‘অর লড়ো, জি ভরকে লড়ো ভাই, সমাপ্ত কর দো এক দুসরে কো’। দিল্লির চূড়ান্ত ফল ঘোষণার মাঝপথেই ইন্ডিয়া জোটের দুই শরিক কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টিকে এই তির্যক মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছেন কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা। দিনের শুরুতেই ট্রেন্ড দেখে একদম ঠিক বলেছেন। কারণ মরিয়া বিজেপি ২৭ বছর পর দিল্লি বিধানসভা দখল করলেও এই সাফল্যকে কিছুতেই বিরাট জয়, অভূতপূর্ব বলা যাবে না। বরং আপ আর বিজেপি’র মধ্যে শতাংশের হিসেবে ভোটের পার্থক্য মাত্র ২ শতাংশের মতো। অথচ আসনের ব্যবধান ২৬। ৪৮ বিজেপি, ২২ আপ। কোনও আসন না পেলেও ৭ শতাংশের মতো ভোট কেটে বিজেপি’র রাজধানী দখল সুনিশ্চিত করেছেন রাহুল গান্ধী। যদি এই ভোট কাটাকুটি না হতো, ইন্ডিয়া ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করত তাহলে দিল্লিতে এবারও গেরুয়া পতাকার স্বপ্ন অধরাই থাকত। পাঁচ বছর আগে কেজরিওয়াল যখন জিতেছিলেন তখন দুই দলের ভোট শতাংশের ফারাক ছিল ১৫ শতাংশের মতো। এবার বিজেপি আপের প্রথম সারির নেতৃত্বকে দীর্ঘসময় জেলে পুরেও পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে ব্যর্থ। কিন্তু একইসঙ্গে বলতে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে তৈরি ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্সের অন্তরাত্মাকে বারে বারে উপেক্ষা ও আঘাত করার দায় নিতেই হবে দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও গান্ধী পরিবারকে। এদেশে বিরোধী আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখতে ব্যক্তিগত স্বার্থ ছেড়ে সোনিয়াজির পরিবারকে রাজ্যে রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলির পাশে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু দুঃখের কথা, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানার ভরাডুবির পরও শিক্ষা নেয়নি বিরোধীরা। সেই অনৈক্যের সুযোগেই দেশে গেরুয়া দলের শাসন শাখাপ্রশাখা বিস্তার করছে। গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বারে বারে বিপন্ন হচ্ছে। দশ জনপথের নিভৃতবাসিনী যেন ভুলে না যান নেহরু থেকে ইন্দিরা, একটি পরিবারের নাম ও নিশান মিটিয়ে দেওয়াই মোদি-অমিত শাহের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা। বিরোধীদের এই সঙ্কটে তাই ঝুঁকিটা নিতে হবে তাঁকেই।
গত লোকসভা ভোটের আগে ক’টা বৈঠক হয়েছিল ইন্ডিয়া জোটের? ক’জন শরিকের মনে আছে আজ? প্রশ্নটা ছুড়লেই পুরনো ক্যালেন্ডার খোঁজেন নেতারা। ভুলে যান জোটের স্পিরিটেই আসন সমঝোতা না হলেও অষ্টাদশ সাধারণ নির্বাচনের ফল নরেন্দ্র মোদির একদলীয় শাসনকে ধাক্কা দিয়েছিল। বিজেপি সরকারের বদলে ক্ষমতায় এসেছিল এনডিএ। ২৪০ আসনে থেমে গিয়েছিল বিজেপি’র ‘অব কি বার চারশো পারের’ আস্ফালন। কিন্তু তারপরই সবাই সবার বিরুদ্ধে নেমে গেল! কোনও বৈঠক নেই। নেই কোনও সমন্বয়। ইন্ডিয়া ছত্রভঙ্গ। এই একই নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে হরিয়ানায়, মহারাষ্ট্রে। আজ তারই রিপ্লে দেখল দিল্লিও। লোকসভা নির্বাচনের পর বাংলাতেও বিজেপি নয়, যে কোনও মন্ত্রে মমতাকে অস্বস্তিতে ফেলাই ইন্ডিয়া জোটের দুই শরিক কংগ্রেস ও সিপিএমের একমাত্র কাজ। সময় কিন্তু খুব কম। আসন্ন বিহার ভোটের আগে ইন্ডিয়া জোট লড়াকু কোনও মুখ প্রজেক্ট করতে না পারলে আরও বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
