বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ

উপেক্ষিত কণ্ঠস্বর
পি চিদম্বরম

যতদূর আমি মনে করতে পারি, এতখানি রাজনৈতিকভাবে প্ররোচিত বাজেট এর আগে হয়নি। এমন কোনও বাজেটও এর আগে হয়নি যা অর্থনৈতিক সংস্কার ও পুনর্গঠনের সুযোগ কাজে লাগাতে এতখানি ব্যর্থ হয়েছে। দেশের অর্থনীতির সময়োপযোগী সংস্কার ও পুনর্গঠনের জন্য দেশবাসী প্রস্তুত ছিল কিন্তু সরকার তাদের হতাশ করেছে।
১৯৯১-এর প্রতিচ্ছবি ২০২৫-এ
২০২৪ সালের পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা যাক। ভোটাররা বিজেপিকে তৃতীয়বারের জন্য কেন্দ্রে ক্ষমতায় পাঠিয়েছে, তবে সঙ্গে দিয়ে রেখেছে একটি হুঁশিয়ারি। সরকার গঠনের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যা তোমার থাকবে কিন্তু তার ভিতরে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে না। সংবিধান পাল্টে ফেলার চেষ্টা তুমি করবেন না। তোমাকে শাসনকার্য পরিচালনা করতে হবে ঐকমত্যের ভিত্তিতে। তুমি বেকারত্ব, দারিদ্র্য, বৈষম্য, মুদ্রাস্ফীতি ও কৃষকদের দুর্দশা দূর করবে। যেখানে পরিকাঠামো নেই সেখানে তা গড়ে দেবে এবং যেখানে তা ভেঙে পড়েছে, সেখানে তার পুনর্নির্মাণ করতে হবে তোমাকে। অর্থাৎ মূল সমস্যাগুলির সমাধান তোমাকে একে একে করে যেতে হবে। এটা অবিকল ১৯৯১ সালের পরিস্থিতি—নরসিমা রাও-মনমোহন সিংরা তো এমনই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন। কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী-বিদেশমন্ত্রী জুটি সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছিলেন। তাঁরা ঘোষণা করেছিলেন যুগান্তকারী সংস্কার কর্মযজ্ঞের, যার সূচনা হয় ১৯৯১ সালের ১ জুলাই এবং সংস্কারের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয় ওই বছরের ১৫ আগস্টের মধ্যে (অবমূল্যায়ন, বাণিজ্য সংস্কার, আর্থিক ক্ষেত্রের সংস্কার, কর সংস্কার এবং শিল্প নীতি)।
২০২৪ সালের নির্বাচনের পর, গত ২৩ জুলাই নরেন্দ্র মোদি-নির্মলা সীতারামনের প্রথম বাজেট ছিল একটি হতাশাজনক অধ্যায়। তাতে মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধান করার মতো কিছুই ছিল না। যথারীতি অজুহাত দেওয়া হয়েছিল তখন, এবং প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে পরবর্তী প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেটেই (তার অর্থ যেমনই হোক) মিলবে যাবতীয় সমস্যার সমাধান। ইতিমধ্যে, অর্থনীতির গতি ধীর হয়েছে, মজুরি বাড়ছে না, কায়েম রয়েছে মুদ্রাস্ফীতি এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (আরবিআই) তার অবস্থান বদলাবে না বলে দিয়েছে, বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (এফডিআই) ‘ইনফ্লো’ কমে গিয়েছে, ফিরে গিয়েছে বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ (এফআইআই) বিনিয়োগ। এখানেই শেষ নয়, ব্যবসা এবং ব্যবসায়ীরা সিঙ্গাপুর, দুবাই এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছে। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন, ‘সরকারের সামনে চেঁচিয়ে বলবে কে?’
যুক্তিসঙ্গত পরামর্শ
সৌভাগ্যক্রমে, প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা (সিইএ) ২০২৪-২৫ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষার (ইএস) ভূমিকায় যা বলার বলে দিয়েছেন সোজাসুজি। তাঁর যুক্তিসঙ্গত পরামর্শ ছিল ‘কাজ শেষ করে ফেলুন’ এবং ‘নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করুন’। অর্থনৈতিক সমীক্ষায় অধ্যায় রয়েছে মোট ১৩টি। তার মধ্যে থেকে কেবল চারটি বেছে নিয়ে প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টার সুপারিশ সম্পর্কে কিছু বলব। বলব সিইএ কী সুপারিশ করেছিলেন, এবং সে সম্পর্কে সরকারের প্রতিক্রিয়া, নিষ্ক্রিয়তা ইত্যাদি কী ছিল।
প্রথম অধ্যায়ে (অর্থনীতির অবস্থা) তিনি তুলে ধরেছেন অর্থনৈতিক মন্দার কারণগুলি। একইসঙ্গে তিনি সুপারিশ করেছেন যে, প্রতিযোগিতার যোগ্যতা ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে একেবারে নীচের স্তর থেকে। ওইসঙ্গে রয়েছে সিইএ’র কাঠামোগত সংস্কারেরও সুপারিশ। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, অর্থমন্ত্রী বেছে নিয়েছিলেন তার উল্টো রাস্তা। বর্তমান প্রকল্পগুলিতে আরও অর্থ ঢেলেছেন! ওইসঙ্গে ঘোষণা করেছেন সাতটি প্রকল্প, আটটি মিশন এবং চারটি তহবিল। ডিরেগুলেশন বা নিয়ন্ত্রণমুক্তির জন্য নির্দিষ্ট কোনও প্রস্তাব মেলেনি। কোনও ক্ষেত্রের প্রতিযোগিতার যোগ্যতা-শক্তি বৃদ্ধির জন্য কোনও পদক্ষেপের রূপরেখাও ছিল না। তিনি কেবলমাত্র আর্থিক ক্ষেত্রের বাইরের নিয়ন্ত্রণগুলি পর্যালোচনা করার জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের নিয়ন্ত্রণমূলক সংস্কার কমিটি (হাই লেভেল কমিটি ফর রেগুলেটরি রিফর্মস) ঘোষণা করতে পারেন। তার মানে, আর্থিক ক্ষেত্র সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং কোনও পর্যালোচনা করা হবে না।
অস্বীকৃতি, আরও অস্বীকৃতি
দেশের জন্য বেকারত্ব, বিশেষ করে যেসব পরিবারে বেকার ছেলেমেয়ে রয়েছে তাদের জন্য সবচেয়ে গুরুতর চ্যালেঞ্জ। ১২ নম্বর অধ্যায়ে কর্মসংস্থান ও দক্ষতা উন্নয়ন (এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড স্কিল ডেভেলপমেন্ট) ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমীক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (পিএলএফএস) রিপোর্টের উপর। তাতে দাবি করা হয়েছে যে ২০২৩-২৪ সালে দেশে বেকারত্বের হার ৩.২ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থনৈতিক তত্ত্বে এটিকে পূর্ণ কর্মসংস্থান হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এই ঝুঁকি উপলব্ধি করে, অর্থনৈতিক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর কৃষি ক্ষেত্রের বাইরে সাড়ে ৭৮ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে, যখন দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা পৌঁছবে ৯৬ কোটিতে। একদিকে নিয়মিত বা বেতনভোগী চাকরির অনুপাত হ্রাস পেয়েছে এবং অন্যদিকে বৃদ্ধি পেয়েছে নিজস্ব ফার্মসহ স্বনিযুক্তির হার। গত সাতবছরে পুরুষদের প্রকৃত মাসিক মজুরি কমেছে—১২,৬৬৫ টাকা থেকে হয়েছে ১১,৮৫৮ টাকা। হ্রাস পেয়েছে স্বনিযুক্ত ব্যক্তিদেরও প্রকৃত মজুরি বা আয়। যাবতীয় বাস্তব প্রমাণ কিন্তু পিএলএফএস-এর দাবিকে সমর্থন করছে না। এই প্রসঙ্গে একেবারে নিম্ন স্তরের চাকরির জন্য বিপুল সংখ্যক আবেদনকারীর কথাটি বিশেষভাবে মাথায় রাখতে হবে। অর্থমন্ত্রী কি পিএলএফএস এবং অর্থনৈতিক সমীক্ষার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন? এই বিষয়ে তাঁর নীরবতা সত্যকে অস্বীকার করারই শামিল। বাস্তব এটাই যে, জিডিপি মাঝারি গতিতে বৃদ্ধি পেলেও বেকারত্ব বাড়ছে, বিশেষ করে যুব শ্রেণি ও স্নাতকদের ভিতরে এবং চাকরি বা কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যাপারটা থমকে রয়েছে।
‘ডিরেগুলেশন ড্রাইভস গ্রোথ’ শিরোনামে একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় (৫ নং) রয়েছে। বিনিয়োগের বর্তমান হার ৩১ শতাংশের কম। ৬.৫ শতাংশের নীচে বৃদ্ধির হার। এই প্রেক্ষিতেই অর্থনৈতিক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০৪৭ সালের মধ্যে আমরা উন্নত দেশ (ডেভেলপড কান্ট্রি) হয়ে উঠতে পারব না। সরকারের প্রতি ইএস-এর পরামর্শ, ‘ডিরেগুলেশন এজেন্ডা ত্বরান্বিত এবং প্রসারিত’ করতে হবে।  এছাড়া ‘জনগণকে তাদের এজেন্সি ফিরিয়ে দেওয়ার এবং ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করারও’ আহ্বান জানিয়েছে ইএস। ইএস নিয়ন্ত্রণের সীমাবদ্ধতাগুলি চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে ধরা হয়েছে কারখানা সংক্রান্ত নিয়মকানুন এবং ‘ইনফ্লেটেড রেগুলেটরি ক্যাপাসিটি’। ১৯৯১-৯৬ পর্বে নিয়ন্ত্রণমুক্তির কিছু দৃষ্টান্ত দিতে পারি, যেমন ‘সিসিআইঅ্যান্ডই’ তুলে দেওয়া হয়েছে এবং ‘ফেরা’কে (এফইআরএ) রূপান্তরিত করা হয়েছে ‘ফেমা’তে (এফইএমএ)। একইভাবে, এই অর্থমন্ত্রীও কিছু দপ্তর এবং নিয়ন্ত্রণ বাতিল করতে পারতেন। তিনি এসব এড়িয়ে গিয়েছেন। আমার ধারণা, আগামী একবছরে কিছুই হবে না।
দুর্বলতা
‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নিয়ে এত ঢক্কানিনাদ সত্ত্বেও বলব যে, ভারতের উৎপাদন ক্ষেত্রটি (ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর) ক্ষুদ্র এবং এর বৃদ্ধির হারও দ্রুত নয়। ৭ নং অধ্যায়ে অলোচিত হয়েছে শিল্প। সার্বিক বাণিজ্য সংস্কার প্রসঙ্গে যে তথ্যাদি উঠে এসেছে তা আশাপ্রদ নয়। বিশ্বব্যাপী উৎপাদনে আমাদের অংশ মাত্র ২.৮ শতাংশ, সেখানে ২৮.৮ শতাংশ অবদান চীনের। উৎপাদন ক্ষেত্রে জিভিএ’র (গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড) অংশ ২০১১-১২ সালে ছিল ১৭.৪ শতাংশ। সেটি সেই উচ্চতা থেকে ২০২৩-২৪ সালে ১৪.২ শতাংশে নেমে এসেছে। উৎপাদন ক্ষেত্রে অপরিহার্য উচ্চমানের যন্ত্রপাতি আমরা আমদানি করে থাকি। গবেষণা ও উন্নয়ন ক্ষেত্রে আমাদের ব্যয়ের পরিমাণ জিডিপির মাত্র ১ শতাংশেরও কম! সেখানে অর্থনৈতিক সমীক্ষার পরামর্শ হল, নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) এবং উদ্ভাবনের উপর গুরুত্ব বৃদ্ধি করতে হবে। জোর দিতে হবে কর্মী বাহিনীর স্কিল লেভেল উন্নত করার উপর। ইএস-এর মত, এগিয়ে যাওয়ার পথ এতেই সুগম হবে। তবে এই ব্যাপারে বাজেটের প্রতিক্রিয়া মিলেছে কেবল কিছু স্কিম আর মিশন চালু করার মধ্যে। 
গভর্ন্যান্স বা শাসনব্যবস্থা বলতে বর্তমানে যা চলছে! অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, আছে একটি সরকারও, কিন্তু অনুপস্থিত যেটা তা হল গভর্ন্যান্স বা শাসনব্যবস্থা। প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা (সিইএ) হলেন আর একটি উপেক্ষিত কণ্ঠস্বর।
-লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। 
(মতামত ব্যক্তিগত)
2d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

নিজের বা পরিবারের কারও আকস্মিক রোগবৃদ্ধিতে বিচলিত হতে পারেন। কাজকর্ম কমবেশি এগবে। মানসিক  বিক্ষিপ্ততা।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৫.৯৩ টাকা৮৭.৬৭ টাকা
পাউন্ড১০৫.৪১ টাকা১০৯.১৩ টাকা
ইউরো৮৭.৭৪ টাকা৯১.১২ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা