চন্দন বাঙ্গাল: পুনর্মুষিক ভব। ওই যে একজন তপস্বী তাঁর মন্ত্রবলে বিপন্ন ইঁদুরকে বেড়াল, বেড়ালকে কুকুর, কুকুরকে বাঘ বানিয়েছিলেন? গল্পটা মনে পড়েছে নিশ্চয়ই? বাঘ যখন তার উত্থান ভুলে গিয়েছিল, তপস্বী তখন পুনরায় তাকে পুনর্মুষিক ভব বলে ইঁদুরে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
আর মাত্র কয়েকটা দিন পরেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ২১ ফেব্রুয়ারি। বাংলা ভাষাভাষী প্রত্যেকটি নাগরিকের কাছে চোখ ভেজা আনন্দের দিন। বাংলাদেশীদের কাছে আত্ম আবিষ্কার ও আত্মপ্রতিষ্ঠার দিন। এসবের বাইরে অমর একুশের শ্রেষ্ঠতম গৌরব তপস্বীর, দেশ হিসেবে নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের রূপ দান করেছে সে।
১৯৪৭ সালে দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের পর, জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান। এই রাষ্ট্রের দুটো প্রদেশ- একটি পূর্ব পাকিস্তান, অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তান। একই দেশ হওয়া সত্ত্বেও দুই প্রদেশের ভৌগোলিক দূরত্ব জলপথে তিন হাজার মাইল, স্থলপথে দু হাজার মাইল। মাঝখানে ভারতবর্ষ। পাকিস্তান নামের যে দেশের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানকে জোর করে যুক্ত করা হলো, তার সঙ্গে এই ভূখণ্ডের মানুষদের ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, ঐতিহ্য, ধ্যান-ধারনা, অর্থনীতি ইত্যাদি দিক থেকে কোনো নৈকট্য তো ছিলোই না, বরং অনেক ক্ষেত্রেই ছিল হুবহু বিপরীত। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভাষা। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ৬ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের। এদের মাতৃভাষা বাংলা। আর বাকি ২ কোটি ৫০ লক্ষ পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষেরা উর্দুভাষী। এসব সত্ত্বেও কেবলমাত্র কেবলমাত্র ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে যুক্ত করা হল সম্পূর্ণ বিপরীত দুই ভূখণ্ডকে।
দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটলো ঠিকই, কিন্তু পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক মনোভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটলো না। আত্মপ্রকাশের প্রথমদিন থেকেই পূর্ব পাকিস্তান চলে গেল ধন কুবের ও দালালদের হাতে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানিদের উপর শোষণ, শাসন অব্যাহত ছিল।
পূর্ব পাকিস্তানের উৎপাদিত চা, পাট, রেশম ইত্যাদি দ্রব্য পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নতির জন্য কাজে লাগানো শুরু হলো। এই প্রদেশে শিক্ষার জন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দূরে থাকুক, নাগরিকদের রুজি-রোজগারের জন্য কোনো শিল্প পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হলো না। সব উন্নয়ন পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশের। একইসঙ্গে বর্ণবৈষম্য ও চেহারার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষদের কাছে উপহাসের পাত্র হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তানের তামাম জনগণ।
নারীরা যাতে শিক্ষিত হতে না পারে, তাদের নিজস্ব অধিকারের প্রশ্ন তুলতে না পারে, সেজন্য পূর্ব পাকিস্তানের মেয়েদের হাতে তুলে দেওয়া হলো উর্দু ভাষায় লেখা আশরাফ আলী থানভীর 'বেহেশতী জেওর' বা স্বর্গের অলংকার গ্রন্থটি। অল্পদিনেই এই গ্রন্থটিকে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের মুসলিম নারীদের জীবনের নিয়ন্ত্রক হিসেবে তুলে ধরা হল।
এভাবেই যখন চলছিল আগমনী-বিজয়া মেশানো পূর্ব পাকিস্তানিদের জীবন, সেই সময়, স্বাধীনতার ঠিক তিনমাসের মধ্যেই, নভেম্বর মাসে পাকিস্তান সরকার উর্দু ভাষার সাথে ইংরেজি ভাষায় খাম, পোস্ট কার্ড, ডাকটিকিট, মানি অর্ডার ফর্ম, ট্রেনের টিকিট ছাপতে শুরু করে। পাকিস্তানের উচ্চতর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ৩১ টি বিষয়ের মধ্যে ৯ টি ভাষা বিষয় থাকলেও বাংলা ভাষার কোনো নামগন্ধ ছিল না। সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বাংলাকে বঞ্চিত করা হয়। স্বাধীন দেশের স্বদেশী শাসকদের এই হঠাৎ সিদ্ধান্তকে সহজে মেনে নিতে পারেনি সেদিনের পূর্ব পাকিস্তান। ধীরে ধীরে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে।