বিরোধীরা যখন নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় ব্যস্ত বিজেপি সুনিপুণভাবে মহারাষ্ট্রে পাঁচ মাসে রেকর্ড ৩৯ লাখ এবং দিল্লিতে ৮ লক্ষ নতুন ভোটার যোগ করেছে। কেউ খোঁজ রাখেনি। সেইসঙ্গে সুপরিকল্পিতভাবে মুছে দিয়েছে আরও কয়েক লক্ষ ভোটারের নাম। শুধু দিল্লিতেই সংখ্যাটা প্রায় ৫ লাখের মতো। বিজেপি’র মতো সংগঠিত এবং আরএসএসের আশীর্বাদপুষ্ট একটি দলের সঙ্গে লড়তে গেলে যে সাংগঠনিক প্রস্তুতি দরকার তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি বিরোধীদের মধ্যে। এখন মহারাষ্ট্রে ফলাফল ঘোষণার পাঁচ সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পর রাহুল গান্ধীর হঠাৎ দিল্লিতে সাংবাদিক সম্মেলন করে কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণের অর্থ কী? ইন্ডিয়া নেতৃত্বের এই গা-ছাড়া মনোভাবের জন্যই দিল্লির মুসলিম অধ্যুষিত ওখলাতেও জয়ী হয়েছেন বিজেপি প্রার্থী মণীশ চৌধুরী। অর্থাৎ সংখ্যালঘু ভোট ভেঙে গিয়েছে। পাঞ্জাবি প্রধান এলাকা থেকে ঝুগ্গি অঞ্চলেও বিজেপি ভালো ফল করেছে। এমনকী উগ্র হিন্দুত্ব এবং কুম্ভ রাজনীতিকে হাতিয়ার করে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা লাগোয়া মিল্কিপুর বিধানসভাও দখল করেছে গেরুয়া শিবির।
শুধু ভোট কাটাকুটিই নয়, নির্বাচনের ৪৮ ঘণ্টা আগে সাত আপ বিধায়ক যোগ দেন বিজেপি’তে। নিছকই শিবির বদল বললে ভুল হবে। আসল কারণ নেতা কেনাবেচা, মোদি জমানায় যার কেতাবি নাম ‘অপারেশন লোটাস’। একুশের বিধানসভা ভোটের আগে জলে স্থলে সর্বত্র পদ্ম ফোটানোর চূড়ান্ত মারমুখী চেহারাটা দেখে ফেলেছে বাংলা। বিরোধীদের অভিযোগ, দিল্লিতে প্রত্যেক বিধায়ক কিনতে অমিত শাহের দল ১৫ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ করতে তৈরি। পাঁচ, পনেরো না একশো কোটির হাতবদল হয়েছে তা আমরা গুনে দেখিনি। তাই সত্যি মিথ্যে বলতেও পারব না। তবে এটুকু বিশ্বাস করি, মোদিজি যখন স্বাধীন ভারতে কালো টাকার বিরুদ্ধে বৃহত্তম অভিযানের কাণ্ডারী, তখন তাঁর দল ঘোড়া কেনাবেচাতেও নিশ্চয়ই কালো টাকা ব্যবহার করেনি। পুরোটাই আগমার্কা সাদা টাকায় হয়েছে। কারণ আমরা বঙ্গবাসী জানি ক্ষমতা দখল করতে সর্বত্র বিজেপি’র সেই এক আগ্রাসী স্টাইল। ভোটের আগে প্রতিপক্ষের ঘরে ভাঙন ধরানো কিংবা এজেন্সি পাঠিয়ে নেতামন্ত্রীদের গ্রেপ্তারের নামে ভয় দেখানোর নাটক। মহারাষ্ট্র নির্বাচন থেকে তারসঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনেকটা সিপিএমের স্টাইলে ভোটার তালিকা ম্যানিপুলেশন। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের চেয়ে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ছিল ৩২ লক্ষ বেশি। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে ভোটার বেড়েছিল ৩২ লক্ষ। কিন্তু এবার লোকসভা ভোটের পর মাত্র পাঁচ মাসে ভোটার সংখ্যা এক লাফে আরও ৩৯ লক্ষ বেড়ে গিয়েছে! কোন অঙ্কে এটা সম্ভব? মহারাষ্ট্রে মাত্র পাঁচ মাসে যে সংখ্যায় ভোটার বেড়েছে, তা গোটা হিমাচল প্রদেশের ভোটার সংখ্যার সমান বলে অভিযোগ রাহুল গান্ধীর। মহারাষ্ট্রের ১৯ বিধানসভা কেন্দ্রে মোট প্রদত্ত বৈধ ভোটের চেয়ে গোনা ভোটের সংখ্যা বেশি। আবার ৭৬টি বিধানসভায় গোনা ভোটের সংখ্যা বৈধ ভোটের চেয়ে কম। এই গাফিলতির কারণ সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে মহামান্য নির্বাচন কমিশনকে। নাহলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপর সাধারণের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।
দিল্লিতেও ভোটের দিন বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন হিসেব দিয়েছিল ৫৭.৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। পরের দিন তা বেড়ে হয়ে গেল ৬১ শতাংশ। তার বিস্তারিত হিসেবও কমিশন দেয়নি। মহারাষ্ট্র নির্বাচন থেকেই এটা শুরু হয়েছে। শেষ ঘণ্টায় ভোট পড়ার গতি হঠাৎ বেড়ে যায়। কোন রহস্যে? তার তল পায় না সাধারণ মানুষ। যেমন কুম্ভে ঠিক কত লোক পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তার সঠিক হিসেব কি বাইরে এসেছে? সবাই দেখেছে লাশের স্তূপ। মর্গে
ঠাঁই নেই রব। মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়ারও অভিযোগ এসেছে একাধিক। কিন্তু চাপে পড়ে কেঁদে কঁকিয়ে যোগী প্রশাসন মৃতের সংখ্যা তিরিশ বলে স্বীকার করলেও তারপর আর একচুলও এগয়নি। দেশবাসী দেখল, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার কেষ্টবিষ্টু থেকে শুরু করে দেশের প্রধানমন্ত্রী, সবাই স্নান করলেন
নির্বিঘ্নে। ভিভিআইপিদের জন্য নিরাপত্তার ঘেরাটোপ। কিন্তু যত দুর্গতি সাধারণের। প্রাণ হারাল কত, তার হিসেব কেউ দিল না। প্রশাসন যখন প্রকৃত সত্য চাপে তখন গুজব স্বাভাবিকভাবেই ডালপালা মেলে। এক্ষেত্রেও তাই। কেউ বলছেন প্রাণ হারিয়েছে কয়েকশো। আবার কেউ বলছেন প্রকৃত সংখ্যা কয়েক হাজার। সাধারণ মানুষ শুধু বিভ্রান্তই হতে থাকেন। বিরোধীরা যত রাশ ছেড়ে দেবেন তত বিজেপি’র এই যথেচ্ছাচার আরও বাড়তে বাধ্য।
দিল্লির ফলে আন্না হাজারের লোকপাল আন্দোলনও বড় ধাক্কা খেল। এবং সবচেয়ে
দুঃখের ব্যাপার, তাঁর পুরনো শিষ্য দুর্নীতির ইস্যুতেই ভরাডুবির মুখোমুখি হয়েছেন। এই তথ্য আন্নাজির পক্ষেও কম ধাক্কা নয়। মহান ভারতীয় গণতন্ত্রের এও এক বিরাট শিক্ষা। গলায় মাফলার সামান্য ‘ওয়াগন আর’ গাড়ি চড়া লোকপাল আন্দোলনের সহযোদ্ধা মানুষের আস্থা হারালেন শিশমহল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আবগারি দুর্নীতির টানাপোড়েনে। সোনার জল করা কমোডে দু’দিন পর প্রাতঃকৃত্য সারবেন অন্য কেউ! সবটাই হয়েছে পাঞ্জাবে আপের সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর। এত পয়সা ও ক্ষমতায় মাথা ঘুরে গিয়েই বিপর্যয়। সঙ্গে দশ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। তাই কেজরিওয়াল ও সিশোদিয়া নিজের কেন্দ্রে জিততেও ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু বিপর্যয় যতই বড় হোক, রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু হয় না। রাজনীতি হাজারো সম্ভাবনারই চটকদারি শিল্প।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে গড়া ইন্ডিয়া জোটকে ছত্রভঙ্গ করার দায় কার? এখনও সময় আছে, সোনিয়াজি, রাহুল গান্ধী ঘর অন্ধকার করে একবার ভাবুন। এভাবে চললে গেরুয়া দাপট আরও বাড়বে। বিরোধীরা ক্রমেই পিছু হটবে। বিহার, অসম, বাংলা এবং দক্ষিণের কেরল ও তামিলনাডুর ভোটের আগে এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে দেশের গণতন্ত্র আরও বিপন্ন হবে। শুধু এক দেশ এক নির্বাচন বিল আটকাতে হলে এককাট্টা হতেই হবে। আর খুব বেশি দেরি হওয়ার আগে লড়াকু কোনও নেতা-নেত্রীকে সামনে রেখে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হোক বিরোধী শিবির। সোনিয়াজি আপনার পরিবার মহান, কিন্তু এই মুহূর্তে বিজেপি’র সঙ্গে লড়তে হলে গোটা দেশে একজনই আছেন। তিনি স্ট্রিট ফাইটার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।