হাড় জোড়ার কেরামতি
ডাঃ সৈকত সাউ
সহকারী অধ্যাপক, অর্থোপেডিক, মেডিক্যাল কলেজ
হাড়ের রিকনস্ট্রাকশন বা পুনর্গঠন করতে হলে দরকার হয় অস্ত্রোপচারের। যা একজন উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন অর্থোপেডিক সার্জনই করতে পারেন। এখন তো এই অর্থোপেডিক সার্জারি নামটাই ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে। তার বদলে বলা হচ্ছে অ্যাডাল্ট (বড়দের ক্ষেত্রে) রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি আর ছোটদের পেডিয়াট্রিক রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি।
বয়স্কদের কোমর বা হাঁটু প্রতিস্থাপন এখন খুবই প্রচলিত। কিন্তু এইধরনের অস্ত্রোপচার বা যেকোনো ধরনের হাড়ের রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি করার কয়েকটি শর্ত আছে। এক্ষেত্রে রোগীর হাড় কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাঁর বয়স ইত্যাদি অন্যতম মূল বিচার্য বিষয় হয়ে ওঠে। আসলে কোমর বা হাঁটু কিন্তু আমরা রিপ্লেস বা বদলে দিই না, বরং রি-সারফেস করি। অর্থাৎ যে অংশে দুটি হাড়ে ঘষা লাগছে সেই জায়গাটি কেটে বিশেষ ধরনের ধাতু বসিয়ে দেওয়া হয়। তবে, এই ধরনের অস্ত্রোপচার কোনও কারণে ব্যর্থ হলে রিপ্লেস করার বিষয়টি আসবে। আবার রিপ্লেস বিষয়টি টিউমার বা ক্যান্সার রোগীদের ক্ষেত্রেও আসবে। কারণ তাঁদের হাড় সম্পূর্ণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। তাই ওই অংশটি কেটে বদলে দেওয়া বা রি-সেকশন করা ছাড়া উপায় থাকে না। এক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে যাওয়া হাড়ের জায়গায় যেটা বসানো হয় তাকে বলে মেগাপ্রস্থেসিস। যত ভালো মানের মেগাপ্রস্থেসিস হবে তার আয়ু তত বেশি হবে।
শরীরের যে কোনও হাড়েরই পুনর্গঠন সম্ভব। মানবশরীরের পায়ের ফিবুলা হলো সেই হাড় যা থেকে আমরা শরীরের অন্য যে কোনও হাড় পুনর্গঠন করে দিতে পারি। এছাড়া কোমরে ইলিয়াট্রিস্ট বলে একটি হাড় আছে যা কার্যত মানব শরীরের বোন–ব্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করে। হাত-পা তো বটেই, চোয়াল বা আঙুলের মতো জটিল জায়গার হাড়েরও পুনর্গঠন সম্ভব। ছোটদের ক্ষেত্রে সাধারণত ফিবুলা আর বড়দের ক্ষেত্রে কোমরের হাড় দিয়েই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হাড়ের পুনর্গঠন করে থাকি। এখানে বলে রাখা ভালো, পায়ে শুধু বাড়তি হাড়ই নয়, বাড়তি মাংসপেশিও থাকে। যেগুলি শরীরের অন্য জায়গায় প্রতিস্থাপন করা সম্ভব।
এই ধরনের অস্ত্রোপচার খুব জটিল এবং ব্যয়সাপেক্ষ। একটি অস্ত্রোপচারের পিছনে থাকে দক্ষ চিকিৎসকদের টিম। তাই বড় প্রতিষ্ঠান ছাড়া এই অস্ত্রোপচার করানো ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তবে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মতো রাজ্যের সুপার স্পেশালিটি সরকারি হাসপাতালগুলিতে তো এখন একেবারে নিখরচায় এই চিকিৎসা মিলছে।
লিখেছেন: নীতীশ চক্রবর্তী
ব্রেস্ট রিকন্সট্রাকশন
ডাঃ দীপ্তেন্দ্র সরকার
অধ্যাপক, সার্জারি, পিজি
আগে কী হতো: প্রাথমিক পর্যায়ে যখন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ব্রেস্ট রিকনস্ট্রাকটিভের প্রয়োজনীয়তা বুঝলেন, তখন পেট ও পিঠের দিক থেকে পেশি কেটে তা ঘুরিয়ে ব্রেস্ট পুনর্গঠন হতো। এতে রোগীর পিঠে ও কোমরে একটা দাগ থাকত। তলপেটে কিছু সমস্যাও দেখা দিত। পরে সিলিকন প্রস্থেসিস নারীর রূপ সচেতনতা, ব্যক্তিত্ব ও মানসিক স্ট্রেসে হয়ে উঠল মুশকিল আসান। মহিলার ব্রেস্টের মাপ নিয়ে সেই সমান মাপের সিলিকন প্রস্থেসিস আনা হতো। যে ব্রেস্টটি অস্ত্রোপচারে বাদ যাবে, তার চামড়ার নীচে এই প্রস্থেসিস বসানো হতো। ধরে রাখার জন্য এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় পেশি যোগ করা হতো।
পরে হার্নিয়ার নেট বা মেসের মতো ব্রেস্টের জন্যও এল নেট। পশুর চামড়া থেকে যাবতীয় অ্যান্টিজেন সরিয়ে তার কাঠামো ও কোলাজেনকে রেখে এই মেস বা নেট তৈরি হয়। ফলে ত্বকে কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। অস্ত্রোপচারের সময় ব্রেস্ট যেখানে ছিল, সেখানে এটি সেলাই করে তার মাঝে বটুয়া ব্যাগের মতো করে সিলিকন প্রস্থেটিসকে আটকে দেওয়া হল। এতে ব্রেস্টের গঠন, নমনীয়তা সবই সুস্থ, স্বাভাবিক মহিলার মতোই রয়ে গেল।
কোন ক্ষেত্রে রিকন্সট্রাকশন: ক্যান্সার রোগিণীর প্রকৃত ব্রেস্টটি রক্ষা করা প্রধান লক্ষ্য হয়। বহুকেন্দ্রিক (মাল্টিসেন্ট্রিক) ক্যান্সারে আক্রান্ত মহিলার ব্রেস্ট রক্ষা করা সম্ভবপর হয় না। তখন করা হয়।
কখন করা উচিত: ব্রেস্ট ক্যান্সারের অপারেশনের সময়ই এই নেট বা মেস দিয়ে রিকনস্ট্রাকশন করে দেওয়া সম্ভব। এতে অতিরিক্ত ২০ মিনিট মাত্র সময় লাগে। রোগিণী পরের দিনই বাড়ি চলে যেতে পারেন। একে বলে প্রাথমিক ব্রেস্ট রিকন্সট্রাকশন। শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে দিন কয়েকের মধ্যেও এটি করা যেতে পারে। তবে যিনি মূল অস্ত্রোপচারের সময় করাননি, তাঁর ক্ষেত্রে মূল ওটির ২ বছর পর করা উচিত।
খরচ: পুরনো পদ্ধতিতে ব্রেস্ট রিকনস্ট্রাকশন করালে অপারেশনের খরচ খুব বেশি হয় না। তবে এতে অস্ত্রোপচারের ও হাসপাতালে থাকার সময় দীর্ঘ হয়। তলপেটে অস্বস্তি ও সমস্যার মতো কিছু অসুবিধাও আজীবন সঙ্গী হয়। তবে সিলিকন প্রস্থেসিসের মতো আধুনিক পদ্ধতিতে হাসপাতালে দীর্ঘদিন থাকার প্রয়োজন পড়ে না। রোগী সুস্থও হন দ্রুত। তবে খরচ সাধারণ পদ্ধতির চেয়ে প্রায় ১.৫-২ লক্ষ টাকা বেশি। সরকারি হাসপাতালে প্রচলিত পদ্ধতির অপারেশনে কোনও খরচই লাগে না। নেট-সহ সিলিকন প্রস্থেটিস অস্ত্রোপচারে কিছু খরচ পড়তে পারে।
লিখেছেন মনীষা মুখোপাধ্যায়
মুখ বদলের অপারেশন
ডাঃ রাজন ট্যান্ডন
অধ্যাপক, পিজি হাসপাতাল
এই তো বছর দেড়েক আগের কথা। বড় পর্দায় রিলিজ করল রণবীর কাপুরের ফিল্ম ‘অ্যানিমল”। সেই সিনেমার শেষলগ্নে দেখা গেল অ্যান্টি হিরো প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে হুবহু হিরোর মুখ পেয়ে গিয়েছেন। সেই দেখে দর্শকের কি শিহরণ! এই ভাবে সার্জারি করিয়ে একেবারে অন্য একটি মানুষের রূপ নিয়ে নেওয়ার ঘটনা তো আমরা যুগ যুগ ধরে সিনেমার পর্দায় দেখে আসছি। আর তা দেখতে দেখতে অনেকের অবচেতন মনে সত্যিই একটা বিশ্বাস জন্মে গিয়েছে, কেউ চাইলেই সার্জারির মাধ্যমে অন্য একজনের রূপ নিয়ে নিতে পারেন।
কিন্তু গল্পে গোরু গাছে চরতে পারে, বাস্তবে না। হ্যাঁ ফেসিয়াল রিকনস্ট্রাকশন সার্জারির মাধ্যমে মুখের কিছু বদল সম্ভব। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে অপারেশনের ফলে তাঁর ‘লুক’ একটু অন্যরকম হয়ে যায় ঠিকই। তা বলে অন্যের রূপ নিয়ে নেওয়াটা একটু বাড়াবাড়িই।
প্লাস্টিক সার্জারি বা রিকনস্ট্রাকশন নানা কারণে হতে পারে। একটা তো অবশ্যই কসমেটিক কারণে, অন্যটা মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টের অঙ্গ হিসেবে। এবার আসা যাক আসল কথায়। বার্ন ইনজুরির ক্ষেত্রে প্লাস্টিক সার্জারি অনেকেই করেন। তাতে কী সব ‘খুঁত’ ঢাকা সম্ভব?
এক কথায় উত্তর, না। ১০০ শতাংশ নিখুঁত এখনও করা সম্ভব নয়। তবে সেই ক্ষত অনেকটাই ঢেকে দিতে পারে এই রিকনস্ট্রাকশন সার্জারি। কিন্তু এক্ষেত্রে কোথায় ক্ষত রয়েছে এবং তা কতটা গভীর, তার উপর চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ভর করে।
কীরকম? সাধারণ আগুনে পোড়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই ক্ষত বেশি গভীর হয় না। এক্ষেত্রে রোগীর ত্বক ও ফ্যাটই মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টিস্যুর সেভাবে ক্ষতি হয় না। তখন সাধারণ স্কিন গ্রাফ্ট করলেই হয়ে যায়। শরীরের অন্য এক অংশ থেকে বিশেষ উপায়ে ত্বকের একটা অংশ কেটে ক্ষত অংশে লাগানো হয়।
এবার গভীর ক্ষতর চিকিৎসায় আসা যাক। সাধারণত আগুনের থেকে বৈদ্যুতিক শক লাগার কারণে যে বার্ন ইনজুরি হয়, তাতেই ক্ষত কিন্তু বেশ গভীর হয়ে যায়। এক্ষেত্রে রিকনস্ট্রাকশন সার্জারি তুলনায় একটু জটিল। যেহেতু একেকজনের ক্ষেত্রে ক্ষতের গভীরতা ও স্থান আলাদা হয়, তাই সার্জারির ধরণও আলাদা হয়ে যায়।
ধরা যাক, পুড়ে যাওয়ার ফলে কোনও রোগীর স্কিন, ফ্যাট তো বটেই, নার্ভ, টেন্ডন বা হাড়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে সবার আগে সেই ক্ষতস্থান ভালো করে পরিষ্কার করে নেওয়া হয়। কারও যদি দেহের ঊর্ধ্বাংশে গভীর ক্ষত রয়েছে। আমাদের পায়ে হাঁটুর নীচ থেকে লম্বা দু’টি হাড় থাকে। টিবিয়া ও ফিবুলা। কারও হাড় রিকনস্ট্রাকশনের ক্ষেত্রে এই ফিবুলার অংশ নেওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে মাংশপেশি, নার্ভ ও স্কিনও সেখান থেকে নিয়ে ক্ষত স্থানে বসানো যায়। তবে যে স্থান থেকে এই অংশ নেওয়া হচ্ছে, তার ফলে সেই অংশটি প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল, সেটা হলে চলবে না। এবার ক্ষত স্থানে ওই কম্পোজিট টিস্যুটি জোড়ার সময় শিরা ও ধমনীর সঙ্গে মিলিয়ে জুড়ে দিতে হয়। এই প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। একে বলা হয় রিকনস্ট্রাকটিভ মাইক্রো সার্জারি বলে। কোনও কোনও শিরা আকারে মানুষের চুলের থেকেও কয়েকগুণ সরু হয়। মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে সেই শিরা জুড়ে দেওয়া হয়। এতে ক্ষত স্থানে যে কম্পোজিট টিস্যু লাগানো হল, তাতে রক্ত চলাচল করতে পারে। একই ভাবে নার্ভও জোড়া দেওয়া হয়।
এখন কোনও কোনও ক্ষেত্রে একটি সার্জারিতে পুরো প্রক্রিয়া হয়ে যায়। আবার কোনও ক্ষেত্রে একাধিক সার্জারির প্রয়োজন পড়ে। ভারতে এই রিকনস্ট্রাকশন সার্জারির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে গত কয়েক দশকে। এই মুহূর্তে দুই হাতের রিকনস্ট্রাকশন সার্জারি ভারতেই বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে।
লিখেছেন সায়ন মজুমদার