বাংলায় একটা কথা আছে, চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন। দেখা আর শোনা যদি একসঙ্গে না হয়, তাহলে প্রকৃত বাস্তব নিয়ে একটা সংশয় থেকে যেতেই পারে। চোখ এবং কান একসঙ্গে কাজ করলে সেই সন্দেহ আর থাকে না। মানে, চোখ যেটা দেখল, কানও সেটাই শুনল। চক্ষু ও কর্ণের মধ্যে বিবাদ তৈরি হলে, তার ‘ভঞ্জন’ হয় তখনই। ১১ বছর হতে চলল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশ চালাচ্ছেন। কিন্তু আম জনতার চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন কিছুতেই হচ্ছে না। এই এক দশক ধরে আমাদের যা দেখানো হচ্ছে, তার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু শোনা যাচ্ছে না। আর যে সব প্রতিশ্রুতি শোনানো হচ্ছে, তা বাস্তব জীবনে ফলতেও দেখা যাচ্ছে না। দেশের অর্থনীতি এবং মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে বলে দেখানো হচ্ছে, কিন্তু আমরা সুফল বুঝতে পারছি না। প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা থেকে শুরু করে গত বছরের ২ কোটি ৯০ লক্ষ চাকরির প্রতিশ্রুতি শোনানো হয়েছে। কিন্তু আমরা তা ব্যাঙ্কের পাশবুকে বা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে দেখতে পাইনি। তারপরও অবশ্য খান দুয়েক লোকসভা ভোট এবং একঝাঁক বিধানসভা নির্বাচন জিতে ফেলেছেন নরেন্দ্র মোদি। শেষ সংযোজন দিল্লি। ২৭ বছরের অভিশাপ কাটিয়ে প্রমাণ করেছেন, ‘মোদিই পারে’। কেন পারে? কীভাবে পারে? কম্পিটিশনে একা দৌড়ে পারে? রেসে নামার আগেই বিপক্ষের কোমর ভেঙে দিয়ে পারে? এসব প্রশ্ন অমূলক। দিনের শেষে স্কোরবোর্ডে রানটাই আসল। কতগুলো ক্যাচ পড়ল, আর কোন দুধুভাতু বোলাররা বল করল, তাতে কিছু আসে যায় না। আপাতত দিল্লি তাঁর। আগেরবার পাঁচ বছরের মেয়াদে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী পদে তিনজনকে দফায় দফায় বসাতে হয়েছিল বিজেপিকে। কারণ, দুর্নীতির অভিযোগ। এবং ক্ষোভ। এবার সেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে গলা চড়িয়েই দিল্লিতে শাপমোচন হয়েছে গেরুয়া শিবিরের। আশা করাই যায়, অবস্থা সেই ’৯৩ সালের মতো হবে না। অর্থাৎ, দুর্নীতি ও ক্ষোভের অভিযোগ ছাড়াই পাঁচ বছর রাজধানী শাসন করবে বিজেপি। আর তাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর চতুর্থ স্বপ্নটি সফল হয়েই গেল মোদিজির।
চতুর্থ কেন?
প্রথম স্বপ্ন, ক্ষমতায় এসেই আগে কংগ্রেসের রাজনীতির দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া। নোট বাতিল, নেতাদের জেল যাত্রায় পাঠানো, লাগাতার অভিযোগ এবং আক্রমণ এই কর্মসূচিতে যতটা না তাঁকে সাহায্য করেছে, তার থেকে অনেক বেশি সমর্থন জুগিয়েছেন রাহুল গান্ধী। এবং এখনও পারলে স্লিপিং পার্টনার হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। দ্বিতীয় স্বপ্ন, ইন্দিরা গান্ধীকে ছুঁয়ে ফেলা। প্রধানমন্ত্রিত্বের সংখ্যায় এবং পাকিস্তান বিরোধিতায়। আর তৃতীয় স্বপ্ন, জওহরলাল নেহরু। টানা তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে গিয়েছেন মোদিজি। চতুর্থ স্বপ্ন ছিল, দিল্লি দখল। কেন্দ্রে ক্ষমতায় আছেন, অথচ রাজধানী হাতছাড়া! এ তো পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে অঙ্কে ফেল করার মতো অবস্থা। তাঁকে জেতাল মধ্য ও উচ্চবিত্ত শ্রেণি। আর অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে ডোবাল শিসমহল। নরেন্দ্র মোদি অবশ্য এসব সমীকরণকে অতীত করে বিদেশযাত্রায় মন দিয়েছেন। আরও কয়েকদিন পর ফিরবেন। তারপরই মন দেবেন পঞ্চম স্বপ্নে। সেটা কী? বাংলা দখল।
এই একটি কাঁটা মোদিজির গলায় এখনও বিঁধে আছে। দিল্লি এবং কার্যত গোটা উত্তর ভারত দখলের পর বাংলার কাঁটা উপড়ে ফেলতে মরিয়া যে তিনি হবেন, সেটা বোঝার জন্য আইনস্টাইন হতে হয় না। অসম, ত্রিপুরা, মণিপুরের মতো উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিকে দণ্ড ও ভেদের শাসনে ধরে রেখেছে বিজেপি। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এই রাজ্যটিই এখনও বেগ দিয়ে যাচ্ছে তাঁকে। ১০০ দিনের কাজের টাকা বন্ধ করেছেন, রাজ্যবাসীকে আবাস দেননি, শাসক তৃণমূলের একের পর এক নেতাকে দুর্নীতির জাল ফেলে ধরেছেন, জেলেও ভরেছেন। তারপরও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনভিত্তি টলাতে পারেননি। চব্বিশের লোকসভা ভোট তার প্রমাণ। দিল্লি দখল হয়ে গিয়েছে। আর অপেক্ষা নয়। ইতিমধ্যেই অবশ্য কাজে নেমে পড়েছে গেরুয়া ব্রিগেড। তারা জানে, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের অস্ত্র অন্য রাজ্যে কাজে দিলেও মমতার বাংলায় চলবে না। এই সমীকরণে তিনিই পথিকৃৎ। উল্টে তাঁর প্রকল্প ধার করে সম্প্রতি বেশ কয়েকটা রাজ্যে জিতেছে বিজেপি। দুর্নীতির অভিযোগ, ইডি, সিবিআই দিয়েও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। তাহলে তো ২০১৬ সালের নারদ কাণ্ডেই সরকার ফেলে দেওয়া যেত। এখানকার মানুষ এখনও এই ভদ্রমহিলার ক্যারিশ্মার উপর অন্য কিছু রাখে না। তাহলে উপায়? মেরুকরণের দাঁত-নখ বেরনোর সময় হয়ে গিয়েছে। গত কয়েকটা বছর যা খানিকটা আবডালে ছিল, তা বেরচ্ছে। বিরোধী দলনেতা এরইমধ্যে হাঁক দিয়েছেন, হিন্দু সরকার গড়বে বিজেপি। ধর্মনিরপেক্ষ দেশে হিন্দু সরকার? মানুষ ভাবছে? এক বছর আগের বাংলা হলেও ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু বাংলাদেশ সেই সুযোগ আর দিচ্ছে না। পড়শি দেশে মৌলবাদ পাখনা মেলছে। সেই সুযোগটাই পুরোদমে নিচ্ছে বিজেপি। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে চলছে চোরাগোপ্তা উস্কানি। মানুষকে বোঝানো হচ্ছে, বাংলাদেশের আঁচ সবচেয়ে বেশি পড়বে পশ্চিমবঙ্গের উপর। তাই এখন থেকেই কোমর বাঁধতে হবে। কীভাবে? নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়ানোর পাঠ কিন্তু তারা দিচ্ছে না! উল্টে মুসলিম বিরোধী এজেন্ডার আগুনে ঘি ঢালা হচ্ছে লাগাতার। সেই সঙ্গে বাংলার শাসকের গায়ে সেঁটে দেওয়া হচ্ছে সংখ্যালঘু তোষণের স্টিকার। এক ঢিলে দুই পাখি। একইসঙ্গে বিজেপি আরও একটা পন্থা নিয়েছে। রাজ্য সরকারি কর্মীদের একাংশ এখন তলে তলে গেরুয়া শিবিরকে সাপোর্ট দিচ্ছে। কীভাবে? কাজে ঢিলে এবং অন্দরের খবর বাহার করে দেওয়া। ফলে মানুষের জন্য কোনও প্রকল্প বা সুবিধা রাজ্য সরকার আনতে গেলে সেটা আগাম ঘোষণা করে দিচ্ছে বঙ্গ বিজেপির হর্তাকর্তারা। মানুষকে বোঝাতে চাইছে, এসব চেনা রাজনীতি। আপনারা এসবে ভুলবেন না। বরং হিন্দুত্ব কীভাবে রক্ষা হয়, সেটা ভাবুন।
ফলে চ্যালেঞ্জ বাড়ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এরকম চ্যালেঞ্জ কি আগে সামলাননি তিনি? বিলক্ষণ সামলেছেন। এর থেকে অনেক বেশি এবং আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছেন। কিন্তু বুঝতে হবে, এবারের ঘনঘটা অন্য সব ঘটনার থেকে আলাদা। বাংলাদেশের পরিস্থিতি, মৌলবাদী আগ্রাসন, জঙ্গি অনুপ্রবেশ, আবার উদ্বাস্তু আশঙ্কা... তার সঙ্গে গেরুয়া শিবিরের ভোট-রাজনীতি। এটা ধরে নিতে হবে যে, অধুনা ইউনুসের বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি ইন্দিরা গান্ধী স্টাইল নেবেন না! কারণ দু’টি। ১) মৌলবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে আন্তর্জাতিক মহলে যে ঝড় উঠবে, তা সামলানোর মতো দাপট তাঁর নেই। ২) বাংলাদেশ সংক্রান্ত এই অশান্তি মিটে গেলে ছাব্বিশের ভোটে মেরুকরণ-অস্ত্রের ধার এমনিতেই অনেকটা ভোঁতা হয়ে যাবে। তাই পরের ছেলে পরমানন্দ ফর্মুলাতেই আপাতত চলবে। মূল্য দেবে কে? বাংলার মানুষ। তাই এই পরিস্থিতিতে যাবতীয় সমীকরণ বদলে দিতে পারেন একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে প্রশাসক হিসেবে নয়, নেত্রী হিসেবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়... এখন যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ যাচ্ছে, তার জন্য ঘরে ঘরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে তাঁকেই। তৃণমূল কংগ্রেস মানে কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে কোনও রাজনৈতিক দল নয়। এর অর্থ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল দল এবং ব্যক্তি মমতার মধ্যে ফারাক কিছু নেই। তৃণমূল না থাকলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থাকবেন। কিন্তু মমতা না থাকলে তৃণমূল আদৌ থাকবে কি না, সন্দেহ আছে। তাই বিভাজনের রাজনীতিকে পেড়ে ফেলতে গেলে পুরনো ফর্মে ফিরতে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তিনিই একমাত্র পারেন, বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে যেতে। মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে মুড়ি খেতে। জাত-ধর্ম বর্ণ না দেখে শিশুকে কোলে তুলে নিতে। সাধারণ মানুষের সমস্যায় ঝাঁপিয়ে পড়তে। বোঝাতে... আমি আছি। বাংলার মানুষ কিন্তু এতটুকুই চায় তাঁর কাছে। নিজের চোখে দেখা... প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা সাধারণ ঘরের তৃণমূল সমর্থককে আজও ভিড়ের মধ্যে চিনে নেন তিনি। নাম ধরে ডাকেন। অপারেশনের পর মেয়ে কেমন আছে, জিজ্ঞেস করেন। প্রশাসক হিসেবে নয়। নেত্রী হিসেবে। দিদি হিসেবে। এটাই কিন্তু তাঁর ইউএসপি। তথাকথিত শিক্ষিত একটা শ্রেণি তাঁর সমালোচনা করবে, গাল দেবে। কিন্তু সুবিধা নেওয়ার সময় গলে পড়বে। এটা এখন তাঁরও গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজ সময়টা অন্য। বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে, কেউ জানে না। হঠাৎ শুরু হওয়া ঝড় হয়তো চলবে পাঁচ-দশ বছর। অথবা কয়েক মাসেই হঠাৎ থেমে যাবে। কিন্তু যতদিন দুর্যোগ থাকবে, বিপর্যয়ের আশঙ্কায় কপালে ভাঁজ পড়বে আমাদেরও। রাজনীতির কারবারিরা তার সুযোগ নেবে। আশঙ্কা যাতে আতঙ্কে বদলে না যায়, সেটা দেখতে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই। কারণ, তিনিই পারবেন। প্রতিটা ঘরে, প্রত্যেক রাজ্যবাসীর কাছে... চাহিদা হয়তো বেশিই হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এমনটা না হলে যে বাংলা ‘রক্ষা’ করাই কঠিন হয়ে যাবে!