একেই বোধহয় বলে ‘পোয়েটিক জাস্টিস’! ১৪১ বছর মানুষের জীবনের হিসেবে লম্বা সময় হলেও ইতিহাসের হিসেবে তা সামান্যই। এই প্রায় দেড় শতকে গঙ্গার জল আরও মলিন হয়েছে। বহু পাপের পলি জমেছে মোহানায়। তেমনই একটা পাপ করা হয়েছিল ১৪১ বছর আগে— ১৮৮৩ সালের ২১ জুলাই। এত বছর বাদে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হল, এই সেদিন। বাংলার শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান মানুষের করা সেই পাপের বলি হয়েছিল এক সরলমতি নারীর আবেগ। বঞ্চিত সেই নারীর অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করলেন আর এক নারী। প্রথমজন বিনোদিনী দাসী, আর অপরজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কী পাপ ঘটেছিল সেদিন? নটী বিনোদিনী তখন বাংলার তথা ভারতের থিয়েটারের ‘সেলিব্রেটি’ নাম। গিরিশ ঘোষের পরিচালনায় ন্যাশনাল থিয়েটারে একের পর এক জনপ্রিয় নাটকে অভিনয় করে প্রশংসিত হচ্ছেন তিনি। ‘ইংলিশম্যান’, ‘স্টেটসম্যান’-এর মতো ইংরেজি কাগজ থেকে শুরু করে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত বিনোদিনীর অভিনয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যেসব গোঁড়া বাঙালিবাবু থিয়েটারের নামে নাক সিঁটকোতেন, তাঁরাও বিনোদিনীর টানে ভিড় করছেন থিয়েটার হলে। ন্যাশনালের মালিক ছিলেন প্রতাপচাঁদ জহুরি। থিয়েটার যখন রমরমিয়ে চলছে তখনই গিরিশ ঘোষের সঙ্গে বিরোধ বাধল প্রতাপের। মূলত অভিনেতা অভিনেত্রীদের মাইনে এবং সুযোগ সুবিধে নিয়েই বিরোধের সূত্রপাত। একবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় বিনোদিনী প্রায় দু’ মাসের বেশি ছুটি নিয়েছিলেন। সেই সময়ের মাইনে বিনোদিনীকে দিতে অস্বীকার করলেন প্রতাপচাঁদ। আগুনে ঘৃতাহুতি হল। গিরিশ, বিনোদিনী সহ প্রায় সমস্ত অভিনেতা অভিনেত্রী ন্যাশনাল থিয়েটার ছেড়ে দিলেন। কিন্তু ন্যাশনাল ছেড়ে তাঁরা থিয়েটার করবেন কোথায়? কিছুদিন ‘ক্যালকাটা স্টার কোম্পানি’ নাম দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটারের মঞ্চে অভিনয় করলেন। কিন্তু নিজস্ব একটি মঞ্চের অভাব প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছিলেন তাঁরা। এই সময়ে আসরে নামলেন বিনোদিনীর এক ‘ফ্যান’— রাজস্থানী ব্যবসায়ীর ছেলে গুর্মুখ রায়। তিনি থিয়েটারে টাকা ঢালতে এগিয়ে এলেন। কিন্তু শর্ত একটাই, বিনোদিনীকে তাঁর রক্ষিতা হতে হবে।
কোনও বারবণিতার কাছে এ হয়তো খুব সহজ শর্ত। কিন্তু বিনোদিনীর সঙ্গে আর পাঁচজনের ফারাক ছিল অনেকটাই। কিছুদিন আগেই তাঁর আগের বাবু বিয়ে করে বিনোদিনীকে বিদায় দিয়েছেন। এই অবস্থায় আর কোনও সম্পর্কে জড়াতে মন থেকে সায় পাচ্ছিলেন না তিনি। কিন্তু গিরিশের কথা তাঁর কাছে বেদবাক্য। আর তাছাড়া গিরিশেরই শিক্ষায় বিনোদিনী তখন থিয়েটার নিয়ে উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছেন। থিয়েটারই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। কাজেই