আমরা জানি না শান্তি আগে আসে, নাকি বসন্ত। কিন্তু আমরা জানি বসন্ত অবশ্যই আসবে। যেখানে সবকিছু আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে, সেখানেও বসন্ত আসবে। ঘাস গজাবে পরিখায়, মৃত সেনাদের হাড়ের ভিতর দিয়ে। পুড়ে যাওয়া সাঁজোয়া যানগুলির উপরেও। ক্যালেন্ডার বা সময়কে থামাতে পারে না যুদ্ধ। কেবল জীবনের গতি থামায়। ব্রিটিশ সংবাদসংস্থা গার্ডিয়ানে যুদ্ধের যন্ত্রণা লিখেছিলেন ইউক্রেনীয় ঔপন্যাসিক আন্দ্রেই কুরকোভ।
তিন বছর ধরে চলা সেই যুদ্ধই থামাতে চাইছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিজের দেশের স্বার্থেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানিয়ে দিয়েছেন, মার্কিন করদাতাদের অর্থে এভাবে দিনের পর দিন একটা যুদ্ধ চলতে পারে না। শুধু এক ইউক্রেনের জন্য মার্কিন কোষাগার থেকে বেরিয়ে গিয়েছে ১৭৫ বিলিয়ন ডলার। আর নয়। এবার সেই অর্থ ইউক্রেনকে ফেরত দিতে হবে। নয়তো ইউক্রেনের লিথিয়াম, টাইটানিয়ামসহ বিরল খনিজ সম্পদের প্রায় ৫০ শতাংশ মালিকানা চায় আমেরিকা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করে দেবেন। বাস্তবে তা হয়নি। তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাত্র তিন সপ্তাহ পার হতেই এই যুদ্ধ থামানোর প্রক্রিয়া জেলেনস্কির মাথায় রীতিমতো বাজ ফেলে দিয়েছে। গোটা দুনিয়ার সব অঙ্ক ওলটপালট করে দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য জেলেনস্কিকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন। বলেছেন, ‘আপনার কখনওই যুদ্ধ শুরু করা উচিত হয়নি।’ জেলেনস্কিকে ‘স্বৈরশাসক’ বলতেও ছাড়েননি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রাম্প লিখেছেন, জেলেনস্কি বিদেশি সহায়তার ‘রসালো ট্রেন’ চালু রাখতে চান। কিন্তু এই বর্বরতার শেষ হোক। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে তাঁর দেশ আর থাকবে না। এক্স পোস্টে এলন মাস্ক লিখেছেন, ইউক্রেনের জনগণ আজ জেলেনস্কিকে ঘৃণা করেন। ভোট হলে তিনি হেরে যাবেন। নিশ্চিত...
বিবিসির মস্কো সংবাদদাতা স্টিভ রোজেনবার্গ বলছেন, মার্কিন সাংবাদিক জন রিড তাঁর নিজের চোখে দেখা ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন। বিখ্যাত সেই বইটির শিরোনাম দিয়েছিলেন, ‘দুনিয়া কাঁপানো ১০ দিন’। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে ১০ দিন যেন অনেক বেশি। তাঁরা এক সপ্তাহেই সবকিছু কাঁপিয়ে দিয়েছেন। গোটা দুনিয়াটাকে উল্টো স্রোতে নিয়ে গিয়েছেন। যার শুরুটা হয়েছিল গত ১২ ফেব্রুয়ারি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেদিন ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন। এরপর ট্রুথ সোশ্যালে পোস্ট করে গোটা দুনিয়াকে জানিয়ে দিয়েছেন, যুদ্ধে ইতি টানতে তাঁরা একমত। এই আলোচনার পরই সৌদি আরবে রাশিয়া-আমেরিকার শীর্ষ সম্মেলনের কথা ঘোষণা করা হয়। আর সেদিনই রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছিলেন, ইউরোপের দিন শেষ!
১৩ ফেব্রুয়ারি, ব্রাসেলসের ন্যাটো সদর দপ্তরে এক বক্তৃতায় মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের জন্য আমেরিকার প্রস্তাবের মূল বিষয় তুলে ধরেন। আগের মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান থেকে একেবারে উল্টো পথে গিয়ে তিনি বলেন, ইউক্রেনের পক্ষে তার সব ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। আলোচনার পথ উন্মুক্ত রাখতে ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ পাওয়ার বিষয়টিও বাদ দিতে হবে। এই বক্তব্যের মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন কার্যত ২০০৮ সালের মার্কিন-ইউক্রেন কৌশলগত অংশীদারিত্বের চুক্তিকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। ওই চুক্তিতে ইউক্রেনের অখণ্ডতা রক্ষা এবং ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তিকে নীতিগত অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ইউক্রেনের নিরাপত্তা প্রশ্নে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব বলেছেন, যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবায়নের জন্য ইউরোপীয় ও অন্যান্য অঞ্চলের শান্তিরক্ষী মোতায়েনের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে আর কোনও মার্কিন সেনা পাঠানো হবে না এবং ন্যাটোভুক্ত দেশের সেনারা ন্যাটোর ৫ নম্বর অনুচ্ছেদের আওতায় থাকবে না। এই অনুচ্ছেদে রয়েছে, কোনও সদস্যরাষ্ট্র আক্রান্ত হলে তাকে রক্ষা করতে ন্যাটো সম্মিলিতভাবে সক্রিয় হয়। ইতিমধ্যে ন্যাটোর অন্যতম মিত্র পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক জানিয়ে দিয়েছেন, শান্তিরক্ষায় তাদের দেশের কোনও সেনা ইউক্রেনে যাবে না।
পিট হেগসেথের কথায় ইউক্রেনের কিছু ইউরোপীয় মিত্র আপাতত ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তাদের আমেরিকার পথেই হাঁটতে হবে। উপায় নেই। হয়তো তাই, ১৪ ফেব্রুয়ারি ন্যাটোর নতুন মহাসচিব মার্ক রুটে বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের নিশ্চয়তা কখনওই দেওয়া হয়নি। যদিও এই বক্তব্যের সঙ্গে তাঁর আগের কিছু প্রতিশ্রুতির কোনও মিল নেই। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে নতুন দায়িত্ব নেওয়ার পর এই মার্ক রুটে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ইউক্রেন ‘ন্যাটোর সদস্যপদ পাবেই’। কিন্তু এখন ঠিক উল্টো কথা বলা শুরু করেছেন। আর বিধ্বস্ত জেলেনস্কিও বলেছেন, আমেরিকার সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া পশ্চিমী নিরাপত্তা নিশ্চয়তার তেমন কোনও মূল্য নেই। ইউরোপের দেশগুলি যে ‘ঠুঁটো’ তা এই যুদ্ধকালীন সময়ে বুঝে গিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টও।
ট্রাম্প ও হেগসেথের এই ঘোষণার পর পশ্চিমের কিছু সংবাদমাধ্যম ‘ইউক্রেনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে সমালোচনা করেছে। কিন্তু এটা তো কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। বরং ইউক্রেনের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্কের ধরন যে বদলাবে অনেক আগেই তা অনুমেয় ছিল। এই পরিস্থিতি তৈরির জন্য ট্রাম্পকে কীভাবে দায়ী করবেন? ইউক্রেনের সঙ্গে আসলে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ইউরোপ তথা পশ্চিমের দেশগুলিই। তারা ইউক্রেনকে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। গত তিন বছরে পশ্চিমী দুনিয়া অস্ত্র সরবরাহ ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে রাশিয়াকে যত দূর সম্ভব চাপে রাখার চেষ্টা করেছে। লাভ হয়নি। এর বেশি এগোলে বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি হতো। রাশিয়া পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। এই কারণেই পশ্চিমী দুনিয়া সরাসরি সংঘাতে জড়াতে চায়নি। অথচ, তাদেরই ভরসায় ইউক্রেন আপসের পথ ছেড়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
রাশিয়া-আমেরিকার শীর্ষ সম্মেলনের পর আপ্লুত মার্কিন প্রেসিডেন্ট এয়ার ফোর্স ওয়ানে বসে বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দেন। বলেন, ‘আমি মনে করি, রাশিয়া যুদ্ধের ইতি টানতে চায়, আমি তা বিশ্বাস করি। কার্ড এখন পুতিনের হাতে।’ এর মানে কি রাশিয়ার জয়? হ্যাঁ, তাই-ই। তবে ইউক্রেনকে রাশিয়ার সামনে ছুড়ে দিয়েছে কে? যুদ্ধে উৎসাহী পশ্চিমের আগ্রাসী নীতির অনুসারীরাই। পশ্চিমী বিশ্লেষকরা মনে করেছিলেন, যুদ্ধের চাপে রাশিয়ার অর্থনীতি ধসে পড়বে। ভেঙে পড়বে তার শাসনব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিশাল সামরিক ব্যয়ের ফলে রাশিয়ার অর্থনীতি বরং চাঙ্গা হয়েছে। রুশ জনগণ এই যুদ্ধের বড় কোনও প্রভাব অনুভব করেনি। অন্যদিকে জীবন দুর্বিষহ হয়েছে ইউক্রেনের জনগণেরই। পুতিনকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত করা সম্ভব নয়। তাঁর পতন সম্ভব রাশিয়ার জনগণ রুখে দাঁড়ালে। কিন্তু পশ্চিমী বিশ্ব ও ইউক্রেন এতটাই কট্টর যে পুতিনবিরোধী অনেক রুশ নাগরিকও তাদের থেকে দূরে সরে গিয়েছে। পশ্চিমীদের আচরণ দেখে মনে হয়েছে, তারা শান্তি নয়, যুদ্ধই চেয়েছে। আজ জাতীয় নির্বাচনে একের পর এক ইউরোপীয়ান নেতাদের পতন জেলেনস্কিকে কার্যত কোণঠাসা করে ফেলেছে।
ক্রেমলিনপন্থী ট্যাবলয়েড মস্কোভস্কি কমসোমোলেৎস লিখেছে, ‘ট্রাম্প জানেন, তিনি এমন একটি পক্ষের সঙ্গে দর-কষাকষি করছেন, যারা ইউক্রেনে জিততে চলেছে। তাঁকে রাশিয়াকে ছাড় দিতেই হবে। তবে সেই ছাড় আমেরিকার ক্ষতি করে নয়, তা হবে ইউরোপ ও ইউক্রেনের মূল্য চোকানোর মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ সময় ধরে ইউরোপ একধরনের দম্ভের মধ্যে ছিল। তাঁরা নিজেদের সভ্য জগৎ ও স্বর্গের উদ্যান মনে করতেন। কিন্তু তাঁদের পরণে যে ট্রাউজার নেই, সেটা তাঁরা খেয়াল রাখেননি।...এখন অতলান্তিকের ওপারে তাঁদের নেতা আমেরিকাই সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে...।’
গত সপ্তাহে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জি-৭-এর বিবৃতিতে আমেরিকা স্বাক্ষর করতে রাজি হয়নি। এর কারণ একটাই, বিবৃতিতে ‘রাশিয়ার আগ্রাসন’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করা হয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে, ইউক্রেনের সামনে আর কোনও বিকল্প নেই। এই হতাশা প্রকাশ পেয়েছে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে জেলেনস্কির বক্তব্যে। তাঁর বক্তব্য ছিল চ্যালেঞ্জ ছোড়ার মতো, কিন্তু ভিতরে ছিল অসহায়ত্বের ছাপ। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে প্রস্তাব দেন, ইউক্রেনের সেনাবাহিনীই নতুন ইউরোপীয় সামরিক শক্তির কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এটি অবাস্তব। কারণ, তাহলে ইউরোপ সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে। ব্রিটেন থেকে জার্মানি— কেউ সেই অবস্থায় নেই। জেলেনস্কি যতই লম্ফঝম্ফ করুন না কেন, যতই ট্রাম্পকে সাম্রাজ্যবাদী বলুন না কেন, আমেরিকার জন্য ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের দরজা খুলে দিতেই হবে। ছেড়ে দিতে হবে রাশিয়ার দখলে চলে যাওয়া জমিও। দেশ বিক্রির পথেই হাঁটতে হবে তাঁকে। এর জন্য দায়ী জেলেনস্কি নিজেই! সংবাদসংস্থা দ্য ইকোনমিস্টের প্রাক্তন প্রধান সম্পাদক বিল ইমোট তো লিখতে বাধ্য হয়েছেন, রাশিয়া হাসছে, ইউরোপ কাঁদছে!