ভোটের আগের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। আর সকলকে খুশি করেই নতুন উন্নয়নের দিশা দেখিয়ে গেলেন অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। বাজেট পেশের আগেই সরকারি কর্মচারীদের চার শতাংশ ডিএ বাড়িয়ে পুরনো ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ দিলেন তিনি। অন্যদিকে সম্পূর্ণ নিজের টাকায় বাংলার বাড়ি প্রকল্পে ১৬ লক্ষ নতুন আবাস নির্মাণে বরাদ্দ হল ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বাজেটে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের বরাদ্দ একই রেখে ৩৭ হাজার কিমি গ্রামীণ রাস্তা নির্মাণে ১ হাজার ৫০০ কোটি, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানে ৫০০ কোটির পাশাপাশি নদী তীরবর্তী মানুষদের উন্নয়নে ২০০ কোটি ও গঙ্গাসাগর সেতু নির্মাণে ৫০০ কোটি বরাদ্দ প্রমাণ করে যে, রাজ্য সরকার প্রকৃতই এবার পরিকাঠামো উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে বিপন্ন মানুষদের পাশে দাঁড়াতে চায়। আশাকর্মীদের মোবাইল দিতে ২০০ কোটি বরাদ্দ কার্যত তৃণমূল স্তরে প্রশাসনিক কাজে দ্রুততা আনার লক্ষ্যে। যাতে প্রত্যেকটি এলাকায় সরকারি পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া যায়। রাজস্ব ব্যয়ে লাগাম টেনে পরিকাঠামো খাতে খরচের ভারসাম্য চোখে পড়ার মতো। তবে এই বাজেটে কর্মসংস্থান, কৃষি, শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে বরাদ্দ একই। তুলনায় স্বাস্থ্যখাতে বেড়েছে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য। এই ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগকে সহায়তা দিতেও বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। একইভাবে কৃষক বন্ধু স্কিমে বরাদ্দ সামান্য কমিয়ে বাংলার কৃষি-সেচ প্রকল্পের বরাদ্দ প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। কৃষি পরিবহণ এবং কৃষি ক্ষেত্রে বিশ্ব ব্যাঙ্ক পরিচালিত প্রকল্পগুলিতেও বরাদ্দ বাড়িয়েছে রাজ্য সরকার। মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পে দ্বিগুণ বরাদ্দ করা হয়েছে পরিকাঠামো গড়তে। এমনকী বরাদ্দ বেড়েছে পরিকল্পনা খাতেও। এইসব পদক্ষেপই প্রমাণ করে, রাজ্য সরকার পাইয়ে দেওয়ার নীতিতে বিশ্বাস না রেখে পরিকাঠামো গড়ার দিকে ঝুঁকেছে। আবার প্রকৃত প্রয়োজন বুঝে সেই সব খাতে বরাদ্দ একই রাখা হয়েছে, অথবা বাড়ানো হয়েছে।
সামাজিক কর্মসূচিই যখন রাজ্যের অন্যতম ফোকাস এবং অর্থনীতি মূলত জনকল্যাণের লক্ষ্যে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই রাজ্যের বাজেটও মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা ভেবে তৈরি হয়। তার অন্যথা হল না এবারও। রাজ্যের মানুষের হাতে আরও টাকা ও নানা সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার ভাবনায় রচিত হল ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের বাজেট। বিরোধীরা এর সমালোচনা করে ঠিকই, কিন্তু তা স্রেফ রাজনৈতিক কারণে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা আর্থিক দায়বদ্ধতা ও আর্থিক সক্ষমতা গড়ে তোলার নামে জনগণকে কার্যত অর্থ না দিয়ে, সেই টাকায় বাজেট ঘাটতি কমিয়ে পরিকাঠামো উন্নয়নে জোর দিতে বলেন। তাতে লাভ হয় একচেটিয়া বৃহদ্পুঁজির। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন আলাদা। মমতা চান নানা প্রকল্পের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে দিতে, যাতে রাজ্যের মানুষ ভালো থাকে। এবং তাদের হাতে টাকা থাকলে, রাজ্যে ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে চাহিদাও ঠিক থাকে। এই স্থিরতা বজায় থাকলে বেসরকারি বিনিয়োগও আসবে এবং কর্মসংস্থান বাড়বে। কৌশলগতভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সচেতনভাবে বেছে নিয়েছেন দু’টি পথই। সেই লক্ষ্যে তিনি সাধারণের জন্য বরাদ্দ বাড়াচ্ছেন এবং একই সঙ্গে বেঙ্গল বিজনেস সামিট করছেন মুকেশ আম্বানি, আদানিদের নিয়ে। আগামী দিনে শিল্প চিত্র তাই উজ্জ্বল, তৈরি হচ্ছে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা। মমতার সরকার তাই শুধুই রাজ্যবাসীকে ভাতাজীবী করে রাখছেন—বিরোধীদের এই অভিযোগ টেকে না। বরং এবারের বাজেট নিয়ে আলোচনার আগে প্রথম প্রয়োজন কেন্দ্রের প্রবল বিমাতৃসুলভ আচরণ নিয়ে কথা বলা। কারণ, এখনও কেন্দ্রের সরকারের কাছে রাজ্যের প্রাপ্য ১ লক্ষ ৭১ হাজার কোটি টাকা। ন্যায্য প্রাপ্যটুকু পেলেই এ রাজ্যের পরিকাঠামো ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন হতে পারত। সমালোচনার বদলে যদি এক স্বরে রাজ্যের স্বার্থে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রাপ্য আদায়ের আন্দোলন হতো, তাহলে প্রকৃতই রাজ্যের উন্নয়নে গতি আসত। সেই দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে রাজ্যের উন্নয়ন নিয়ে সংকীর্ণ সমালোচনা ও রাজনীতি চলতেই থাকছে।