শেষ অবধি গুর্মুখের শর্তে রাজি না হয়ে থাকতে পারলেন না বিনোদিনী। গুর্মুখের মূল লক্ষ্য ছিল যেনতেন প্রকারে বিনোদিনীর সঙ্গলাভ। তাই তিনি বিনোদিনীকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে বলেছিলেন, থিয়েটার ছাড়ো। এই টাকা তুমি নিয়ে আমার সঙ্গে চল। অন্য কেউ হলে কী করতেন জানা নেই। কিন্তু বিনোদিনী বলেছিলেন, থিয়েটার না করলে আমি তোমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারব না। মনে রাখতে হবে, ১৮৮৩ সালে ৫০ হাজার টাকার মূল্য আজকের প্রায় ৫ কোটির সমান। কিন্তু থিয়েটারের টানে সেই টাকার লোভ উপেক্ষা করেছিলেন বিনোদিনী। ৬৮ নম্বর বিডন স্ট্রিটের কীর্তিচন্দ্র মিত্রের জমি লিজ নিয়ে যখন নতুন থিয়েটার গড়ার কাজ চলছে তখন দলের অনেকেই বলেছিলেন যে, এই থিয়েটারের সঙ্গে বিনোদিনীর নাম যুক্ত হবে। বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনীমূলক লেখা ‘আমার কথা’-এ লিখেছেন— ‘সকলে আমায় বলেন, এই যে থিয়েটার হাউস হইবে, ইহার তোমার নামের সহিত যোগ থাকিবে। তাহা হইলে তোমার মৃত্যুর পরও তোমার নামটি বজায় থাকিবে।’ অর্থাৎ এই থিয়েটারের নাম ‘বি’ থিয়েটার হইবে। ‘এই আনন্দে আরও উৎসাহিত হইয়াছিলাম। কিন্তু কার্যকালে উঁহারা সে কথা রাখেন নাই কেন—তাহা জানি না! যে পর্যন্ত থিয়েটার প্রস্তুত হইয়া রেজেস্ট্রি না হইয়াছিল, সে পর্যন্ত আমি জানিতাম যে আমারই নামে ‘নাম’ হইবে! কিন্তু যেদিন উঁহারা রেজেস্ট্রি করিয়া আসিলেন—তখন সব হইয়া গিয়াছে, থিয়েটার খুলিবার সপ্তাহখানেক বাকী, আমি তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করিলাম যে থিয়েটারের নূতন নাম কি হইল? দাসুবাবু প্রফুল্লভাবে কহিলেন যে ‘ষ্টার’। এই কথা শুনিয়া আমি হৃদয়মধ্যে অতিশয় আঘাত পাইয়া বসিয়া যাইলাম যে দুই মিনিটকাল কথা কহিতে পারিলাম না। কিছুপরে আত্মসংবরণ করিয়া কহিলাম ‘বেশ’।’
সোজা কথায় গিরিশবাবুরা গুর্মুখ রায় নামক বড় মাছটিকে বঁড়শিতে গাঁথতে নিছকই টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন বিনোদিনীকে। ১৮৮৩ সালের ২১ জুলাই ‘বি’ থিয়েটারের বদলে নবনির্মিত থিয়েটারের নামকরণ হয়েছিল ‘ষ্টার থিয়েটার’। কিন্তু পাপ শুধু এটুকুই নয়। কয়েক বছর বাদে ব্যক্তিগত নানা কারণে থিয়েটার নিয়ে আর আগ্রহ রইল না গুর্মুখের। তিনি চাইলেন থিয়েটারের স্বত্ব ছেড়ে দিতে। তবে বিনোদিনীর প্রতি তাঁর টান ঠিকই ছিল। তাই শর্ত দিলেন, স্টার থিয়েটারের অর্ধেক স্বত্ব দেবেন বিনোদিনীকে। কিন্তু সেই প্রস্তাবেও জল ঢেলেছিলেন গিরিশবাবুরা। স্বয়ং গিরিশ ঘোষ গিয়ে বিনোদিনীর মাকে বোঝালেন, তোমরা মেয়েছেলে, আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের দিকে হাত বাড়িয়ে লাভ নেই। বিনোদিনীর মায়ের কাছে গিরিশ ঘোষ ছিলেন ভগবানের মতো। কাজেই সে যাত্রায়ও বিনোদিনীর আশা পূর্ণ হল না। এরপর আর মাত্র বছর তিনেক থিয়েটার করেছিলেন বিনোদিনী। মাত্র ২২-২৩ বছর বয়সে ভগ্ন হৃদয়ে থিয়েটারকে বিদায় জানান। সেদিন গিরিশবাবুদের সামনে বাধার পাঁচিল তুলেছিল রক্ষণশীল সমাজ। এক বারবণিতার নামে থিয়েটারের নামকরণ হলে দর্শক আসবে তো নাটক দেখতে? এই প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। সমাজের বিরুদ্ধে লড়ার সাহস দেখাতে পারেননি তাঁরা।
কিন্তু সে তো দেড়শো বছর আগের সমাজ। তারপর দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছি। তারপরও তো কই কোনও সরকার, বিদ্বজ্জনরা কেউ দাবি করেননি যে, বিনোদিনীর নামে একটা থিয়েটার হল করা হোক। কংগ্রেস সরকার, বাম সরকার কারও তরফে এমন কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। এমনকী বাম সরকারের সংস্কৃতিবান মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যেরও এনিয়ে কোনও হেলদোল কেউ দেখেছেন বলে মনে করতে পারবেন না। তিনি হয়তো মার্কেজ, লোরকা আর চমস্কির বৃত্তের বাইরে বেরতে পারেননি। কিন্তু কী করছিলেন আমাদের প্রগতিশীল গ্রুপ থিয়েটারের মানুষরা? কী করছিল ভারতের ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’ কলকাতার নাগরিকরা? নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে এত আন্দোলন, এত হইচই অথচ বিনোদিনীকে নিয়ে কেউ তো টুঁ শব্দটি করেননি। ব্যতিক্রম ‘বিনোদিনী অপেরা’ নামে একটি নাটক। সেই নাটকের একটি দৃশ্যে দাবি উঠেছিল, বিনোদিনীর নামে একটি মঞ্চ গড়ে তোলা হোক।
বিনোদিনী হয়তো জানলেন না, কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী রইল এক বঞ্চিত নারীর অপূর্ণ সাধ পূর্ণ করলেন আর এক নারী— পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি স্টার থিয়েটারের নাম পরিবর্তন করে করলেন বিনোদিনীর নামে। আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও তো কম সইতে হয়নি। হাজরা মোড়ে ফেলে পেটানো থেকে শুরু করে রাইটার্স বিল্ডিং থেকে হিড়হিড় করে টেনে বের করে দেওয়া। কী না ঘটেছে তাঁর সঙ্গে। একের পর এক বাউন্সার ধেয়ে এসেছে তাঁর দিকে। গায়ে, মাথায় আঘাত পেয়েছেন, শরীর রক্তাক্ত হয়েছে। তবু ক্রিজ ছেড়ে নড়েননি। ঠিকঠাক বল পেলে হুক করে মাঠের বাইরে পাঠিয়েছেন। বহু লড়াইয়ের পর অবশেষে ৩৪ বছরের জগদ্দল পাথরটাকে সরিয়েছেন। শুধু যে সরিয়েছেন তা-ই নয়, একেবারে গুঁড়িয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছেন। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিনোদিনীর হৃদয়ের ব্যথা বুঝবেন না তো আর কে বুঝবেন। ধন্যবাদ প্রাপ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
তবে শুধু স্টার থিয়েটারের নাম বদল করে বিনোদিনীর নামে করলেই বোধহয় নটীর অপূর্ণ সাধ পূরণ হবে না। স্টার থিয়েটারে ইদানীং আর থিয়েটার হয় না। সেটি পুরোপুরি সিনেমা হল হয়ে গিয়েছে। অবিলম্বে সেখানে নাটকের শো চালু করতে হবে। তবেই নটীর আবেগের প্রতি যথাযোগ্য শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে। অন্তত রাজ্যের নাট্যমোদী জনতার দাবি তাই।