কঙ্গো অথবা লিবিয়া। লেবানন কিংবা নাইজেরিয়া। সারাক্ষণ কেন যুদ্ধ অথবা গৃহযুদ্ধ লেগে থাকে? অভ্যন্তরীণ সংঘাত? দুই গোষ্ঠী, সরকার বনাম বিদ্রোহীর ক্ষমতার লড়াই? গণতন্ত্র বনাম স্বৈরাচার? এসব কারণেই তাবৎ সংঘাত ঘটছে। কিন্তু আসলে সেই কারণ গৌণ। মুখ্য কারণ মিনারেলসের লড়াই। খনিজ সম্পদ। কোন খনিজ? সবথেকে বেশি জরুরি ব্যাটারি নির্মাণে যে সব খনিজের প্রয়োজন। কেন? বিশ্বজুড়ে সবথেকে বেশি চাহিদা এখন লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির। তিনটি কারণে? মোবাইল ইন্ডাস্ট্রি, ইলেকট্রিক ভেহিকেল এবং সোলার এনার্জি। কানাডা, চীন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া সহ আন্তর্জাতিক বহু সংস্থার এক ও একমাত্র লক্ষ্য বিশ্বের সেইসব দেশে প্রবেশ করা, যেখানে এইসব খনিজ পাওয়া যায়।
যে দেশের কাছে যত বেশি ক্রিটিকাল মিনারেলস থাকবে আগামী দিনে, সেই দেশের অর্থনীতি এবং বাণিজ্য তত বেশি ফুলে-ফেঁপে উঠবে। এই প্রবণতাকে আন্তর্জাতিক কূটনীতির জগতে কী বলা হচ্ছে? নিউ কোল্ড ওয়ার। অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে আরও ৪০ শতাংশ বাড়বে বিশ্বের কোবাল্ট ডিমান্ড। সবথেকে বেশি কোবাল্ট অর্থাৎ ৭০ শতাংশ কোথায় উৎপাদন হয়? কঙ্গোয়। কোথায় ২০ বছর ধরে যুদ্ধ অথবা গৃহযুদ্ধ চলছে? কঙ্গোয়। ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অফ এনার্জি ১৭টি ক্রিটিকাল মিনারেলসের তালিকা তৈরি করেছে। যার মধ্যে অন্যতম হল কোবাল্ট, ডিসপ্রোসিয়াম, ন্যাচারাল গ্রাফাইট, ইরিডিয়াম, গালিয়াম ইত্যাদি। ঠিক এই খনিজগুলি প্রধানত কী কাজে লাগে? আর্থ ম্যাগনেট, ব্যাটারি, এলইডি, হাইড্রোজেন ইলেকট্রোলাইজার উৎপাদনে।
ক্রিটিকাল মিনারেলস উৎপাদনে সবথেকে এগিয়ে কোন রাষ্ট্রের সংস্থা? চীন। এবং আমেরিকা সিংহভাগ ক্ষেত্রেই আমদানি নির্ভর। কোথা থেকে আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছে আমেরিকা? চীন। তাহলে আমেরিকার এখনই কী প্রয়োজন? নিজের হাতে প্রত্যক্ষ অধিকারে থাকবে এরকম কোনও খনিজ সম্পদের সম্ভার।
ওয়াশিংটনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট আজ কার সঙ্গে জরুরি বৈঠক করবেন একটি বিশেষ চুক্তি সম্পন্ন করার জন্য? ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে। কী সেই চুক্তি? ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনকে প্রস্তাব দিয়েছেন আমেরিকা ইউক্রেনকে ৩০০ থেকে ৫০০ বিলিয়ন ডলার অনুদান দেবে। ইউক্রেনের পুনর্গঠনের জন্য। বিনিময়ে কী করতে হবে ইউক্রেনকে? তার খনিজ সম্পদের দরজা খুলে দিতে হবে আমেরিকার কাছে। একটি বিশেষ তহবিল তৈরি হবে। তার নাম ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড। সেই তহবিলে থাকা টাকা দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনকে পুনরায় গঠন করা হবে। কিন্তু সেই ফান্ডের অধিকার সিংহভাগ থাকবে আমেরিকার হাতে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের অন্যতম কারণ কী ছিল? ইউক্রেনের মাটির নীচে থাকা অগাধ ক্রিটিকাল মিনারেলস! কত? বিশ্বের ৬ শতাংশ ক্রিটিকাল মিনারেলস ইউক্রেনের মাটির নীচে। যার মধ্যে ২০০ লক্ষ টন গ্রাফাইট আছে। গ্রাফাইট কেন গুরুত্বপূর্ণ? ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাটারি নির্মাণ করা হয় গ্রাফাইট দিয়ে। ক্রাইমেট প্রোটোকলে এক নম্বর দেশ হওয়ার লক্ষ্যে তেল নির্ভরতা কমাতে আমেরিকা ১০০ শতাংশ ইলেকট্রিক ভেহিকেলের লক্ষ্য নিয়েছে। আর তাই গ্রাফাইটের কতটা প্রয়োজন সহজেই অনুমেয়।
কিন্তু এত সহজ নাকি এভাবে ইউক্রেনের খনিজ আমেরিকার হাতে চলে আসা? সহজ নয়। কারণ রাশিয়া কি এতদিন ধরে বিনা কারণে যুদ্ধ করল? কী জানা যাচ্ছে তথ্য পরিসংখ্যানে? জানা যাচ্ছে, ৩৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ক্রিটিকাল মিনারেলস এই মুহূর্তে রয়েছে রাশিয়া অধিকৃত ইউক্রেনের এলাকায়। অর্থাৎ যুদ্ধের সময়সীমায় ইউক্রেনের যে এলাকা রাশিয়া সর্বাগ্রে নিয়ম করে দখল করে নিয়েছে, সেই সবই হল আদতে মাটির নীচে বা পাহাড়ের অন্দরে মিনারেলস থাকা অঞ্চল।
তাহলে কি অবশেষে জলে ভাসতে চলেছে শিলা? অসম্ভবও সম্ভব হবে বাণিজ্যিক লক্ষ্যে? অর্থাৎ আমেরিকা এবং রাশিয়া বন্ধু হয়ে যাবে? রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে সাম্প্রতিক ইউক্রেন সংক্রান্ত প্রস্তাবে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ট্রাম্পের আমেরিকা ভোট দিয়েছে। কী ছিল প্রস্তাব? রাশিয়াকে ইউক্রেনে আাক্রমণকারী বলা যাবে না! আমেরিকা সমর্থন করেছে। গোটা পশ্চিমী দুনিয়া স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে। আর কে এই প্রস্তাবের পক্ষে? উত্তর কোরিয়া! তাহলে ক্রমেই বিশ্বের কোন কোন পাওয়ার সেন্টার পরস্পরের বন্ধু হওয়ার আভাস দেখাচ্ছে? আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া। এই চারটি রাষ্ট্রের মধ্যে সাদৃশ্য কোথায়? চার রাষ্ট্রপ্রধান সবথেকে বেশি পছন্দ করেন একনায়কতন্ত্র মনোভাবকে। গণতন্ত্র নয়, তাঁদের পছন্দ স্বৈরতন্ত্র! তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের দেশে জনপ্রিয়। এবং বলশালী। এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রচারক।
বদলে যাচ্ছে পৃথিবী? আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় সবথেকে বেশি চর্চা এখন যা চলছে, সেটি হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ায় আবার এই প্রথম লক্ষ করা যাচ্ছে নতুন এক বিশ্ব সমীকরণ তৈরি হতে চলেছে। সোজা কথায় এমন একটি সময় ২০২৫ সালে প্রবেশ করেছে, যেটি পৃথিবীর নতুন ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ রচনা করতে চলেছে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা এবং ইওরোপের সঙ্গে ট্রাম্পের আমেরিকা এতদিনের সম্পর্ক ছিন্ন করার ইঙ্গিত দেখাচ্ছে। সম্পূর্ণ নতুন একটি পৃথিবীর ক্ষমতার ভারসাম্য নির্মাণকার্য চলছে। পরিচিত শত্রুপক্ষ এখন পরস্পরের বন্ধু হচ্ছে। ৮০ বছরের পুরনো বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে চরম এক অনিশ্চিয়তার সৃষ্টি হয়েছে। বাণিজ্য, আমদানি, রপ্তানি, মাইগ্রেশন, অভিবাসী নাগরিক এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘ। সব কিছুই অনিশ্চিত একটি সময়কালে প্রবেশ করেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভ্লাদিমির পুতিন, জি জিনপিং এই ত্রয়ী বিশ্বের সবথেকে বেশি ক্ষমতা নিয়ে বসে আছেন। তাঁরা যদি সব শত্রুতা সরিয়ে রেখে হাত মেলান, তাহলে কেমন হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবী? ইওরোপজুড়ে প্রবল আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। তাদের আমেরিকা বার্তা দিয়েছে, চীন অথবা রাশিয়া নয়, ওইসব দেশের আসল সমস্যা নিজেদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি এবং গণতান্ত্রিক পরিসর কমে যাওয়া। আগে নিজেদের অর্থনীতির দিকে তারা নজর দিক। অন্যদের উপর নির্ভরশীল হলে কোনও রাষ্ট্র সম্মান পায় না। খোদ মার্কিন উপ রাষ্ট্রপতি এই বার্তা দিয়েছেন। অর্থাৎ আমেরিকা নির্ভরতা থেকে ইওরোপ বেরিয়ে আসুক।
ঠিক এখানেই প্রশ্ন উঠছে ভারত কী করবে? ট্রাম্প একবারও এখনও পর্যন্ত ভারতকে আমেরিকার লাগবেই এরকম কোনও বার্তা দেননি। তিনি উল্টে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সমান ও বিপরীত শুল্ক চাপানোর। ভারত থেকে বেআইনি পথে আমেরিকা যাওয়া ভারতীয়দের ফেরত পাঠানো শুরু হয়েছে দলে দলে। এমনকী গ্রিন কার্ড নীতির বদল হতে পারে। অর্থাৎ যে অভিবাসীরা আমেরিকার নাগরিক, তাঁদেরও যে সেই নাগরিকত্ব নিরাপদ এরকম নয়। মার্কিন সরকারের পার্সোনেল দপ্তর সরকারি কর্মীদের চিঠি পাঠিয়ে জানতে চেয়েছে গত এক সপ্তাহে কী কাজ করেছেন? বিস্তারিত জানান। জানাতে না পারলে ইস্তফা দিতে হবে। আতঙ্কে সরকারি কর্মীরা।
সুতরাং এমতাবস্থায় এই নতুন বিশ্বসমীকরণের আবহে ভারতকে এখনই স্থির করতে হবে যে, তারা কী করবে। বোঝাই যাচ্ছে, ট্রাম্প চাইছেন কোনওরকম প্রতিপক্ষ শিবির বলে কিছু থাকবে না। থাকবে দুটি শিবির। একদিকে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলির জোট। তারা রাজা। অন্যদিকে দুর্বল রাষ্ট্রগুলি। অর্থাৎ অনুগামী অথবা বিরোধী। দুর্বল রাষ্ট্রগুলি ক্ষমতাবানের জোটে আসতে চাইলেও তাদের জোটসঙ্গী হিসেবে বিবেচনা করা হবে না।
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভান্স গত সপ্তাহে জার্মানির মিউনিখে গিয়ে বলেছেন, হিয়ার কামস দ্য নিউ শেরিফ ইন টাউন! বিশ্ব ক্ষমতায়নের মানচিত্রে নতুন কর্তা এসে গিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি হলেন ট্রাম্প। সুতরাং হয় তাঁর অধীনস্থ হয়ে থাকতে হবে, অথবা তাঁর রোষানলে পড়তে হবে। ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, রাশিয়া মিলে একটি জোট গঠন করেছিল। তার নাম ব্রিকস। সম্প্রতি ট্রাম্প উড়িয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, ব্রিকস ইজ ডেড! ওসব গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রশ্ন হল, এখনও পর্যন্ত ট্রাম্পের কোনও মন্তব্যের প্রতিবাদ কিংবা পক্ষে বিপক্ষে মন্তব্য করেননি ভ্লাদিমির পুতিন! তাঁর মনে কী আছে? জিনপিং কী ভাবছেন? তাঁরা কি ট্রাম্পের প্ল্যানেরই সমর্থক? অর্থাৎ শক্তিশালী কয়েকটি রাষ্ট্র মিলে ক্রমেই হবে অঘোষিতভাবে পৃথিবীর শাসক? বাকিরা প্রজা?
মন্দির, মসজিদ, হিন্দি, হিন্দু, মুসলিম, ওয়ান নেশন ওয়ান ইলেকশন এইসব থেকে এবার তো একটু বেরিয়ে আসতে হবে! দুনিয়া যে বদলে যাচ্ছে! ১৪৩ কোটি জনসংখ্যা এবং ৬৫ শতাংশ যুবসমাজের একটি শক্তিশালী দেশ কি চুপচাপ পৃথিবীর ইতিহাসের এই বদলে যাওয়া স্রেফ দেখে যাবে? ভারত কী করবে?
ভারত সরকার আপাতত ব্যস্ত বিরোধী রাজ্যগুলি দখল নিয়ে। তারা পশ্চিমবঙ্গ দখলেরও ছক কষছে। কেন? কারণ ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, বিহার, দখল হয়ে গিয়েছে। খনিজ সম্পদে অন্যতম প্রধান রাজ্য দখল হয়নি এখনও। বাংলা।