প্রাপ্য না পেলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমাণ করে দিয়েছেন, তিনি মাথা ঝোঁকাবেন না। আর জনগণের পাশ থেকেও সরে যাবেন না। এবারের বাজেটে যেভাবে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কৃষক বন্ধু সহ সমস্ত প্রকল্পে বরাদ্দ হয়েছে, তাতে এরপর বিস্ময়ে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলতেই পারে, ‘এত প্রস্তাব! টাকা কোথায়? তাহলে কি আরও ঋণ নেবে রাজ্য?’ বাজার অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ এবং বিরোধীরা হয়তো বলবেন, এতে রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্য দুর্বল হচ্ছে। ঋণ শোধ না করে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি হচ্ছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের নিরিখে সব রাজ্যের মধ্যে এই রাজ্যের স্থান ষষ্ঠ। বৃহদ্পুঁজির বিকাশ ছাড়াই ঘরোয়া কাজকর্মে, অসংগঠিত ক্ষেত্রে ও কৃষির মাধ্যমে দেশের অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় এগিয়ে। সারা দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এই রাজ্য সপ্তম। কৃষি, শিক্ষা, ক্ষুদ্র শিল্প সহ ১৯টি ক্ষেত্রে এই রাজ্য দেশের মধ্যে প্রথম। স্বভাবতই উন্নয়ন আসছে এবং আসবে এই সব ক্ষেত্রের মাধ্যমে। তাই বাজেটে এই সব ক্ষেত্রেই আরও জোর দেওয়া হল।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন, এই সব কথার আড়ালে আরও একটা সত্য আছে, যেটা রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। রাজ্য সরকার যত টাকা নানা প্রকল্পের মাধ্যমে খরচ করছে, যত ভাতা বা অনুদান দিচ্ছে, তার একটা অংশ ফিরছে রাজ্যের কোষাগারেই। প্রতিটি কেনাবেচা বা যে কোনও লেনদেনের উপর প্রাপ্য জিএসটি হিসেবে রাজস্ব আয় বাড়ে এবং তাতে রাজ্যের মানুষকে ভালো রেখেই উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হয়। কিন্তু এইখানেই চরম আঘাত দিচ্ছে কেন্দ্র। প্রাপ্য জিএসটি বাবদ অর্থ এবং ১০০ দিনের কাজ সহ বিভিন্ন প্রকল্পে টাকা না দিয়ে বাংলার উন্নয়ন স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে তারা। তাই রাজ্যের উন্নয়নে বিকল্প পথে ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও মাঝারি পুঁজির বিকাশ ঘটাতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। গত বাজেটের হিসেব জানাচ্ছে, এই রাজ্যের আয় আর ব্যয় প্রায় সমান। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি মাত্র ২ কোটি টাকা ছিল, অর্থাৎ অর্থনীতি পরিচালনায় রাজ্যের যথেষ্ট দক্ষতা ও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কিন্তু রাজস্ব ঘাটতি ৩৬ হাজার কোটির বেশি, আর রাজকোষ ঘাটতি ৬৯ হাজার কোটির বেশি। এর সবটাই কেন্দ্রের কাছ থেকে প্রাপ্য অর্থ না পাওয়ার কারণে। যে মুহূর্তে বকেয়া অর্থ এসে যাবে, সেই সময় থেকেই রাজ্যের কোষাগারে উদ্বৃত্ত হবে এবং সুদ বাবদ যে ৭৬ হাজার কোটি টাকা দিতে হচ্ছে, সেটার ‘আসল’ও পরিশোধ করা যাবে। তাই ঋণ বাড়ছে বলে আতঙ্কের কিছু নেই। পাওনা টাকা পেলে রাজ্য তা শোধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
ঠিক এই পরিপ্রেক্ষিতে এবারের বাজেট বিচার করে দেখা দরকার। রাজস্ব ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ ও রাজকোষের ঘাটতি কমাতে নিজের রাজস্ব আয়ের সূত্র বাড়াতে চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য কী করলেন? মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের নিরিখে ঋণ ও সুদের অনুপাত কমাতে বা নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে এবং বাংলার মূল ক্ষেত্র বিশেষে বিনিয়োগ একই রেখে তিনি স্থিতবস্থার দিকেই হেঁটেছেন। কর বাবদ ও কর বহির্ভূত রাজস্ব সংগ্রহ বাড়িয়ে উন্নয়নের হার অপরিবর্তিত রেখে দীর্ঘমেয়াদে ঋণের বোঝা কমিয়ে আনতে এই বাজেট সাজানো হয়েছে। সব মিলিয়ে এই বাজেট রাজ্যের উন্নয়নের গতি ধরে রাখবে। সঠিক পথেই এগিয়েছেন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য।
লেখক: সাংবাদিক ও অর্থনীতির বিশ্লেষক