বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ

ভারতের ডিপসিক মোমেন্ট
সুদীপ্ত রায়চৌধুরী

‘সবার মুখে একটা কথা প্রায়ই শুনি... কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌড়ে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে কমপক্ষে এক-দু’বছরের ব্যবধান থাকবেই। কিন্তু বাস্তবে ব্যবধান সময়ের নয়। আসল ব্যবধান হল নিজস্বতা ও অনুকরণের মধ্যে। যদি সেখানে পরিবর্তন না আসে, তাহলে চীনকে আজীবন অনুগামী হয়েই থেকে যেতে হবে।’ বছরখানেক আগে এক সাক্ষাৎকারে কথাগুলি বলেছিলেন লিয়াং ওয়েনফেং। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সংস্থা ‘ডিপসিক’-এর সহ প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও।
লিয়াং ওয়েনফেং নামটা অবশ্য তখন একেবারেই অচেনা। হবে নাই বা কেন! সাক্ষাৎকারের মাত্র কয়েক মাস আগে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে হ্যাংঝাউতে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিষয়ক প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন তিনি। তাও আবার নিজের তৈরি করা একটি হেজ ফান্ডের অর্থ ব্যবহার করে। ‘প্রতিষ্ঠান’ শব্দটার পরিধি যতটা বড়, তার মধ্যে বোধহয় তখনও ডিপসিককে ধরা যায় না। বরং ‘স্টার্ট আপ’ বললেই বুঝতে সুবিধা হয়। কিন্তু চীনের বাজারে এমন স্টার্ট আপ নতুন বা বড় কোনও বিষয় নয়। শয়ে শয়ে রয়েছে। তার মধ্যে দাঁড়িয়েও বাকিদের থেকে একটু অন্যরকম স্বপ্ন দেখেছিলেন ঝেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও ইলেক্ট্রনিক ইনফর্মেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়ুয়া লিয়াং। তিনি বিশ্বাস করতেন এআই দুনিয়ায় চীন আজীবন আমেরিকার অনুসরণকারী হিসেবে থাকতে পারে না।
নিজের স্বপ্নের উপর বিশ্বাস, আর তা সত্যি করার জন্য যথাযথ পরিকল্পনা-এই দুয়ের মিশেলে কী কী হতে পারে, সময়ে সময়ে তার সাক্ষী হয়েছে ইতিহাস। লিয়াংয়ের স্বপ্নপূরণও কিছুটা সেরকমই। চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি বাজারে আসে ‘ডিপসিক-আর ১’। নতুন এই ‘ওপেন সোর্স রিজনিং মডেল’ বাজারে পা রাখতেই তোলপাড় পড়ে যায় বিশ্বজুড়ে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল ২০২২ সালে। ওপেনএআই চ্যাটজিপিটি বাজারে ছাড়ার পর। তবে সেই তুলনায় এবারের ছবিটা বেশ অনেকটাই আলাদা। আসলে ডিপসিক ওপেন সোর্স হওয়ার কারণে যে কোনও ব্যবহারকারী এটিকে ডাউনলোড করে নিজের মতো করে ব্যবহার করতে পারবেন। চীনের সংস্থার এই ঘোষণার পরে প্রথম ধাক্কা এসে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজারে। বিশ্বের প্রথম সারির এআই চিপ প্রস্তুতকারক সংস্থা ‘এনভিডিয়া’-র শেয়ার পড়ে যায় প্রায় ১৭ শতাংশ। একদিনে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ হাজার কোটি ডলারে, ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৫০ লক্ষ কোটি টাকা! ধস নামে ব্রডকম, মাইক্রোসফ্ট, গুগল, ন্যাসড্যাকের শেয়ারেও। চাপে পড়ে যায় ওপেনএআইয়ের ‘চ্যাটজিপিটি’। 
চাপ যে শুধু মার্কিন শেয়ার বাজার বা বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার উপরেই পড়েছে এমনটা নয়, চীনের এই চমক উদ্বেগে ফেলে দিয়েছে সদ্যনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও। নাহলে শপথগ্রহণের মাত্র কয়েকদিনের মাথায়, হানিমুন পিরিয়ডের মধ্যেই চীনের এআইকে নিয়ে মুখ খুলতে হয় বিশ্বের সর্বশক্তিধর দেশের প্রেসিডেন্টকে! ট্রাম্প সাফ বলেছেন, ‘ডিপসিক যে ঝড় তুলেছে, তাতে মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির ঘুম ভাঙা উচিত।’
এখানেই সাফল্য লিয়াং ওয়েনফেংয়ের। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে অবিসংবাদী ‘নেতা’ বললে প্রথমেই মাথায় আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায় রাজত্বের প্রায় পুরোটাই ওপেনএআই, গুগল, মেটা, মাইক্রোসফ্ট, অ্যামাজন, আইবিএম, এনভিডিয়া, অ্যাডোবে, অ্যানথ্রোপিকের মতো বহুজাতিক টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলির দখলে। আর এর প্রত্যেকটিরই জন্ম মার্কিন মুলুকে। আপাতত এদের হাত ধরেই বাজারে লগ্নি হচ্ছে কোটি কোটি ডলার। কারণ এখান থেকেই তো আসবে ভবিষ্যতের মুনাফা। কিন্তু ওয়েনফেংয়ের স্টার্ট আপের হাত ধরে সেই বাজারে থাবা বসিয়েছে চীন।
শুধু বাজার নয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ার এই নব অধ্যায়ে প্রযুক্তি ও সেই খাতে খরচও কয়েক গুণ কমিয়ে চমক দিয়েছেন লিয়াং। বর্তমানে বেজিংকে অত্যাধুনিক এনভিডিয়া এআই চিপ রপ্তানি বন্ধ রেখেছে ওয়াশিংটন। কিন্তু ডিপসিক তাদের এআই মডেলের জন্য ব্যবহার করেছে মাত্র ২ হাজার এনভিডিয়া এইচ-৮০০ জিপিইউ (গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট)। তা নিয়েই চ্যাটজিপিটি ৪-কে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি লিয়াংয়ের। খরচের হিসেবও বেশ আকর্ষণীয়। ডিপসিকের ‘আর-১’ মডেল তৈরিতে খরচ হয়েছে ৫৬ লক্ষ মার্কিন ডলার। অথচ ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপিটি-৪ তৈরিতে খরচ পড়েছে ১০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি। 
এ থেকে দুটো বিষয় দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। প্রযুক্তি আর অর্থ কোনওটাই যে সাফল্যের পথে বড় কোনও বাধা নয়, তা একেবারে হাতেকলমে দেখিয়ে দিয়েছেন লিয়াং। আগামীতে সেই পথেই এগতে পারে ভারতও। কম খরচে উচ্চমানের ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল হাতের নাগালে এলে বদলে যাবে ভারতীয় এআই মার্কেটের ছবিটা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেই মডেল যেমন কার্যকর হবে, তেমনই বাড়বে ব্যবহারকারীর সংখ্যাও। তার জন্য প্রয়োজন ডিপসিকের মতো ওপেন সোর্স। এই ধরনের প্রযুক্তি পেলে ভারতীয় স্টার্টআপগুলির কাজ আরও সহজ হবে। ইতিমধ্যে অনেকেই ডিপসিক মডেলের লোকাল ইস্টলেশন তৈরি করে ফেলেছে। ফলে তাদের আর চীনে থাকা সার্ভারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে না। আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো এদেশের বাজারেও রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছে ডিপসিক। মূলত বিনামূল্যে প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার কারণেই। অ্যাপফিগারের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ডিপসিকের মোট ডাউনলোডের ১৫.৬ শতাংশই হয়েছে ভারতে। এই পরিস্থিতিতে দেশের ডিজিটাল জনতার মন জয়ে ময়দানে নেমেছে মোদি সরকার। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব জানিয়েছেন, ১০ মাসের মধ্যে নিজেদের এআই অ্যাপ আনবে ভারত। দেশের প্রয়োজনীয়তা বুঝেই তৈরি করা হচ্ছে এআই মডেলগুলি। ডিপসিক এআই মাত্র ২ হাজার জিপিইউ ও চ্যাটজিপিটি ২৫ হাজার জিপিইউ দ্বারা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। সেখানে ভারতে তৈরি নতুন এআই মডেলটি ১৫ হাজার জিপিইউ দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হবে। আর জিপিইউ প্রশিক্ষণ যত বেশি হবে, কোনও এআই চালিত অ্যাপের দক্ষতাও ততই বাড়বে। তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রীর ঘোষণার দিনকয়েক পরে, ২০২৫-২৬ কেন্দ্রীয় বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বলে জানান কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। ২০২৩ সালে কৃষি, স্বাস্থ্য ও পুনর্নবীকরণযোগ্য শহরের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কেন্দ্রের তরফে ঘোষণা করা হয়েছিল। এবার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কেন্দ্র স্থাপিত হবে। দেশের এআই বিকাশের ক্ষেত্রে নির্মলার এই ঘোষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু কিছু প্রশ্ন আছে। বছর বছর নানা প্রকল্প ঘোষণা হচ্ছে। ভালো কথা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না কেন? আসলে এর জন্য দায়ী গতানুগতিক স্রোতে গা ভাসিয়ে আমাদের ছক ভাঙতে না চাওয়ার সুললিত স্বভাব। আমরা পড়ছি। জানছি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণাও করছি। মেধায় কোনও কমতি নেই। কিন্তু দুনিয়াকে চমকে দেওয়ার মতো এআই মডেল তৈরি করার কাজে তা ব্যবহার হচ্ছে না। তাহলে কীসে হচ্ছে? না, যে সমস্ত প্রযুক্তি হাতের কাছে রয়েছে, তা দিয়ে চলছে নানা অ্যাপ্লিকেশন তৈরির কাজ। এই ভাবনাচিন্তায় পরিবর্তন না এলে ছবিটা বিশেষ বদলাবে না। আমেরিকা, চীনের তৈরি করা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে আজীবন। থাকতে হবে বেশ কয়েক বছর পিছিয়েই। নিজস্বতা ও অনুকরণের মধ্যেকার ব্যবধান যেমনটা হয় আর কী।
কথায় বলে, ‘নেসেসিটি ইজ দ্য মাদার অব অল ইনভেনশন’। ডিপসিক নিয়ে আজ বিশ্বজুড়ে যতই লাফালাফি হোক, বাঘা বাঘা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার বিশেষজ্ঞরা এই মডেলকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিন না কেন, তা কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। লাগাতার দু’বছর নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে, রাতের পর রাত জেগে কয়েকশো ইঞ্জিনিয়ার-গবেষক মিলে এই এআই মডেলটি তৈরি করেছেন। আমাদেরও নজর দিতে হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক মৌলিক গবেষণায়। সরকার কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ দেবে। পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে অন্যান্য সংস্থাকেও। গবেষণার জন্য দিতে হবে সময়, অর্থ। কবে সরকারের তরফে কী প্রযুক্তি আনা হবে, সেদিকে হা-পিত্যেশ করে চেয়ে না থেকে জোর দিতে হবে স্টার্ট আপে। যেমন ডিপসিকের বাড়বাড়ন্ত দেখে এগিয়ে এসেছেন ওলার সিইও ভবীশ আগরওয়াল। তাঁর তৈরি করা ইউনিকর্ন স্টার্টআপ ক্রুট্রিম ইতিমধ্যে বেশ কিছু নতুন ‘ওপেন-সোর্স’ এআই মডেল প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি, ভারতের জন্য উন্নতমানের এআই প্রযুক্তি তৈরির জন্য ক্রুট্রিমে এবছর ২ হাজার কোটি ও আগামী বছর ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে বলেও জানিয়েছেন ৩৯ বছরের এই উদ্যোগপতি। তবে একটা ক্রুট্রিমে কিছু হবে না। ময়দান অনেক বড়। এই লড়াইয়ে আমেরিকা, চীনের মোকাবিলা করতে হলে এগিয়ে আসতে হবে আরও অনেক সংস্থাকে। সে বড়-মাঝারি সংস্থা বা স্টার্ট আপ—যাই হোক না কেন। ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখাতে হবে। প্রয়োজনে তথ্য বিনিময় করতে হবে। আনতে হবে ওপেন সোর্স মডেল। যারা এগিয়ে রয়েছে কয়েক পা, তারা যদি নতুনদের সাহায্য না করে, লক্ষ্যপূরণ হবে না। একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগতে পারলে তবেই সফল হবে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র স্বপ্ন।
আসলে আমাদের সব আছে। শুধু দরকার লিয়াং ওয়েনফেংয়ের মতো স্বপ্ন দেখার সাহস। আর সেই স্বপ্ন সত্যি করার তাগিদ।
12h 12m ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বিশেষ কোনও পারিবারিক কারণে মানসিক দুশ্চিন্তা বাড়তে পারে। কাজকর্মের ক্ষেত্রে বিশেষ  সুখবর পেতে পারেন।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৬.০৩ টাকা৮৭.৭৭ টাকা
পাউন্ড১০৭.২৮ টাকা১১১.০৪ টাকা
ইউরো৮৯.২২ টাকা৯২.৬১ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা