বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ

মিস্টার কো-প্রেসিডেন্ট!
মৃণালকান্তি দাস

আমেরিকান নতুন প্রেসিডেন্ট কে? ডোনাল্ড ট্রাম্প, নাকি স্পেস এক্স-এর মালিক এলন মাস্ক! নাকি মাস্ককে ‘প্রধানমন্ত্রীর’ মতো কোনও অলিখিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছে! ট্রাম্পের নয়া জমানায় এই ধনকুবেরের নজিরবিহীন ভূমিকা দেখে স্তম্ভিত অনেকেই। তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, বকলমে কি মাস্ক-ই প্রশাসন চালাবেন?
মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয় হোয়াইট হাউস। সেখানে প্রেসিডেন্টের জন্য রয়েছে বিশেষ একটি টেবিল ও চেয়ার। ওই চেয়ারে বসেই দেশ শাসনের সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন তিনি। হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওই টেবিলটি ‘রেজল্যুট ডেস্ক’ নামে পরিচিত। আর সেই ‘রেজল্যুট ডেস্ক’ নিয়েই বিতর্ক উস্কে দিয়েছে আমেরিকার প্রভাবশালী টাইম ম্যাগাজিন। টাইমের সর্বশেষ সংস্করণের প্রচ্ছদে রয়েছে, প্রেসিডেন্টের টেবিল–চেয়ারে বসে আছেন এলন মাস্ক। হাতে কফির কাপ। তাঁর পিছনে দুই পাশে আমেরিকা ও প্রেসিডেনশিয়াল পতাকা। টাইমের এই সংস্করণটিতে ‘ওয়াশিংটনে এলন মাস্কের যুদ্ধের ভিতরের খবর’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছে। তাতে লেখা, ‘এখনও পর্যন্ত এটাই মনে হচ্ছে, মাস্ক একমাত্র প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ছাড়া আর কারও কাছে জবাবদিহির জন্য বাধ্য নন।’
গত কয়েক মাসের মধ্যে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার টাইমের প্রচ্ছদে এলেন এলন মাস্ক। গত নভেম্বরের সংস্করণের প্রচ্ছদে মাস্কের ছবি দিয়ে শিরোনামে লেখা হয়েছিল ‘নাগরিক মাস্ক: তাঁর কাজের তালিকায় কী কী রয়েছে’। এই দুই প্রচ্ছদে এটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে, ট্রাম্প নন, আসলে ক্ষমতায় রয়েছেন এলন মাস্কই। টাইমের এই প্রচ্ছদ নিয়ে ট্রাম্পের কাছে তাঁর অনুভূতি জানতে চাওয়া হয়েছিল। জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘টাইম ম্যাগাজিন এখনও চালু আছে? জানতাম না তো!’ ট্রাম্পের কথায়, ‘জানেন তো, এটা এখন একটা নতুন পন্থা। ভুয়ো খবর ছড়ানো। নতুন ভুয়ো খবরটা হল, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর ক্ষমতা এলন মাস্কের হাতে তুলে দিচ্ছেন।’
ট্রাম্প কি আসলে মাস্ককে গ্রাস করছেন, না মাস্ক গ্রাস করছেন ট্রাম্পকে? এই প্রশ্নটা বহুদিন ধরে ঘোরাঘুরি করছে বিশ্বে। স্বাভাবিক। এভাবে কোনও প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে খোলাখুলি সমর্থন করেছেন কোনও শিল্পপতি? আমেরিকায় যা করে দেখিয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষ এলন মাস্ক। রাজনীতির এমনই মহিমা, প্রত্যেক সফল নেতার পিছনে এক অদৃশ্য ছায়া থাকে। সেই ছায়া আসলে এক শিল্পপতির। আগে এই শিল্পপতিরা অনেক আড়ালে থেকে সাহায্য করতেন। মিডিয়াকে প্রভাবিত করে, ভোট-প্রচারে টাকা জুগিয়ে, রাজনীতিকদের সঙ্গে সামাজিক সংযোগ করে। এখন একেবারে খোলাখুলি। আমেরিকাতে জন রকাফেলার কিংবা বিল গেটসের মতো শীর্ষ-ধনীরা কখনও আসেননি প্রত্যক্ষ রাজনীতির বৃত্তে।
আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় থেকেই ট্রাম্পের কাছাকাছি দেখা গিয়েছে টেসলা, স্পেসএক্স ও এক্সের মালিক ধনকুবের এলন মাস্ককে। নির্বাচন ঘিরে ট্রাম্পের প্রচারের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থও ঢেলেছিলেন তিনি। এই আনুগত্যের পুরস্কার দিতে ভোলেননি ট্রাম্প। ক্ষমতা পাকা হওয়ার পর ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্মেন্ট এফিসিয়েন্সি’ (ডজ) নামে নতুন একটি বিভাগের দায়িত্ব দিয়েছেন মাস্ককে। এর উদ্দেশ্য কেন্দ্রীয় ব্যুরোক্র্যাসি মোটামুটি এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক বিষয়সমূহ এবং কর্মক্ষমতার পূর্ণ নিরীক্ষণের মাধ্যমে কঠোর সংস্কারের সুপারিশ করবে সংস্থাটি, এমনটাই চাইছেন ট্রাম্প। দপ্তরটি চলবেও ওয়াশিংটনে মাস্কের স্পেসএক্স অফিস থেকে। মাস্ক অবশ্য বলেছেন, ‘ডজ’ গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি নয়, হুমকি ব্যুরোক্র্যাসির উপর। বিষয়গুলিকে সহজ ভাবে দেখছেন না আমেরিকার নাগরিকরা। ট্রাম্প ও মাস্ক সম্পর্কে গুঞ্জন আরও বেড়েছে আমেরিকান মিডিয়ার সৌজন্যে। বেশ কিছু সংস্থা তাদের রিপোর্টে দাবি করেছে, মাস্ক আমেরিকার সম্ভাব্য রাষ্ট্রপ্রধান হতে চলেছেন। ইতিমধ্যে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ সংবাদপত্র মাস্কের জন্য একটা নতুন শব্দবন্ধ তৈরি করে ফেলেছে— ‘কো-প্রেসিডেন্ট’। ট্রাম্প অবশ্য বলেছেন, ‘আমি নিরাপদ, কেন জানেন? ও (এলন) এ দেশে জন্মায়নি। না না, ওসব কিছু হচ্ছে না। এলন অসাধারণ কাজ করছেন।’
এলন মাস্ক শুধু প্রযুক্তি ব্যবসায়ী নন, তিনি আমেরিকার রাজনীতিতেও একটি বিতর্কিত চরিত্র হয়ে উঠেছেন। তাঁর কিছু কর্মকাণ্ড ও মন্তব্য নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। যেমন— প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাঁর নাৎসি কায়দায় অভিবাদন (সিগ হেল) নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। মার্কিন উন্নয়ন সংস্থা ইউএস-এইডকে ‘অপরাধী সংগঠন’ আখ্যা দিয়ে এটির ‘মৃত্যু’ হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। ট্রাম্প-মাস্ক যুগলবন্দির নতুন সিদ্ধান্তে আমেরিকায় শিশুদের ক্যানসার রিসার্চ ফান্ডের বরাদ্দ কমে গিয়েছে। সেটা নাকি রিপাবলিকান পার্টির অনেক নেতা জানতেনই না। মাস্ক এমনভাবে মার্কিন কংগ্রেসের উপরও ছড়ি ঘোরাতে শুরু করেছেন, যেখানে বিভ্রান্ত রিপাবলিকান পার্টির মাথারাও। ফেসবুক, অ্যাপল, মাইক্রোসফটের মতো বহুপরিচিত সংস্থার মালিকরা রাজনীতি নিয়ে বেশি কথা বলেন না। মাস্ক সেখানে একেবারে ট্রাম্প সুলভ। প্রতিদিনই কার্যত উল্টোপাল্টা কিছু না কিছু বলেই চলেছেন। সারাক্ষণ সংবাদমাধ্যমের চর্চায় থাকতে ভালোবাসেন। ফলে রিপাবলিকান পার্টি ও ট্রাম্পের প্রশাসনে মাস্কের প্রভাব বাড়ছে দিন-দিন। ‘মাস্কম্যানিয়া’ নামে একটা শব্দই তৈরি হয়ে গিয়েছে আমেরিকায়।
রস্কিল্ড ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অধ্যয়নের সহযোগী অধ্যাপক সোমদীপ সেনের কথায়, মাস্কের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ শুধু আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ নেই। তিনি কট্টর ডানপন্থী ট্রাম্প ও তাঁর মাগা (মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন) আন্দোলনকে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। শুরু করেছেন তাঁর ‘বিশ্বভ্রমণ’। বিভিন্ন দেশে চরম ডানপন্থী মতাদর্শ উস্কে দিচ্ছেন। ব্রিটেনে তাঁর অনুগত নেতাদের ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করছেন। ব্রিটিশ সংবাদসংস্থা দ্য গার্ডিয়ানে আলেকজান্ডার হার্স্ট লিখেছিলেন, এলন মাস্ক ‘এক ব্যক্তির দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’-এ পরিণত হচ্ছেন। এখনই সময় তাঁর লাগাম টেনে ধরার। কিন্তু সেই লাগাম টানবে কে? মাস্কের বিপুল বৈভবের সঙ্গে লড়াইয়ের সাহস কার আছে। মনে রাখবেন, ডলার যদি মিটার হতো, তাহলে মাস্কের টাকায় মঙ্গল গ্রহেও চলে যাওয়া যেত!
ব্যক্তি-পুজোর সংস্কৃতির শুরুটা করেছিলেন স্টিভ জোবস। তিনি অতি সতর্কতা ও যত্নের সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছে নিজের উদার ও কৌতূহলী উদ্ভাবকের ভাবমূর্তি ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ‘কঠোর-নিয়ন্ত্রিত একটি কর্পোরেশনের’ প্রধান ছিলেন। জোবস গোটা জীবন রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও তাঁর আইকনিক অবস্থান অনুসরণ করে উঠে আসা উত্তরাধিকারীরা তাঁর মূল্যবোধ ও আদর্শকে মোটেও অনুসরণ করেননি। তাঁরা তাঁদের নিজেদের প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নিজেদের উদ্যমকে রাজনীতির হাতে সঁপে দিয়েছেন এবং নিজেদের কায়েমি স্বার্থ উদ্ধারের এজেন্ডাগুলিকে উন্মোচিত করে দিয়েছেন। এলন মাস্ক তার সর্বশেষ উদাহরণ।
গত এক বছরে মাস্ক ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ নাইজেল ফারাজের মতো ব্রিটেনের কট্টর ডানপন্থী ব্যক্তিদের বারবার সমর্থন জুগিয়েছেন। মাস্ক তাঁর প্ল্যাটফর্ম এক্স ব্যবহার করছেন ডানপন্থী উগ্রবাদ ছড়ানোর অস্ত্র হিসেবে। বিশ্বব্যাপী কট্টর ডানপন্থা উস্কে দেওয়ার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে জার্মানিতেও হস্তক্ষেপ করেছেন। কট্টর ডানপন্থী দল অলটারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি)-কে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছেন। এএফডি তো সেই চরম ডানপন্থী দল, যারা রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা বলে এবং ট্রান্স অতলান্তিক সম্পর্ক দুর্বল করতে চায়। তাদের নেতা অ্যালিস ভিডেল বলেছিলেন, হিটলার আসলে কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক ছিলেন। এই বিতর্কের পরও জানুয়ারির শেষ দিকে জার্মানির হাল্লেতে এক সমাবেশে মাস্ক এএফডিকে জার্মানির ‘শেষ আশার আলো’ বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, অভিবাসন কমানোর মাধ্যমে একমাত্র এএফডি জার্মান সংস্কৃতি রক্ষা করতে পারবে। এই প্রকাশ্য সমর্থন এবং ভিডেলকে প্ল্যাটফর্ম দেওয়ার মাধ্যমে মাস্ক সম্ভবত এএফডিকে জিতিয়ে আনতে চাইছেন।
ট্রাম্প ইউরোপে কট্টর ডানপন্থীদের উত্থানে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তিনি ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, যেখানে মাস্কও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছেন। মাস্ক প্রকাশ্যে আর্জেন্তিনার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেয়ির প্রশংসা করেছেন। মিলেয়ির কঠোর অর্থনৈতিক নীতিগুলি তাঁর ‘ডজ’ নীতির অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। মিলেয়ি ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন।
গত সেপ্টেম্বরে মাস্ক এল সালভাদরের বিতর্কিত নেতা নায়িব বুকেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নায়িব বুকেল কঠোর অপরাধ দমন নীতি ও গণহারে লোকজনকে জেলে পাঠানোর জন্য বিশাল কারাগার বানিয়ে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। সূত্রের খবর, ট্রাম্প প্রশাসন আমেরিকার দণ্ডিত অপরাধীদের বুকেলের কারাগারে পাঠানোর কথা বিবেচনা করছে। বুকেল বলেছেন, আমেরিকা থেকে ফি নিয়ে তাদের কয়েদিদের রাখার মাধ্যমে তিনি নিজের কারাগার ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চান। গোটা দুনিয়ায় মাস্কের ডানপন্থী প্রভাব এতটাই বেড়েছে যে, তিনি কোনও মন্তব্য না করলেও কিছু দেশে তা প্রভাব ফেলছে। পোল্যান্ডে এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রায় ৪৫ শতাংশ ভোটার মাস্ক–সমর্থিত প্রার্থীকে ভোট দিতে চান। যদিও মাস্কের বিশ্বজুড়ে ডানপন্থী বিপ্লবের প্রচেষ্টা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে চিন্তার বিষয় একটাই, বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে মাস্ক অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছেন।
আর গণতান্ত্রিক দেশগুলির কপালে ভাঁজ ফেলছে একটাই শব্দ— ‘মাস্কম্যানিয়া’!
1d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

শাস্ত্র অধ্যয়নে গতি বৃদ্ধি ও পরীক্ষায় শুভ ফল লাভের সম্ভাবনা। নতুন কর্মপ্রাপ্তি হতে পারে। দাম্পত্যে...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার ৮৫.৮৩ টাকা ৮৭.৫৭ টাকা
পাউন্ড ১০৭.৩৭ টাকা ১১১.১৪ টাকা
ইউরো ৮৮.৭৮ টাকা ৯২.১৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা