বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ

মানে-বদল

ডঃ সায়ন্তন মজুমদার: আসছে অশোক, পলাশ, শিমুল, পারুলে রাঙানো ৮ ফাল্গুন। আজ না হয় ফেব্রুয়ারির একুশের বদলে বাংলা তারিখটাই আগে থাকুক। একটি ভূখণ্ডের স্বাধীনতার জন্য নয়, শুধুমাত্র ভাষার জন্য মানুষ শহীদ হয়েছেন। সেই মহান বিপ্লব শহীদ শব্দটির ধর্মীয় তকমা মুছে দিয়েছে। বদলে করে তুলেছে দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জনকারী হিসেবে। আরবি এই শব্দটির আসল অর্থ ইসলাম বা ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্যের সাক্ষী। যে কারণে আজও নামাজের আজানে শাহাদাত বা সাক্ষ্যদানের কথা বলা হয়ে থাকে।
এমন কিছু শব্দই মূল আলোচ্য। যেগুলির প্রকৃত অর্থ আমরা মনে রাখিনি। একসময় বাংলা নামের প্রতিবেশী দেশটি ভাষা ও মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আজ সেখানে যা ঘটে চলেছে, তার ঠিক আগের সময়ের কথা বলি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কথায় উঠে এসেছিল রাজাকারদের প্রতি ক্ষোভ। সেই রাজাকার কারা? পূর্ব পাকিস্তানের জেনারেল টিক্কা খানের গড়া আধাসেনারা ‘রাজাকার’ নামে পরিচিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীদের উপর অমানবিক নির্যাতনে অভিযুক্ত ছিল তারা। অথচ রাজাকার শব্দটির প্রকৃত অর্থটি কিন্তু খুব সুন্দর—স্বেচ্ছাসেবক।
ভারতের পূর্বদিকের মতো পশ্চিম দিকের প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও একই দৃষ্টান্ত রয়েছে। আফগানিস্তানের তালিবান গোষ্ঠী যে একটি নৃশংস জঙ্গি সংগঠন, সে প্রমাণ আফগান জনসাধারণের পাশাপাশি প্রায় পনেরোশো বছরের প্রাচীন বুদ্ধমূর্তিও টের পেয়েছিল। এই ফেব্রুয়ারিতেই বামিয়ানের সেই মূর্তি ধ্বংসের ফতোয়া জারির পঁচিশ বছর হতে চলল। কিন্তু যাবতীয় অশান্তির হোতা এই ‘তালিবান’ শব্দটির মূল অর্থ শিক্ষার্থী। অবশ্য অন্যায় রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির সঙ্গতে ছাত্রদল ভীষণ বিভীষিকার কারণ হতেই পারে।
এখন পাড়ায় পাড়ায় বাচ্চাদের জন্য কিন্ডারগার্টেন স্কুল খোলার হিড়িক পড়ে গিয়েছে। জার্মান এই শব্দটির অর্থ আদতে ছিল ‘শিশুদের বাগান’। সদ্য শেষ হওয়া মহানগরীতে বছরের প্রথম বড় উৎসব বইমেলার এই বছরের থিম কান্ট্রি জার্মানির পরিপ্রেক্ষিতে এর জিগির তোলা বেশ প্রাসঙ্গিক। জিগির বা জিকির বলতে আমরা প্রচার বুঝি। এই আরবি শব্দটির অর্থ ‘ঈশ্বরের নামজপ’। শুধুমাত্র বইকে ঘিরে এত এলাহি জৌলুস সত্যিই বিস্ময়কর। বাংলায় এই জৌলুস শব্দটির মানে আড়ম্বর বা জাঁকজমক। কিন্তু আদিতে সেই আরবি শব্দটির একটি অর্থ ছিল—রাজ্যাভিষেক। আবার বড় বা বিশাল ব্যাপার বোঝাতে আমরা এলাহি শব্দটি প্রায়ই ব্যবহার করি, যার প্রকৃত অর্থ ঈশ্বর।
চলতি মাসের সাপেক্ষে কিছু শব্দ নিয়ে আলোচনা করা যাক। বাংলায় বহু ব্যবহারের ফলে সেই সমস্ত শব্দের সঠিক প্রতিশব্দ পাওয়াই ভার। মাসপয়লা ও মাসের মাঝে বেরিয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্যের বাজেট। ফরাসি ভাষা থেকে আসা এই শব্দটির মানে ছিল ছোট ব্যাগ বা থলে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে ব্যাগ-পকেটে যতই টান পড়ুক না কেন, আর্থিক আয়-ব্যয় বিবরণীর থেকে বাজেট শব্দই বাঙালির অভিধানে ঢুকে পড়েছে। এই দাম শব্দটির মূলে রয়েছে গ্রিক ভাষার একটি শব্দ ‘দ্রাখ্মে’, যা এক রকমের মুদ্রাকে বোঝাত। তারপর সংস্কৃত ‘দ্রম্য’, প্রাকৃত ভাষার ‘দম্ম’ হয়ে বাঙালিকে এখন তার ‘দাম’ দিতে হচ্ছে।
বিয়ের মরশুমে গয়নার জন্য স্যাকরারাই আমাদের প্রধান ভরসা। তার উৎপত্তির মূলেও রয়েছে এক রকমের মুদ্রা—আরবি সিক্কা। সিক্কাকার থেকেই স্যাকরা নামের উদ্ভব। আবার এই বিয়ে এবং বিবাহ আগেকার দিনে এক ছিল না। যে অনুষ্ঠানে কোনও কিছু বা কাউকে বিশেষভাবে বহন করা হতো, তাকেই বলা হত বিবাহ। কারণ মণ্ডপ থেকে কনেকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে যেত পাত্র। তাই একে বলা হতো উদ্বাহ বন্ধন। তখন সংস্কৃত ভাষায় বর মানে সদ্য বিবাহিত ব্যক্তিকে না বুঝিয়ে কন্যা নির্বাচনকারীকে বোঝানো হতো। বিয়ে প্রসঙ্গে কনের কথা আসবেই। আগে বাড়ির পরিচারিকা সম্পর্কে অনেকে ‘ঝি’ শব্দটি ব্যবহার করতেন। কিন্তু কয়েকশো বছর আগে ঝি মানে সকল কন্যাদেরই বোঝানো হতো। এখন অবশ্য একথা বললে যে কেউ নারী হেনস্থার কেস খেয়ে যেতে পারে। বর্তমানে সেই শব্দের অর্থবোধের অবনমন ঘটলেও আমরা অন্য শব্দের সঙ্গে জুড়ে শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। যেমন—ভাইঝি, বোনঝি, ননদিনী প্রসঙ্গে ঠাকুরঝি শব্দে। ঠিক যেমন মুনিষ বলতে আমরা মজুর বুঝলেও আখেরে শব্দটির মূলে কিন্তু রয়েছে মনুষ্য বা সকল মানুষ।
বিয়ের কথা ছেড়ে ভালোবাসার কথায় আসি। বিশেষ করে এ মাসেই তো সাড়ম্বরে পালিত হয় ভ্যালেন্টাইনস সপ্তাহ। বর্তমানে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের অনুষঙ্গে এর মানে প্রেমিক-প্রেমিকাকে বোঝালেও মূল ল্যাটিন শব্দ অনুযায়ী তার অর্থ ছিল শক্তি। এখন ধরে নেওয়া যেতে পারে তা ভালোবাসা বা সোহাগের শক্তি। সেই সোহাগ শব্দটি কিন্তু এসেছে সৌভাগ্য শব্দ থেকে। দু’টির মধ্যে রয়েছে নিবিড় যোগ। আসল সোহাগ পাওয়ার জন্য সৌভাগ্যের দরকার তো হয়ই। যাই হোক, সেই সোহাগী সপ্তাহের মধ্যে প্রেমপ্রস্তাব জ্ঞাপনের দিনও রয়েছে। তার জন্য একটু নিরিবিলি বা নির্জন জায়গা প্রয়োজন। এই নিরিবিলি বলতে আগে কিন্তু বোঝাত আবিল বা দূষণমুক্ত। যা সংস্কৃত ‘নিরাবিল’ শব্দ থেকে এসেছিল।
প্রায় সাতশো বছর আগে বাঙালি প্রেমের প্রস্তাব পাঠাত পান-সন্দেশ দিয়ে। পান শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত পর্ণ শব্দ থেকে, যার অর্থ পাতা। আবার সংস্কৃতে সন্দেশ বলতে বোঝাত যা সঠিকভাবে সবকিছু জানায় অর্থাৎ সংবাদ। তখন ডাকবিভাগ ছিল না, তাই সংবাদবাহকের হাতে কিছু মিষ্টি তুলে দেওয়া হতো। ধীরে ধীরে বাংলায় তাই সন্দেশের অর্থ দাঁড়ায় মিষ্টি জাতীয় খাবার। কিন্তু হিন্দিতে তা চিঠি হয়েই রয়ে গিয়েছে।
প্রণয়-প্রস্তাব দানের সময় মন একটু উদ্বেল বা বিচলিত, কিছুটা অশান্ত থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু সংস্কৃতে উদ্বেল বলতে অশান্ত না বুঝিয়ে বোঝানো হতো বেলাভূমিকে অতিক্রম করে। তবে ভাবের দিক থেকে এটা সত্যি যে দুর্গম মরুযাত্রার মতো কষ্ট কাটিয়েই তো দারুণ প্রেমসাগরের বেলাভূমিতে পৌঁছানো যায়। দারুণ বলতে আগেকার বাঙালি কিন্তু কাঠের শক্ত জিনিসকে বুঝত। এখন হয়তো তারা রঙিন কাঁচের বোতলের তরলকেই আত্মস্থ করে বেশি। যাই হোক, সকলেই সেই প্রেমদরিয়ায় পাড়ি জমাতে পারে না। অনেককেই চিৎপটাং হতে হয়। এই চিৎপটাং শব্দটি কিন্তু এসেছে সংস্কৃত চিত্রপটাঙ্গ থেকে। অর্থ ছিল চিত্রপট বা ছবির মতো অঙ্গ যার।
বাঙালির প্রেম দিবস সরস্বতী পুজো দিয়ে শুরু হওয়া ফেব্রুয়ারি শেষ হবে শিব-পার্বতীর বিয়ের রাত্রি অর্থাৎ মহাশিবরাত্রি দিয়ে। মাঝে ছিল শবেবরাত বা সৌভাগ্য রাতের পরব। প্রতি বছর বহু মানুষ শিবরাত্রির ভক্ত হন। এই ভক্ত শব্দটি অনেক আগে কিন্তু দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হতো। একটির ব্যবহার আজও রয়েছে কিন্তু যে অর্থটি লোপ পেয়েছে সেটি হল খাদ্য। সংস্কৃত ‘ভক্ত’, প্রাকৃত ভাষায় ‘ভত্ত’ হয়ে ভেতো বাঙালির ভাতে পরিণত হয়েছে। এখন ভাতের সঙ্গে ডালের কথা আসবেই। তার মধ্যে ১০ ফেব্রুয়ারি ছিল বিশ্ব ডাল দিবস। আর বাঙালি তো চালে-ডালে খিচুড়ি পাকাতে ওস্তাদ। এই ডাল কিন্তু সংস্কৃত শব্দ ‘দল’ থেকে এসেছে, যার অর্থ আলাদা করা বা ভাঙা বা পেষাই করা। আবার লুচির মূল উপাদান ময়দা শব্দটির যোগান কিন্তু হয়েছে গ্রিক শব্দ ‘সেমিদালিস’ থেকে। আবার সেখান থেকেই পায়েসের উপকরণ সিমাইকেও পেয়েছে বাঙালি।
শিবরাত্রিতে প্রতি প্রহরে শিবের মাথায় জল ঢালতে দুহিতারা যাবে মন্দিরে। প্রাচীন যুগে মন্দির বলতে শুধুমাত্র হিন্দুদের দেবতার বাড়ি বোঝাতো না, সকল মানুষের বাড়িই মন্দির নামে পরিচিত ছিল। অর্থাৎ রাম ও রহিম উভয়ের বাড়িই ছিল মন্দির। আবার দুহিতা মানে আমরা কন্যা বুঝলেও আগে এটি শুধুমাত্র গরুর দুধ দোহনকারী মেয়েদেরকেই বোঝানো হতো। শিবঠাকুরের পুজোর ভোগে কেউ কেউ খাজা নিবেদন করেন। ভোগ শব্দের মূলে ছিল উপভোগ বা যে কোনও খাদ্য। পরবর্তীতে তা হয়ে দাঁড়ায় শুধুমাত্র দেবতাকে নিবেদিত খাদ্যসামগ্রী। আবার সংস্কৃতের সেই ‘খাদ্য’ শব্দই প্রাকৃত ভাষায় ‘খাজ্জ’ হয়ে বাঙালির পাতে খাজায় পরিণত হয়েছে।
4d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

শাস্ত্র অধ্যয়নে গতি বৃদ্ধি ও পরীক্ষায় শুভ ফল লাভের সম্ভাবনা। নতুন কর্মপ্রাপ্তি হতে পারে। দাম্পত্যে...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৬.১১ টাকা৮৭.৮৫ টাকা
পাউন্ড১০৭.৮৫ টাকা১১১.৬২ টাকা
ইউরো৮৯.২২ টাকা৯২.৬১ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা