বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ

গিরিশ ঘোষ ও বিনোদিনী

অনিরুদ্ধ সরকার
বেঙ্গল থিয়েটারে ‘কপালকুণ্ডলা’ নাটক দেখতে ভিড় উপচে পড়ছে। সেদিন নাটক দেখতে এসেছেন ন্যাশনাল থিয়েটারের মালিক কেদারনাথ চৌধুরী, সঙ্গে গিরিশ ঘোষ। মঞ্চে নায়িকার অভিনয় দেখে তো গিরিশ ঘোষ মুগ্ধ। খোঁজ নিয়ে জানলেন, অভিনেত্রীর নাম ‘বিনোদিনী’।
বেঙ্গল থিয়েটারের মালিক শরৎচন্দ্র ঘোষ ছিলেন বিনোদিনীর খুব কাছের মানুষ, ‘ছোটবাবু’। গিরিশ ঘোষ তখন মুগ্ধ হয়ে শরৎবাবুর কাছে বিনোদিনীকে অভিনয়ের জন্য চেয়ে বসলেন। প্রভাবশালী গিরিশ ঘোষকে ‘না’ বলতে পারলেন না শরৎবাবুও। কেবল বিনোদিনীকে যেতে দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলেন—‘কী রে বিনোদ, এখান থেকে গেলে তোর মন কেমন করবে না?’ উত্তরে বিনোদিনী কিছু বলতে পারলেন না। কারণ তিনি জানেন, তাঁর মতো মেয়েদের এক জায়গায় থিতু হওয়ার জন্য জন্ম হয়নি। 
‘পুঁটি’ থেকে ‘বিনোদিনী’র যাত্রাপথ মোটেও মসৃণ ছিল না। মা, দিদিমার তত্ত্বাবধানে পুঁটির বেড়ে ওঠার প্রতি পদে ছিল হাজারো বাধা-বিপত্তি, প্রতিবন্ধকতা। কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের অবৈতনিক স্কুলে পুঁটির নাম লেখানো হয়েছিল—‘বিনোদিনী দাসী’ নামে। তাঁদের বাড়িতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন গঙ্গাবাঈ নামে এক গায়িকা। গঙ্গাবাঈ বয়সে বড় হলেও বিনোদিনী সই পাতিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। তারপর এই গঙ্গাবাঈয়ের তালিমেই একদিন পুরুষ মনোরঞ্জনের মেহফিলে হাজির হলেন বিনোদিনী। শুধু হাজির হওয়াই নয়, জমিয়ে দিলেন কলকাতার ‘বাবু’দের আসর।
গঙ্গাবাঈয়ের আসরে তখন আসতেন পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও ব্রজনাথ শেঠ। তাঁরা বিনোদিনীকে ভর্তি করে দিলেন গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে। বেতন—দশ টাকা। তাঁকে শেখানোর ভার পড়ল মহেন্দ্রলাল বসুর উপর। পরে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, অমৃতলালের মতো দিকপাল নাট্যব্যক্তিত্বরা তাঁর শিক্ষার ভার নিলেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে দু’চারটি সংলাপের মাধ্যমে অভিনয় করলেন ‘শত্রুসংহার’ নাটকে। মাত করে দিলেন দর্শকদের। তারপর বেঙ্গল থিয়েটারের হাত ধরে বিনোদিনীকে পেলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। 
বিনোদিনীকে নিজের মতো করে গড়ে তুলবেন বলে ঠিক করলেন গিরিশ। তাঁর কথায়—‘বিনোদ! তোমাকে নিজের হাতে গড়ব। তুমি আমার সজীব প্রতিমা!’ বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন—‘কার্য্য ক্ষেত্রে তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন এবং আমি তাঁহার প্রথমা ও প্রধানা শিষ্যা ছিলাম।’
কেমন ছিল গিরিশ-বিনোদিনীর সম্পর্ক? বিনোদিনীর কথায়, ‘জোর জবরদস্তি, মান-অভিমান, রাগ প্রায়ই চলত। তিনি আমায় অত্যধিক আদর দিতেন, প্রশ্রয় দিতেন।’ গিরিশের কাছে বিনোদিনী অল্পদিনেই হয়ে উঠলেন ‘বিনি’। গিরিশের হাত ধরে বিনির প্রবেশ ঘটল ন্যাশনাল থিয়েটারে। গিরিশ ঘোষের তত্ত্বাবধানে শুরু হল উঁচুদরের অভিনয় শিক্ষার পাঠ।
এদিকে নানা কারণে অবস্থার বিপাকে পড়ে কেদারনাথ চৌধুরী ন্যাশনাল থিয়েটার বিক্রি করতে বাধ্য হলেন। দু’তিনবার হাতবদল হওয়ার পর ন্যাশনাল থিয়েটারের মালিক হলেন প্রতাপচাঁদ জহুরি। গিরিশ ঘোষ হলেন ন্যাশনালের অধ্যক্ষ। শুরু হল নিয়মনিষ্ঠ ব্যবসায়িক থিয়েটারের এক নতুন যুগ। যে সময়কালকে নির্দ্বিধায় ‘গিরিশ-বিনোদিনীর’ যুগ বলা চলে। এক অদ্ভুত সমীকরণ গড়ে উঠল গুরু-শিষ্যার মধ্যে।
বিনোদিনী লিখছেন, ‘গিরিশবাবুর মুখে শেক্সপিয়র, মিলটন, বায়রন, পোপের সাহিত্য আস্বাদনের আকর্ষণও কম ছিল না। শেখানোর আগে অনেক সময়েই গোটা নাটকটা পড়তেন গিরিশ। তখন সকল শ্রোতা নাটকীয় সব চরিত্রের ছবি, রূপ, কল্পনা—জলজ্যান্ত ছবির মতো দেখতে পেতেন।’ মধুসূদন, নবীনচন্দ্র ও বঙ্কিমের বহু গদ্য ও কাব্যকে নাট্যরূপায়িত করেন গিরিশবাবু। তৈরি করেন ‘গৈরিশ ছন্দ’ নামের এক সংলাপ-রচনার নতুন ভঙ্গিমা।
গিরিশ ঘোষের দলে আসার পর তাঁর সান্নিধ্যে বিনোদিনী হয়ে উঠলেন বাংলা নাট্যমঞ্চের একচেটিয়া ‘নাট্যসম্রাজ্ঞী’। ‘সীতা’, ‘প্রমীলা’, ‘কৈকেয়ী’, ‘মতিবিবি’র মত নারীপ্রধান চরিত্রগুলি তাঁর অভিনয়গুণে হয়ে উঠল বাস্তব।
বঙ্কিমচন্দ্র একসময় বাংলা নাটক দেখে প্রায়শই ঠাট্টা করে বলতেন, ‘না-টক, না-মিষ্টি’। সেই বঙ্কিমবাবুই নিজের উপন্যাস মৃণালিনীর নাট্যরূপে ‘মনোরমা’ চরিত্রে বিনোদিনীর অভিনয় দেখে বললেন, ‘আমি মনোরমার চরিত্র পুস্তকেই লিখিয়াছিলাম, কখনও যে প্রত্যক্ষ দেখিব এমন আশা করি নাই। আজ বিনোদের অভিনয় দেখিয়া সে ভ্রম ঘুচিল।’
সে সময়ের প্রতিটি সংবাদপত্রে যেমন গিরিশ ঘোষের নাম বের হতো, তেমনই বিনোদিনীর অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করে সংবাদ প্রকাশিত হতো। অভিনয়ের অসাধারণ ক্ষমতার মুগ্ধ হয়ে বিনোদিনীকে সে সময়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা তাঁকে ‘ফ্লায়ার অফ দি নেটিভ স্টেজ’, ‘প্রাইমা ডোনা অফ দি বেঙ্গলি’ সহ বিভিন্ন অভিধায় ভূষিত করে।
দিনে দিনে নটী বিনোদিনীর বাড়ি কলকাতার ‘বাবু’ তথা কালচারাল এলিটদের আড্ডাখানায় পরিণত হল। সে আড্ডায় গিরিশ ঘোষ তো ছিলেনই, পাশাপাশি অমৃতলাল বসুর মতো দিকপালরাও নিয়মিত অংশ নিতে শুরু করলেন। মাঝেমধ্যেই গিরিশের উদ্যোগে বিনোদিনীর বাড়িতে মেহফিল বসত। সেই মেহফিল এতটাই জমে উঠত যে, ভোররাত অবধি কেউই আসর ছেড়ে নড়তেন না। অমৃতলাল বসু ‘অমৃত মদিরা’য় সেইসব দিনের কথা লিখছেন। তিনি লিখছেন, ‘গিরিশের পদাবলী রোম্যান্সের মেলা/ কবিতা লিখায়ে তাই বিনি করে খেলা/ হাসির কথায় নিশ হয়ে গেছে ভোর/ তথাপি ওঠে না কেহ ছাড়িয়া আসোর।’
একবার পনেরো দিনের ছুটিতে কাশীতে বেড়াতে যান বিনোদিনী। সেখানে আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়ায় অভিনয়ে যোগ দিতে পারেননি। তার ফলে বিনোদিনীর বেতন বন্ধ করে দিলেন ন্যাশনাল থিয়েটারের মালিক প্রতাপচাঁদ জহুরি। ব্যস! আত্মসম্মানী বিনোদিনী তখনই থিয়েটার ছেড়ে দিতে চাইলেন। গিরিশ ঘোষ ও অন্য গুণীজনেরা নিজেরা থিয়েটার গড়বেন বলে কোনওমতে নিরস্ত করলেন বিনোদিনীকে।
গিরিশচন্দ্র ঘোষ ন্যাশনাল থিয়েটারে কাজ করতেন চুক্তিভিত্তিক বেতনে। নতুন করে একটা থিয়েটার নির্মাণ করার মতো সামর্থ্য তাঁর ছিল না। অতএব সহায় আদরের ‘বিনি’!
গুর্মুখ রায় নামে এক মাড়োয়ারি যুবক তখন বিনোদিনীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন। গুর্মুখ রায় ছিলেন বিখ্যাত হোরমিলার কোম্পানির ‘বেনিয়ান’ গণেশদাস মুসাদ্দির ছেলে। গুর্মুখের থিয়েটার প্রেমের কারণ একটাই—বিনোদিনী। আর সেই কারণেই বিনোদিনীর থিয়েটারের জন্য তিনি টাকা দিতে রাজি হলেন। শর্ত একটাই—‘বিনোদিনীকে রক্ষিতা হিসেবে চাই।’
বিনোদিনী দাসীর অনেক ‘বাবু’ থাকলেও টাকার বিনিময়ে ভালবাসা লেনদেন করার স্তরের নারী তিনি ছিলেন না। এদিকে, গিরিশবাবু যে কোনও মূল্যে নতুন থিয়েটার গড়বেন, এমন একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। তার জন্য গিরিশ যে কোনও মূল্য দিতে রাজি! যে কারণে বিনোদিনীকে মাড়োয়ারির কাছে একপ্রকার বন্ধক দিতেও রাজি হয়ে যান তিনি। আর বললেন—‘থিয়েটারই তোমার উন্নতির সোপান বিনি।’ বিডন স্ট্রিটে জমি নেওয়া হল। বিনোদিনী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সমস্ত কাজের তদারকি করতে লাগলেন। এমনকী ঝুড়ি করে মাটি অবধি ফেললেন।
বিনোদিনীর এই অংশগ্রহণ এবং নিষ্ঠা দেখে কেউ কেউ দক্ষিণেশ্বর মন্দির নির্মাণ ও রানি রাসমণির প্রসঙ্গ অবধি টেনে আনলেন। গুর্মুখ, গিরিশ ঘোষ এবং অন্যান্য শিল্পীদের সর্বসম্মতিতে থিয়েটারের নাম ঠিক হল বিনোদিনীর নামে—‘বি-থিয়েটার’।
অবশেষে একদিন নির্মাণ কাজ শেষ হল। কিন্তু বিনোদিনীর জন্য অপেক্ষা করছিল এক বিরাট প্রতারণা। উদ্বোধনের দিন সকালে বিনোদিনী দেখলেন তাঁর নামের জায়গায় জ্বলজ্বল করছে অন্য একটি নাম—‘স্টার থিয়েটার’! কারণ, বারাঙ্গনার নামে থিয়েটারের নামকরণ হয় নাকি!
লজ্জা, ঘৃণা অপমানে চোখ ছলছল করে উঠল বিনোদের। ছুটলেন গুরুর কাছে। গুরু সান্ত্বনাবাক্য শোনালেন—‘নামে কি যায় আসে বিনি, কাজটাই আসল।’ গুরুদেবের কথা মেনে নিলেন শিষ্যা। এদিকে, বিনি জানতেন না যে গুরুদেব স্বয়ং চান না তাঁর নামে থিয়েটার হোক।
শুধুমাত্র থিয়েটারের নাম থেকে নয়, থিয়েটার থেকেও বিনোদিনীকে বাদ দেওয়ার জন্য শুরু হল এক গভীর ষড়যন্ত্র। যে কারণে দু’মাসের মতো স্টার থিয়েটার থেকে দূরে সরে যেতে হল বিনোদিনীকে। গুর্মুখের হস্তক্ষেপে অবশেষে ফিরলেন বিনোদ। কারণ গুর্মুখ সাফ জানিয়ে দিলেন, তিনি বিনোদিনীর জন্য পয়সা ঢেলেছেন। বিনোদিনী না থাকলে তিনি একটি কানাকড়িও দেবেন না। ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থানকারী গিরিশবাবুও প্রমাদ গুণলেন। বিলক্ষণ বুঝতে পারলেন, বিনোদিনী ছাড়া স্টার অচল। অবশেষে ফিরলেন বিনি।
স্টার থিয়েটারের প্রথম নাটক ‘দক্ষযজ্ঞ’তে সতীর ভূমিকায় বিনোদিনীর অভিনয় সকলকে অভিভূত করল। এই স্টার থিয়েটারের মেগা হিট ‘চৈতন্যলীলা’ দেখতে একদিন হাজির হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। ঠাকুর বিনোদিনীর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে বললেন—‘আসল নকল একই দেখলাম।’ ঠাকুরের আশীর্বাদ আর চৈতন্য চরিত্রের গভীরতা বিনোদিনীকে এক অন্য ভাবজগতে নিয়ে গেল। দীর্ঘ ছ’মাস চৈতন্য চরিত্র থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলেন না তিনি। এদিকে, গিরিশ ঠাকুরের উপদেশ, ‘নাটকে লোকশিক্ষা হয়।’ এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে নিজের অবস্থান নিয়ে বললেন—‘থিয়েটার শুধু বিনোদন নয়। মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠানও।’ 
অন্যদিকে, পরিবারের চাপে পড়ে স্টারের সত্ত্ব বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন গুর্মুখ। তিনি বিনোদিনীকে স্টারের পুরো সত্ত্বাধিকারী করে চলে যেতে চাইলে, বারাঙ্গনার অধীনে শিল্পীরা কাজ করবেন না বলে এক তীব্র বিরোধিতা শুরু হয়। হাত বদল হল স্টারের। ১১ হাজার টাকার বিনিময়ে স্টারের নতুন মালিক হলেন অমৃতলাল বসু, অমৃতলাল মিত্র, হরিপ্রসাদ বসু ও দাসুচরণ নিয়োগী।
মালিকানা বদলের পর বিনোদিনীর সঙ্গে স্টারের বিরোধ লেগেই থাকত। একটা সময় এমন এল যে গিরিশ ঘোষও বিনোদিনীর পক্ষ নেওয়া বন্ধ করে দিলেন। তখন অভিমানী বিনোদিনী থিয়েটার ছাড়লেন। স্টারে তাঁর শেষ অভিনীত নাটক—‘বেল্লিক বাজার’।
অভিনেত্রী বিনোদিনী এক অসাধারণ লেখিকাও ছিলেন। বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনীর জন্য গুরু গিরিশ ঘোষকে ভূমিকা লিখতে বলেছিলেন। গিরিশ ঘোষ লিখেও দিয়েছিলেন কিন্তু সে লেখা বিনোদিনীর পছন্দ হয়নি। বিনোদিনীর কথায়—‘ভূমিকা আমার মনের মতন হয় নাই।’ বিনোদিনীর মনে হয়েছিল, সত্যি কথাগুলি চেপে গিয়েছেন গিরিশ। কার্যত গিরিশের ভূমিকা বাদ দিয়ে নিজের বই ছাপিয়ে ছিলেন বিনোদিনী। পরের বছরই সেই বইয়ের দ্বিতীয় মুদ্রণ বের হয়েছিল। পরে গিরিশ ঘোষ অবশ্য বিনোদিনীকে আরও একটি ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন।
বিনোদিনী থিয়েটার ছাড়লে স্টার থিয়েটারের গুরুত্ব অনেকটাই কমে যায়। পরে মতিলাল ‘শীল বাড়ির’ গোপাললাল শীল স্টার থিয়েটারের জমি কিনে গড়ে তোলেন এমারেল্ড থিয়েটার। গিরিশের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। গিরিশ অনুগামীরা এরপর যান হাতিবাগানে। ৭৫/৩, কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে জমি কেনা হয় স্টার থিয়েটারের নতুন রূপ দেওয়ার জন্য।
গোপাললালের এমারেল্ড থিয়েটারে বেশ কিছুকাল মাসিক তিনশো পঞ্চাশ টাকার বেতনে কাজ করেছেন গিরিশ ঘোষ। সে টাকা দিয়ে তিনি পুরনো দলকে উজ্জীবিত করেছেন। অবশেষে একদিন নিজের প্রিয় শিষ্যদের কাছ থেকেই জুটল চূড়ান্ত লাঞ্ছনা, অপমান! স্টার থেকে গিরিশ ঘোষকে তাড়িয়ে দিলেন তাঁরই শিষ্যরা। বরখাস্ত হলেন ‘বঙ্গের গ্যারিক’ গিরিশচন্দ্র ঘোষ। শিষ্যা তো আগেই গিয়েছিলেন, এবার গুরুও বিতাড়িত হলেন স্টার থেকে।
এরপর অনেক ভক্ত গিরিশবাবুর কাছে বিশেষ একটি আবদার নিয়ে এলেন, তাঁর পঁয়তাল্লিশ বছরের অভিনয় জীবন নিয়ে কিছু লেখার জন্য। তা শুনে গিরিশবাবুর উক্তি—‘বেদব্যাসের মতো যেদিন অকপটে আত্মদোষ বলতে পারব, সেদিন লিখব ভাই।’
একে একে সংসারের মায়া কাটিয়েছে গিরিশের কাছের সব আপনজন। চলে গিয়েছেন গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ, বন্ধু বিবেকানন্দ। ইহলোক ত্যাগ করেছেন নিবেদিতাও। একদিকে সংসারজুড়ে দুঃখের পাহাড়, অন্যদিকে থিয়েটার ঘিরে মামলা-মোকদ্দমায় জেরবার গিরিশ শেষে চুক্তিভিত্তিক কর্মীতে পরিণত হলেন।
১৯১১ সাল। ‘বলিদান’ নাটকে শেষ অভিনয় গিরিশের। করুণাময়ের চরিত্রে বারবার খালি গায়ে স্টেজে আসছেন। ঠান্ডা লাগল। শয্যাশায়ী হলেন। হলে কী হবে, জন্ম-প্রতিভা। বিরাম নেই। লিখেই চলেছেন। রোগশয্যায় লেখা নাটক ‘তপোবল’ উৎসর্গ করলেন নিবেদিতাকে। ১৯১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে চলে গেলেন গিরিশ ঘোষ।
গিরিশের মহাপ্রয়াণের পর কলকাতার টাউন হলে বর্ধমানের রাজা বিজয়চাঁদ মহতাবের সভাপতিত্বে এক বিরাট শোকসভা অনুষ্ঠিত হল। সারদাচরণ মিত্র, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেশচন্দ্র সমাজপতির মতো দিকপালেরা মঞ্চ আলো করে বসলেন। গোল বাধলো গিরিশের হাতে তৈরি অভিনেত্রীদের প্রবেশ ঘিরে। সুশীল সমাজ তাঁদের প্রবেশ 'নিষিদ্ধ' ঘোষণা করলো। কারণ তাঁরা অভিনেত্রী হলেও 'বারাঙ্গনা'। এর প্রতিবাদে স্টার থিয়েটারে অভিনেত্রী সুশীলবালার নেতৃত্বে সেপ্টেম্বর মাসে অভিনেত্রীদের তরফ থেকে গিরিশ ঘোষের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একটি শোকসভা হয়। অভিনেত্রী সুশীলবালা সেদিন বলেন, "আমরা পতিতা, সমাজ বর্জিতা বটে — কিন্তু আমরা মানুষ।" বিনোদিনী এই শোকসভায় ছিলেন কিনা তা অবশ্য জানা যায় না!
আর থিয়েটার ছাড়ার পর বিনোদিনীর কি হল? লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান বিনোদিনী। গিরিশ ঘোষ থেকে ঠাকুরবাড়ির জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কিংবা ডাক্তার আর জি করের সাথে নাম জড়ালেও তাঁকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিলেন উত্তর কলকাতার এক বনেদি জমিদার পুত্র 'সিংহ বাবু'। ভালোবেসে বিনোদিনী ডাকতেন- 'রাঙাবাবু'। বিনোদিনীর একমাত্র শিশুকন্যাটি মারা যায় ১৩ বছর বয়সে। ভেঙে পড়েন বিনোদিনী। আর রাঙাবাবুর চলে যাওয়ার পর বিনোদিনী পুরোপুরিভাবে ভেঙে পড়েন।
বিনোদিনীর স্টার থিয়েটার ত্যাগ ও গিরিশ ঘোষের মৃত্যুর পরও একাধিক হাত বদল হয় স্টারের। নাট্যব্যক্তিত্ব অহীন্দ্র চৌধুরী তখন স্টার থিয়েটারে যোগ দিয়েছেন। তিনি এক স্মৃতিকথায় লিখছেন- "বিনোদিনী তখন প্রায়ই থিয়েটার দেখতে আসতেন।যথেষ্ট বৃদ্ধা হয়েছেন। তখন ওঁর বয়স ৬২ কিন্তু থিয়েটার দেখার আগ্রহ যায় নি। নতুন বই  হলে উনি তো আসতেনই, এক কর্ণাজ্জুন যে কতবার দেখেছেন তার ইয়ত্তা নেই। মুখে হাতে তখন তাঁর শ্বেতী বেরিয়েছে। একটা চাদর গায়ে দিয়ে আসতেন। এসে উইঙ্গেসের ধারে বসে পড়তেন।"
এভাবে বিনোদিনীও একদিন হারিয়ে গেলেন।১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। আশ্চর্যের বিষয় গুরু এবং শিষ্যার মৃত্যু হয়েছিল একই মাসে।
 বিনোদিনীর মৃত্যুর পর এক লাইনও লেখেনি শহর কলকাতার কোনও কাগজ।স্টার থিয়েটারের ঠিক পাশের গলিতে বিনোদিনীর নামাঙ্কিত ফলকওয়ালা বাড়ি আজও তাঁর অস্তিত্বকে জানান দেয়। আর রাজবল্লভপাড়া থেকে বাগবাজার যাবার পথে বড় রাস্তার ওপর 'গিরিশ ভবন' বছরে একবার ফেব্রুয়ারি মাসে জানান দেয় তাঁর অস্তিত্ব!
- অঙ্কন : সুব্রত মাজী
-গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
-সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস
7h 7m ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

হঠাৎ পাওয়া যোগাযোগের মাধ্যমে কর্ম জটিলতার অবসান ও মানসিক চিন্তামুক্তি। আয় ব্যয়ের ক্ষেত্র ঠিক থাকবে...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৫.৮৮ টাকা৮৭.৬২ টাকা
পাউন্ড১০৭.৮৬ টাকা১১১.৬২ টাকা
ইউরো৮৯.১৯ টাকা৯২.৫৮ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা