে। বহু মানুষ মারা গিয়েছেন। নিখোঁজ হয়েছেন। কিন্তু এর আগে কোনও সরকার ডরপুকের মতো সব তথ্য ছুপিয়ে ফেলার নির্মম মানসিকতা দেখায়নি। ১৯৫৪ সালে সমরেশ বসু কুম্ভমেলায় গিয়েছিলেন। তাই নিয়ে তাঁর ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ উপন্যাসটি। সে বছর বিরাট দুর্ঘটনা হয়েছিল কুম্ভে। তিনি লিখেছেন, ‘চারিদিকে শুধু মৃতদেহের স্তূপ। তাকে ঘিরে রয়েছে পুলিসবাহিনী। অপরিচিত নারী ও পুরুষ কণ্ঠলগ্ন হয়ে পিষে মরেছে। শিশু চেপটে লেপটে রয়েছে মায়ের বুকে।... কিন্তু সেই স্তূপে সাধু একটিও নেই। পুলিসের কর্ডন ভেঙে মানুষ ছুটে আসতে চাইছে। খুঁজছে। বউ-মা, বাপ-ছেলে, আত্মীয়-বন্ধু, সবাইকে খুঁজছে, ডাকছে, পায়ে পড়ছে পুলিসের। একজন চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘সব মাতাল সাধুরা এদের খুন করেছে। রাজপুরুষ থেকে শুরু করে সকলের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও ক্রোধ বাড়ছে।’ সত্তর বছর আগের সেই ছবিই যেন অন্যভাবে এবার ফিরে এল।  
আজ অসংখ্য অভিযোগে বিদ্ধ যোগী। তিনি একজন গেরুয়াধারী মুখ্যমন্ত্রী। তাই রাজধর্ম পালন এবং গেরুয়া বসনের মর্যাদা রক্ষা করাই তাঁর প্রধান ধর্ম হওয়া উচিত। কুম্ভমেলা ঘিরে যে হাইপ তিনি নিজেই তুলেছিলেন, তাঁর সেই অহমিকার বেলুন শত শত মৃত্যু এসে ফাটিয়ে দিয়ে গিয়েছে। কুম্ভে উন্মোচিত তাঁর ব্যর্থতা। শত শত পুণ্যার্থীর অশ্রুজলে লেখা থাকবে, যোগীর অপদার্থতা বিরলের মধ্যে বিরলতম।
5d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কাজকর্মে সাফল্য ও খ্যাতি লাভের যোগ। ব্যবসা ভালো হবে। হস্তশিল্পীদের উপার্জন বৃদ্ধি পাবে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৬.৬৩ টাকা৮৮.৩৭ টাকা
পাউন্ড১০৬.৯২ টাকা১১০.৬৭ টাকা
ইউরো৮৯.১৭ টাকা৯২.৫৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
9th     February,   2025
দিন পঞ্জিকা