মোদি সরকারের নয়া জাতীয় শিক্ষা নীতি (এনইপি) ২০২০ ‘হোলিস্টিক প্রগ্রেস’ কথাটির উপর জোর দিয়েছে। শিশুর এই ধরনের উন্নয়নে অন্তর্ভুক্ত কী কী? শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং নৈতিক গুণাবলি। এগুলি একত্র হলেই একটি শিশু ‘মানুষ’ হিসেবে জীবনে ‘সফল’ হতে পারবে। কাম্য শারীরিক বৃদ্ধির জন্য প্রথম দরকার পুষ্টিকর খাবার। এমন আদর্শ খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন অবশ্যই থাকবে সব্জি, ফলমূল, সুষম খাদ্যশস্য, প্রাণীজ/অপ্রাণীজ প্রোটিন, পরিস্রুত পানীয় জল প্রভৃতি। একই সঙ্গে প্রয়োজন বয়স অনুযায়ী খেলাধুলো, শরীরচর্চা প্রভৃতি। মানসিক বিকাশের জন্য প্রথম প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস এবং স্কুলে আনন্দদায়ক পরিকাঠামো। শুধু কিছু পাঠ্যবই পড়িয়ে দেওয়ার জন্য যেমন তেমন একটি ইট-কাঠ-পাথরের ভবন থাকাই যথেষ্ট নয়, স্কুলকে হতে হবে সর্বার্থেই আনন্দপাঠের স্থান। পরিচ্ছন্ন, পর্যাপ্ত পরিসর ভবনের পাশাপাশি থাকতে হবে ভালো জল ও স্বাস্থ্যকর শৌচাগার এবং উপযুক্ত খেলার মাঠ। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিতে উপনীত কন্যাসন্তানদের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতে হবে। এরপর চাই সহযোগিতার নীতিতে সমাজের অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা এবং নানা অভিজ্ঞতা অর্জন। চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটাবার ব্যবস্থাও থাকবে শিক্ষাক্ষেত্রে। আর থাকতে হবে নৈতিক শিক্ষার পাঠ। ‘গুরুকুলে’ এই গুরুদায়িত্ব পালন করবেন কারা? শিক্ষকরা। তাহলে সুশিক্ষিত এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাও চাই। বলা বাহুল্য, পড়ুয়া এবং শিক্ষকের আদর্শ অনুপাত লঙ্ঘন করলে পাঠদান প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে।
২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের দামামা দেশজুড়েই বেজে গিয়েছে। এমনই এক সন্ধিক্ষণে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর ১০৮তম ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন ‘এনইপি ২০২০’-র মাহাত্ম্য নিয়ে। তিনি দাবি করেন, ছোট ছেলেমেয়েদের ‘শিক্ষা’ এবং ‘হোলিস্টিক প্রগ্রেস’-এর সামনে ‘ভাষা’ আর কোনও বাধা হবে না। আমাদের দেশের অগুনতি গরিব ছেলেমেয়ে প্রতিবছর ‘স্কুলছুট’ হয়ে যায়। দীর্ঘদিনের এই দুঃখজনক পরিস্থিতির জন্য, ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ভাষার প্রতিবন্ধকতাকে বিশেষভাবে দায়ী করেন। তাঁর বক্তব্য, নয়া শিক্ষা নীতি এই সমস্যার মূলোচ্ছেদ করবে। এই ‘একদা অসম্ভবটি সম্ভব হবে’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তির কল্যাণে। তাৎক্ষণিক এবং নির্ভুল ভাষান্তরের সুবিধা আমরা সকলেই উপভোগ করতে পারব। নয়া ব্যবস্থা প্রি-প্রাইমারি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার দ্বার খুলে দেবে সবারই সামনে। অতঃপর বেড়ে যাবে প্রিয় বিষয়ে স্নাতক হওয়ার সুযোগটিও।
পুরো ব্যাপারটা কল্পনা করতে সত্যিই ভালো লাগে। কিন্তু তার রূপায়ণ ‘লাও তো বটে কিন্তু আনে কে’ গোছের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে না কি? বুনিয়াদি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামো কেমন? সামান্য অনুসন্ধানেই যা বেরিয়ে আসে তাকে ‘শিক্ষাব্যবস্থার কঙ্কালসার চেহারা’ বললে অত্যুক্তি হবে না। সরকারের দাবি, সংখ্যাটি নাকি মোদি জমানায় অনেক কমেছে, তারপরেও ২০২৩-২৪ সালে এক শিক্ষকবিশিষ্ট স্কুলের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং রাজস্থানে এমন স্কুল সবচেয়ে বেশি। অথচ এনইপি ২০২০’র সুপারিশ পড়ুয়া-শিক্ষক অনুপাত হতে হবে ১:৩০। সারা দেশে কয়েক হাজার স্কুলের নিজস্ব বাড়ি নেই। তার মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে পাঠদান চলে গাছের নীচে। এমন প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বিহারে। ২০২৩ সালের ২৫ মার্চ বিহার বিধানসভায় নীতীশ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী চন্দ্রশেখরের বিবৃতি থেকে জানা যায়, সংখ্যাটি ৫,৬৮১ বা ৯ শতাংশ!
ভারতে কত মানুষ গরিব? বিনামূল্যে রেশন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার মধ্যেই তা পরিষ্কার। ২০২৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ছত্তিশগড় বিধানসভা ভোটের প্রচারে বেরিয়ে তিনি সানন্দে ঘোষণা করেন যে, ৮১ কোটি ৩৫ লক্ষ গরিব মানুষকে বিনামূল্যের রেশন বণ্টনের সময়সীমা আরও পাঁচ বছর বৃদ্ধি করা হল! হাজার হাজার শিশু স্কুলছুট সাধ করে হয়ে যায় না। তারা শিশু শ্রমিকের অভিশপ্ত জীবনেও প্রবেশ করে না খুশিতে ডগমগ হয়ে। স্কুলছুট এবং শিশু শ্রমের নেপথ্যে রয়েছে বাবা-মায়ের আর্থিক দুর্দশা এবং অস্বাস্থ্যকর বস্তির জীবন। ভারতবাসীর এই দুর্দশা দূর করতেই তৈরি হয়েছে খাদ্যের অধিকার আইন এবং স্কুলপড়ুয়াদের জন্য চালু হয়েছে মিড ডে মিল। কিন্তু মিড ডে মিল সরবরাহের জন্য যে অর্থ মোদি সরকার বাহাদুর বরাদ্দ করেন, তাতে ছেলেমেয়েদের কতটা পুষ্টিকর খাবার দেওয়া সম্ভব? জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে প্রতিদিন। একই বাজার থেকে মিড ডে মিলের উপাদান কেনাকাটা করতে হয়। কিন্তু তার জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির রেওয়াজ একেবারেই অনিয়মিত। যেমন দু’বছর বাদে, গত ২৭ নভেম্বর শিক্ষামন্ত্রক মিড ডে মিলের বরাদ্দ বৃদ্ধির বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। কিন্তু মাথাপিছু বৃদ্ধির পরিমাণটা কত? প্রাথমিকে ৭৪ পয়সা এবং উচ্চ প্রাথমিকে ১ টাকা ১২ পয়সা। তাতে বাংলায় মাথাপিছু বর্ধিত বরাদ্দ কত দাঁড়াল? প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৬ টাকা ১৯ পয়সা (তার মধ্যে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ৩ টাকা ৭১ পয়সা) এবং উচ্চ প্রাথমিকে (ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণি) ৯ টাকা ২৯ পয়সা (তার মধ্যে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ৫ টাকা ৫৭ পয়সা)।
এই ভয়াবহ ছবিটারই পাশে রাখব অন্য দুটি চিত্র: পরীক্ষা পে চর্চা এবং কেন্দ্রীয় বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ। বছরে একবার পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি (অফলাইন এবং অনলাইন) প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছে ২০১৮ থেকে। তথ্যের অধিকার আইনে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ‘পরীক্ষা পে চর্চা’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী পড়ুয়াদের একটি করে শংসাপত্র দেওয়া হয়। মোদিজির মুখশ্রী সংবলিত ওই সার্টিফিকেট ছাপতে কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে প্রতিবছর খরচ হয় ১ কোটি টাকা। ২০১৮-র হিসেব কেন্দ্র দেয়নি। পরবর্তী ছ’বছরে খরচের পরিমাণ প্রায় ৭৯ কোটি টাকা, তার মধ্যে ৬২ কোটি টাকা কেন্দ্র খরচ করেছে গত তিনবছরে!
অথচ শিক্ষা এবং গবেষণায় ছাত্রবৃত্তির হাল ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির ছবিটাও হতাশাজনক। কেননা, ২০২৫ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে ১ লক্ষ ২৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এবং গতবছরের তুলনায়
বরাদ্দ বৃদ্ধির পরিমাণ ৬.৫ শতাংশ মাত্র। বৃদ্ধির এই হার গত চারবছরের মধ্যে সবচেয়ে কম! এনইপি ২০২০-তে শিক্ষাখাতে জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব রয়েছে। শিক্ষাখাতে গতবছর বরাদ্দ করা হয় ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকা, যেটা ছিল ২০২৩-২০২৪ সালের চেয়ে ৭.১৪ শতাংশ বেশি। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য শিক্ষাখাতে ব্যয় বাড়িয়ে জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা ছুঁয়ে ফেলা জরুরি। গত পাঁচবছরে শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয় বাড়লেও তা লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরেই রয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ধাক্কা দিয়েছে করোনাকালের ২০২১-২২ সাল। সেবার বৃদ্ধির পরিবর্তে, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ৬.১২ শতাংশ কমানো হয়েছিল! সব মিলিয়ে শিক্ষার জন্য সরকারি ব্যয় জিডিপির ৩-৪ শতাংশের মধ্যে হাঁপিয়ে মরছে। গবেষণা এবং উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) খাতে আমরা ব্যয় করছি জিডিপির ১ শতাংশেরও কম! কেন্দ্রেরই সর্বশেষ আর্থিক রিপোর্টে এনিয়ে হতাশা ব্যক্ত করা হয়েছে।
এর পাশে রাখা যাক আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষায় বরাদ্দ করেছিল তাদের জিডিপির ৬ শতাংশ। প্রতিবেশী চীনের বরাদ্দ আরও বেশি ৬.১৩ শতাংশ। কোভিডের আগে সাধারণ শিক্ষা, গবেষণা এবং বিজ্ঞানশিক্ষায় জার্মানির বাজেট বরাদ্দ ছিল জিডিপির ৯.৮ শতাংশ। ২০২৩ সালে তা কিছুটা কমানো হলেও প্রাইমারিসহ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাখাতে অঙ্কটি এখনও ৪.৬ শতাংশ রয়েছে। শিক্ষায় জাপান সরকার খরচ করছে তাদের জিডিপির ৭.৪৩ শতাংশ।
এরপর ভাবুন, আমরা কোন কাণ্ডজ্ঞানে ‘উন্নত’ দেশের পংক্তিতে বসার খোয়াব দেখছি? গাছের গোড়া কেটে আগায় জল সিঞ্চনের সংস্কৃতি কোন ফল প্রসব করবে? যে ‘কীর্তিটি’ মোদিজি হাসি মুখে করে চলেছেন, তা আসলে বেসরকারি শিক্ষাক্ষেত্রকে মদতদান, যা বৈষম্য বৃদ্ধির সঙ্গে ভীষণই মানানসই। কে-১২ শিক্ষাঋণের গল্পটি মাথায় রাখুন, ব্যাপারটি খোলসা হয়ে যাবে। রাষ্ট্র আর কারও দায় নেবে না, যে যারটা বুঝে নাও, দম থাকলে ঋণ করে লড়ে যাও। রেশনের চাল-আটা এবং মিড ডে মিলের সাপোর্ট ছাড়া যেসব পরিবার দিনেই আঁধার দেখে, তারা ঋণ নিয়ে সন্তানকে শিক্ষিত করবে! বলিহারি নীতি!!
রাজনীতিতে ইস্যুর অভাব নেই। কিন্তু শিক্ষাখাতে সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় কোনও দলকে অংশ নিতে দেখি না কেন? আগামী দিনে প্রতিটি নির্বাচনে সমস্ত ‘জনপ্রিয়’ ইস্যু বাঁয়ে রেখে শিক্ষাখাতে ব্যয়বৃদ্ধির দাবি সংক্রান্ত প্রতিযোগিতা চলুক। এই প্রশ্নে এগিয়ে আসুক প্রতিটি দলের নির্বাচনী ইস্তাহার। গোড়ার গলদ দূর না-হলে পরিতাপ, আক্ষেপই আমাদের সম্বল রয়ে যাবে অনন্তকাল!