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ উপলব্ধি করল, পাকিস্তান সরকার তাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে এদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করার হীন চক্রান্ত করছে। উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হলে পরবর্তীতে এদের আর কোনো অধিকার থাকবে না। তাই অধিকার রক্ষা করতে গেলে, আগে, সবার প্রথমে মুখের ভাষাটাকে রক্ষা করতে হবে।
অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রশাসনিক কর্তা-ব্যক্তিরা জোর করে উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করতে থাকেন। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন থেকে শুরু করে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদ আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন–"উর্দু, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।"
শাসকের এই নীতির বিরুদ্ধে পথে নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ও আরও বেশ কয়েকটি কলেজের ছাত্ররা। আপন মাতৃভাষাকে রক্ষার তাগিদে একের পর এক তৈরি হয় তমদ্দুন মজলিস, গণ আজাদি লীগ, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ইত্যাদি। এরা সম্মীলিতভাবে আন্দোলন করে তাদের মাতৃভাষার প্রতি দাবি ছিনিয়ে নেয়।
এই আন্দোলনে পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে শহিদ হন ৩ জন ছাত্রসহ ৪ জন। এঁরা মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রফিক উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এম. এ-র ছাত্র আবুল বরকত, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন এম. এ-র ছাত্র মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, গ্রামীণ কর্মচারী আবদুল জব্বার, শুল্ক বিভাগের পিয়ন আবদুস সালাম। আহত হন ১৭ জন। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২১, ২২শে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন চল্লিশ জন, আহত হয়েছিলেন ৪০০-এর বেশি মানুষ, পাকিস্তানি পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন দু হাজারের বেশি মানুষ। এদের মধ্যে যেমন ছিল ছাত্র সমাজ, তেমনি সাধারণ নাগরিকেরাও।
এই চেতনা থেকেই বঙ্গ বন্ধু মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ প্রায় ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে এইদিন বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের প্রায় ৫৩ বছর পর দেশটির দ্বিতীয় স্বাধীনতা এসেছে। অন্তত আন্দোলনকারী ছাত্র সমাজের, সমন্বয়কদের দাবি এরকমই। এর ভিত্তিতে ছিল ছাত্রছাত্রীদের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ১ লা জুলাই ২০২৪ এ জন্ম নেওয়া এই সংগঠনটি মাত্র ৩৫ দিনে অসহযোগ আন্দোলনের রূপ নিয়ে তথাকথিত স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। ছাত্রছাত্রীদের এ আন্দোলন নিয়ে যদিও যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। বিতর্ক যাইই থাকুক না কেনো, এই আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছিল ৫২-র ভাষা আন্দোলনের মতোই ছাত্রছাত্রীদের হাত ধরেই।
এখানেও ক্ষোভ জমা হচ্ছিল ধীরে ধীরে গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ১৫ বছর ধরে মানুষ গুম, হত্যা, নির্যাতন, লাখ লাখ মিথ্যে মামলা, বিনা বিচারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মতো অসাংবিধানিক, অমানবিক কাজকর্ম চালিয়ে গেছেন। এমনকি বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের ভোটাধিকার পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছিলেন এই শাসক। ৫ই আগস্ট ছাত্র জনতার প্রবল বিক্ষোভের মুখে তিনি দেশ ছেড়ে ভারতবর্ষে আশ্রয় নিয়েছেন। এসব কথা বাইরের কথা। ঘটনার সূত্রপাত সম্পূর্ণ অন্যরকম। বাংলা ভাষা নামের এই দেশটি স্বাধীনতা লাভের পর থেকে সরকারি চাকরি ও শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রায় ২৫২ রকমের কোটা চালু করেছিল। প্রায় প্রতিটি দেশেই পিছিয়ে পড়া নাগরিকদের সুযোগ সুবিধা দিতে এই ধরনের কিছু না কিছু কোটা প্রচলিত আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে শেখ হাসিনার আমল পর্যন্ত কোটার ধরণ ছিল-৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, জেলাভিত্তিক কোটা ১০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ। এই ৫৬ শতাংশ কোটা ও সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়স সীমার দাবিতে ২০১৮ সালেই বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে। এরপর নানা সময় এ নিয়ে বিতর্ক ও কেসকাছারি চলতেই থাকে। এই দাবি জোরালো হয় ২০২৪ সালের জুলাই মাসে। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকেরাও। প্রায় ৩৫ দিনের আন্দোলনে ৪৫০ জন নিহত হন, আহতের সংখ্যা ২০০ এবং প্রায় ১৪০০০ জনকে আটক করা হয়।
১৯৫২ এর ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছে যে দেশের, সেই আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ছাত্রছাত্রীরা। দ্বিতীয় স্বাধীনতারও চালিকাশক্তি ছাত্রসমাজ। ৫২ র ছাত্র আন্দোলনের ছাত্রছাত্রীদের ভেতরে ছিল মাতৃভাষা চেতনা, তীব্র আবেগ, ২৪ এর ছাত্রছাত্রীদের ভেতরে ছিল ক্ষোভ। তবে এদের জানা আছে ভাষা অন্য। এ ভাষা সুরেই ভাষা, ছন্দেরই ভাষা, তানেরই ভাষা, আনন্দেরই ভাষা না হোক-ক্ষোভের ভাষা, ধ্বংসের ভাষা।
যে দেশ বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রাম করে জন্ম নিয়েছে, ২৪ এর ছাত্রছাত্রীদের কোটা বিরোধী প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সেই ভাষা বহিষ্কৃত। নামগুলো দেখুন- ব্লক রেইড, বাংলা ব্লকেড, কমপ্লিট শাটডাউন, মার্চ ফর জাস্টিস, রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ ইত্যাদি।
শেখ হাসিনার গণভবন ত্যাগের পর গণ ভবন থেকে ছাগল, হাঁস, মুরগি, গরু, চেয়ার, টেবিল, সোফা, টেবিল ফ্যান, কম্বল, টেলিভিশন, ওয়াটার ফিল্টার, মাইক্রোওভেন, মাইক্রোওয়েভ, ফ্রিজ, এয়ার কন্ডিশনারের ইনডোর-আউটডোর যন্ত্র, বেসিন, জলের ট্যাঙ্ক, টয়লেটের প্যান, শাড়ি, ব্লাউজ, অলংকার এমনকি বাদ যায়নি অন্তর্বাসও। সংসদ ভবনের মতো পবিত্র জায়গায় ধূমপান করতেও দেখা গেছে কাউকে কাউকে। এমনকি ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতোর মালা পরিয়ে তাঁকে গ্রাম ঘুরতে বাধ্য করা হচ্ছে। যাঁর ত্যাগ ও নেতৃত্বের ফলে আজকের বাংলাদেশ, যিনি বঙ্গবন্ধু সারাদেশে তাঁর মূর্তি হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে, দড়ি দিয়ে টেনে এক্সকেভেটর দিয়ে ভাঙা হয়েছে। ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক বাড়ি বঙ্গবন্ধু ভবন, জাদুঘর ভাঙা হয়েছে, পোড়ানো হয়েছে। হাসিনার ৫ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়ি সুধাসদনও। বাদ যায়নি রাহুল আনন্দের বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহশালা ও তাঁর বাড়ি। পিটিয়ে মেরে, উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে পুলিশের মৃতদেহ। প্রায় ৪৪ জন পুলিশকে পিটিয়ে মেরছ ফেলা হয়েছে।
এটা কি কোনো সুস্থ ছাত্রসমাজের কাজ হতে পারে?এরা কিরকম ছাত্র, কোন শিক্ষায় শিক্ষিত সবটা আমরা জানি না। ৫২-র ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদেরকে এরকম ধ্বংসাত্মক ভূমিকায় দেখা যায় নি। অনেক স্বতঃস্ফূর্ততা ও আন্তরিকতা ছিল। ২৪ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অনেকেই মনে করেছেন, এটা কোনো ছাত্র অভ্যুত্থান নয়। পিছনে রয়েছে চীন-মার্কিন ষড়যন্ত্র। ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের নামে পিছনে রয়েছে টাকার খেলা। এরা যেসব অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেছে, তার কোনোটিই বাংলাদেশের নয় বলেই অনেকের ধারণা।
এদের প্রত্যেকের আচরণ বাঙালির সমাজ, সংস্কৃতির বিপক্ষে। এদের ভেতরে যে পরিমাণ মুজিব বিদ্বেষ, ৫২,৭১-এর চেতনা বিদ্বেষ, ভারত বিদ্বেষ দেখা গেছে, তাতে করে এটা বেশ বোঝা যায়, এরা ৭১ এর পরাজিত শক্তি পাকিস্তানের পক্ষে। বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে নানারকমভাবে সাহায্য করেছিল ভারতবর্ষ। এই পরাজয়ের আক্রোশ এখনো পাকিস্তানপন্থী অনেক বাংলাদেশীদের মধ্যে আছে।
প্রকৃত শিক্ষা মানুষের মনে চেতনা এনে দেয়, শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলে।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী কোনো কারণে অবর্তমান থাকলে দেশের শাসনভার গ্রহন করেন সেনাবাহিনী। প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণের ঘটনা বাংলাদেশে একাধিকবার ঘটেছে। সাংবিধানিক পথে না গিয়ে এই প্রথম অন্তর্বর্তী সরকার তৈরি করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান।
এই সরকারের চূড়ামণি নোবেলজয়ী ড. মহম্মদ ইউনূস তাঁর নামে ৬৬৬ কোটি টাকা কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ ছিল। ক্ষমতায় আসার ৭২ ঘন্টার মধ্যেই এই বিপুল অঙ্কের কর মকুব। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় মামলা থেকে তিনি মুক্ত।
অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক সমন্বয়কের সঙ্গে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ চলে গেছে জামায়াতে পন্থীদের হাতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ লা অগাস্ট নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন এই জামায়েতে ইসলামি বাংলাদেশ ও ইসলামি ছাত্র শিবরকে।
এখানে সমন্বয়ক ও প্রধান উপদেষ্টা নোবেল লরিয়েট অর্থনীতিবিদ ড. মহম্মদ ইউনূসের স্বার্থ বড় হয়ে উঠেছে। বন্যা কবলিত ফেনী, কুমিল্লা,নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ইত্যাদি ১২ টি জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণের টাকা সমন্বয়কদের অ্যাকাউন্টে জমা হচ্ছে।
ভাষাকে ভালোবেসে স্বতন্ত্র একটি দেশ হিসেবে জন্ম হয়েছিল যে বাংলাদেশের, সেই স্বাধীন বাংলাদেশ পুনরায় পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ ইউনুসের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন হাত। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর বাংলাদেশে আসছে আলু, চিনি, গুড় থেকে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র। মুসলিম নারীদের মধ্যে জোর করে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে পর্দাপ্রথা। বাংলাদেশের নারীমুক্তির অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়েই বেগম রোকেয়ার ম্যুরালে কালি লেপা, অকথা-কুকথা লেখা হয়েছে। এমনকি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে বর্তমানে রাখা হয়েছে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়। নির্বাসিত একজন সাহিত্যিক, যিনি বাংলাদেশের নারীদের সমাজকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিলেন, সরকারি সংস্থা বাংলা একাডেমী আয়োজিত অমর একুশে বইমেলায় তাঁর লেখা বইপত্র বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করছে মৌলবাদীরা। বাংলাদেশের মহিলাদের বাজারে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের কেউ কেউ। ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশে দিনের পর দিন সংখ্যালঘু নির্যাতন চলছে। হিন্দু সন্ত চিন্ময়কৃষ্ণ দাসকে বিনা বিচারে কারাবন্দী করে রেখেছে। তাঁর পক্ষে কোনো উকিল পর্যন্ত দাঁড়াতে পারছেন না। অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনের হালও একই। অনেক কবি, সাহিত্যিক রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার কারণে এখনও কারারুদ্ধ।
একজন শাসক যখন ভুল করেন, অত্যাচারের মাত্রা ছাড়িয়ে যান, তখন প্রতিটি নাগরিককে সুরক্ষিত রাখবার প্রয়োজনে শাসককে সরাতেই হয়। গণতান্ত্রিক দেশে এর শ্রেষ্ঠ পথ ভোটাধিকার প্রয়োগ। ভাষার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও ৭১-এর স্বাধীনতায় গুরুত্ব পেয়েছিল নাগরিকদের সচেতন ভোট দান। ভোটদান যখন প্রহসন তখন তো স্বৈরাচারী শাসককে সরানোর জন্য আন্দোলনের পথে, ক্ষোভ- বিক্ষোভের পথেই যেতে হয়। কিন্তু এখানে সহিংসতা একেবারেই কাম্য নয়। কিন্তু এরপর বাংলাদেশে যা ঘটে চলেছে, এগুলো ধরে ধরে নিরপেক্ষভাবে প্রশ্ন করা উচিত। আজকের দ্বিতীয় স্বাধীন রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ক ইউনূস এখন চুপ। এরা কী নিরপেক্ষ? তবে কি জাতীয় ঐক্য, জাতীয় সংহতি অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে না আর? তবে কী একটা দেশ ভাষা নিয়ে, ভাষা হারিয়ে আবার কী ফিরে যাবে পাকিস্তানে? সব প্রশ্নের উত্তর দেবে সময়।