তন্ময় মল্লিক: ‘আমি দশ বছরের বিধায়ক। গঙ্গারামপুর মণ্ডলের করদহ ও ভিকাহারে যাঁরা মণ্ডল সভাপতি হয়েছেন তাঁদের আমি চিনি না।’ কথাগুলি বিজেপি বিধায়ক সত্যেন রায়ের। সত্যেনবাবু দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুরের বিধায়ক। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এই জেলারই মানুষ। তাঁকে বিষয়টি জানিয়েও লাভ হয়নি। তবে, সত্যেনবাবুর বিস্ফোরক অভিযোগটি হল, ‘সংগঠন মজবুত করতে তিনি পুরনো কর্মীর নাম দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের না করে যাঁরা তাঁকে একুশের ভোটে হারানোর চেষ্টা করেছেন, তাঁদেরই বসানো হয়েছে। এঁদের নিয়ে ছাব্বিশে নির্বাচন করলে ফল খারাপ হবে।’ এই কথার অর্থ, বঙ্গ বিজেপিতে শুরু হয়ে গিয়েছে ‘তুই বড় না মুই বড়’র জোর লড়াই। এই অবস্থায় বিজেপির বাংলা দখলের দাবি ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখপতি হওয়ার স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়।
সত্যেন্দ্রনাথবাবু জনপ্রতিনিধি। তাই তাঁর ক্ষোভ প্রকাশের মধ্যেও ছিল সংযম। কিন্তু বিজেপির নদীয়া দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলা অফিসে ভাঙচুর চালানো নেতা-কর্মীরা বেপরোয়া। তাঁরা মাটিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করেন। দল হারলে ভুগতে হয় তাঁদেরই। ফলে দলের কেউ ক্ষতি করতে চাইলে রুখে দাঁড়ান। তাঁদের অভিযোগ, মণ্ডল সভাপতি নির্বাচনের ভোটাভুটিতে এক নম্বরকে বাদ দিয়ে তিন নম্বরকে সভাপতি করা হয়েছে। টাকার বিনিময়ে বিজেপির মণ্ডল সভাপতির পদ বিক্রি হয়েছে। তাহলে ভোটের নামে এই প্রহসনের কী প্রয়োজন ছিল?
বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ছিলেন একুশের ভোটে রানাঘাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপির কো-ইনচার্জ তথা গাংনাপুর ৪ নম্বর মণ্ডলের সহ সভাপতি সুদীপ্ত মণ্ডল। জগন্নাথ সরকারকে জেতানোর ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা প্রায় সকলেই স্বীকার করেন। তিনিও শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুটছেন। তাঁর কথায়, বছর ঘুরলেই নির্বাচন। এখন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য কোমর বাঁধার সময়। তার জায়গায় দলের লোকজনের বিরুদ্ধেই লড়াই করতে হচ্ছে। দলবদলু কিছু নেতার মাতব্বরিতে কর্মীদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে। অবিলম্বে রাজ্য নেতৃত্বের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়িতেও মণ্ডল সভাপতি ইস্যুতে হাতাহাতিতে জড়িয়েছেন বিজেপির কর্মীরা। বিক্ষোভ প্রায় সর্বত্র। কোথাও পোস্টার পড়ছে। কোথাও অফিসে ভাঙচুর হচ্ছে। এগুলিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবলে ভুল হবে। রাজ্যজুড়ে একের পর এক ঘটনা ঘটলেও থামানো যাচ্ছে না। কারণ লড়াইটা বেঁধেছে বঙ্গ বিজেপির উপরতলায়। তাই থামানোর বদলে বিপক্ষ শিবিরকে শিক্ষা দিতে উস্কানি দিচ্ছে।
ডানপন্থী দলগুলিতে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জন্য কংগ্রেস আগেই গিনেস বুকে নাম তুলেছে। এক দশকেরও বেশি রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তৃণমূল কংগ্রেসেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মারাত্মক। হাতাহাতি, মারামারি তো হয়ই, খুনোখুনির ঘটনাও ঘটে। তবে, রাজ্যের শাসক দলের একটা সুবিধে আছে। দলের শেষ কথা বলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেকে এও বলেন, তৃণমূলের একটাই পোস্ট, বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট। তাই কারও বাড়াবাড়ি মাত্রা ছাড়ালেই ছাঁটা পড়ে ‘ডানা’। ফলে লম্বা, চওড়া কথা বলে প্রায়ই সংবাদের শিরোনামে জায়গা করে নেওয়া ‘বেয়াড়া’ নেতারাও এক ধমকেই হয়ে যান ‘সুবোধ বালক’।
একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, প্রতিটি জেলায়, প্রতিটি ব্লকে, প্রতিটি পঞ্চায়েতে, এমনকী প্রতিটি বুথে তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক গোষ্ঠী। কেউ একটা পদ জোগাড় করতে পারলেই জুটে যায় তার সাঙ্গোপাঙ্গ। কারণ বখরা পায় তারাও। ভাগ কে বেশি পাবে, তা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। তাতে সাধারণ মানুষ প্রচণ্ড বিরক্ত। সেই বিরক্তির আঁচ পাওয়া যায় ট্রেনের কামরায়, পাড়ার আড্ডায়। তারপরেও নির্বাচনে জেতে সেই তৃণমূলই। কারণ রাজ্যের মানুষ এখনও তৃণমূলকে ভোট দেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেই। নির্বাচনের আগে তিনি জেলায় জেলায় ঘোরা শুরু করলেই পাল্টে যায় ছবি। বদলে যায় সব হিসেবনিকেশ।
এ হেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে লাগে জবরদস্ত ইস্যু এবং মজবুত সংগঠন। এই মুহূর্তে দু’টির কোনওটাই এ রাজ্যের বিরোধীদের নেই। সাম্প্রতিককালের মধ্যে আর জি কর ছিল সরকারের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক আন্দোলন। বাংলার চিকিৎসক কন্যার ধর্ষণ ও মর্মান্তিক খুনের ঘটনাকে যেভাবে বিরোধীরা রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানোর চেষ্টা করেছিল, তা নজিরবিহীন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিচক্ষণতায় সেই ধারালো অস্ত্রও হয়ে গিয়েছে ভোঁতা। কারণ তিনি আন্দোলনের বিরোধিতা না করে পাশে দাঁড়িয়ে সহমর্মিতা জানিয়েছেন। ফলে সরকারকে আক্রমণের জায়গাটা ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছে। আক্ষরিক অর্থে এই মুহূর্তে বিরোধীদের হাতে কোনও ইস্যুই নেই।
এদিকে ‘বিশ্বগুরু’র অবস্থাও দিন দিন করুণ হচ্ছে। ট্রাম্প বাংলাদেশের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার মোদিজিকে দেওয়ায় গেরুয়া শিবির যৎপরনাস্তি খুশি হয়েছিল। ফের ‘বিশ্বগুরু’র হয়ে ঢাক পেটানোর তোড়জোড়ও শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারতের আর্থিক অনুদান বন্ধ ও ভারতের সমপরিমাণ কর বসানোর হুমকি দিতেই নেতাদের মুখের সেই হাসি উবে গিয়েছে। এরপরেও বিজেপির নেতা কর্মীরা মোদি-মোদি বলে চিৎকার করবেন। কারণ উনিই বিজেপির ব্রান্ড অ্যাম্বাসাডর। কিন্তু তাতে বাংলায় চিঁড়ে ভিজবে না। কারণ রাজ্যবাসী বুঝে গিয়েছে, মোদির রাজত্বে স্লোগান ছাড়া বাংলার জন্য বরাদ্দ শূন্য।
যেকোনও সরকারের ফাঁকফোকর, দুর্নীতি, স্বজনপোষণের ঘটনাকে সামনে এনে রাজনৈতিক ফায়দা তোলে বিরোধীরা। বাংলাতেও সেই সুযোগ ছিল। তবে, সেই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য দরকার হয় সাংগঠনিক শক্তির। সেকথা মাথায় রেখেই অমিত শাহ বাংলায় এসে সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু মিসড কল দিয়ে সদস্য করার সহজতম রাস্তাটিও কাজে লাগাতে পারেনি বঙ্গ বিজেপি। এমনকী, বহু এলাকায় তারা লক্ষ্যমাত্রার ২০ শতাংশও সদস্য করতে পারেনি। আবার কিছু জায়গায় বিরোধী গোষ্ঠী সুবিধা পেয়ে যাবে, এই আশঙ্কায় মণ্ডল সভাপতির নাম ঘোষণা বন্ধ রাখা হয়েছে। তাতে দলের মধ্যে ক্ষোভ দিন দিন বাড়ছে। মণ্ডল সভাপতি ইস্যুতে মুর্শিদাবাদে বিজেপি নেতাদের কুশপুতুল পোড়ানোর ঘটনাও ঘটেছে। কিছু এলাকায় মণ্ডল সভাপতি পরিবর্তনের দাবি ন্যায্য হওয়া সত্ত্বেও তা মানা হচ্ছে না। কারণ ক্ষোভ-বিক্ষোভের প্রবল আশঙ্কা। ঝুলে থাকা মণ্ডলে কারা নেতৃত্ব দেবে, তা নিয়েও চলছে দুই গোষ্ঠীর টানাপোড়েন।
তবে, অভাবনীয় ঘটনাটি ঘটেছে বিজেপির পূর্ব বর্ধমান সাংগঠনিক জেলায়। পূর্ব বর্ধমান জেলার দু’টি লোকসভা আসনেই বিজেপি হেরেছে। বিজেপি কর্মীরা আশা করেছিলেন, ছাব্বিশের লড়াইয়ের কথা মাথায় রেখে সংগঠনের খোলনলচে বদলে ফেলা হবে। আনা হবে নতুন মুখ। কিন্তু দুর্গাপুর মহকুমা বাদ দিয়ে এই সাংগঠনিক জেলার অধিকাংশ মণ্ডল সভাপতিকেই ফের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাতে দিলীপ ঘোষের অনুগামীরা বেজায় ক্ষুব্ধ। কারণ দিলীপ ঘোষকে লোকসভা নির্বাচনে এখানে এনে একপ্রকার ‘দায়িত্ব’ নিয়ে হারানো হয়েছে। হারের জন্য দিলীপবাবু দলের একাংশের দিকে আঙুল তুলেছিলেন। সেই জেলার মণ্ডল সভাপতির তালিকা প্রায় অক্ষত থাকায় অনেকেই বিস্মিত।
বিজেপি সাংগঠনিকভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের মোকাবিলা করার জায়গায় নেই। কিন্তু দলীয় প্রার্থীকে হারানোয় তারা যে পটু, ইতিমধ্যেই তার প্রমাণ মিলেছে। বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রে দিলীপবাবু হেরেছেন। আবার একই অঙ্কে তাঁর ছেড়ে আসা মেদিনীপুর লোকসভা আসনে অগ্নিমিত্রা পল পরাজিত হয়েছেন। বঙ্গ রাজনীতিতে এই দু’জন ভিন্ন শিবিরের মানুষ বলেই পরিচিত। এঁদের একজন জিতলে দিল্লির নেতাদের কাছে তাঁর এবং সেই গোষ্ঠীর কদর বেড়ে যেত। তাই বিরোধী পক্ষ যাতে নম্বর বাড়িয়ে নিতে পারে তারজন্য উভয় শিবিরই ছিল যথেষ্ট তৎপর। তবে, পরিশ্রম বিফলে যায়নি। দু’জনই হেরেছেন। ছাব্বিশের ভোটে যে পুনরাবৃত্তি হবে না, তা বিজেপির অতি বড় অন্ধ সমর্থকও বুক ঠুকে বলতে পারবেন না।
বঙ্গ বিজেপির অবস্থা যত করুণই হোক না কেন, ‘ভোট পুজো’র ঢাকে কাঠি পড়লেই দিল্লির নেতাদের বাংলায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি শুরু হবে। ফের বাড়বে কেন্দ্রীয় এজেন্সির সক্রিয়তা। নেতাদের চ্যালেঞ্জ, পাল্টা চ্যালেঞ্জে সরগরম হবে টিভি চ্যানেলের সান্ধ্যকালীন আসর। সোশ্যাল মিডিয়ায় তুফান তুলবেন বামেরা। কিন্তু তাতে বাংলার রাজনৈতিক সমীকরণ বদলাবে না। কারণ বিজেপি আছে টিভিতে, বামেরা আছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, কিন্তু মমতা আছেন মাঠে, ময়দানে, মানুষের পাশে। তাই মাটি দখলের লড়াইয়ে তিনিই এগিয়ে যান অনায়াসে।