বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ

পুণ্যের আশা, রাজনীতির ফল
শান্তনু দত্তগুপ্ত

ভিড়ের স্রোতের মধ্যে বয়ে যেতে যেতেই ডান পা’টা আটকে গেল রামশরণের। কাঁধে একটা ঝোলা, আর ডান হাতে ব্যাগটা থাকায় প্রথমে ঠাহর করতে পারলেন না। ঘাড়টা একটু বেঁকিয়ে দেখতে পেলেন, এক বৃদ্ধা তাঁর পা’টা চেপে ধরেছে। দু’চোখ বেয়ে ঝরে পড়ছে জল। থমকে গেলেন রামশরণ। কী চায়? টাকা? খাবার? এই দুটোর একটাও তো তাঁর কাছে নেই! ঝোলায় কেজিখানেক ছাতু এনেছিলেন। তার কিছুটা পড়ে আছে। পকেটে ৫০ টাকার মতো। ধানবাদ ফিরবেন কীভাবে, জানেন না। এই বৃদ্ধাকে কী দেবেন? ‘বাবু আমার ছেলেটাকে খুঁজে পাচ্ছি না। একটু খুঁজে দেবে?’ ইতস্তত করলেন রামশরণ। কোথায় খুঁজবেন? নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা করে যেখানে, সেই জায়গাটা তিনি জানেন। ওই দক্ষিণদিকে বেশ কিছুটা দূরে। এতটুকুই সাহায্য তিনি করতে পারেন। কিংবা বাকিদের মতো পারেন না। হাজারে হাজারে মানুষ মাটিতে পড়ে থাকা বৃদ্ধার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে... দেখেও দেখছে না। তিনিও কি তাই করবেন? বেশিক্ষণ ভাবতে হল না। ভিড়ের স্রোতে জোর একটা ঢেউ উঠল। তিনিও চলে গেলেন ঘাটের অভিমুখে। আরও একটু। পিছনে পড়ে থাকল ছেলেহারা অশীতিপর মা। 
এটাই প্রয়াগ। এটাই কুম্ভ। এটাই প্রচার।
১৪৪ বছরে একবার। আর তাই মানুষ ছুটেছে। সহায়-সম্বলের ভরসা না করেই। যেদিকে নজর যায়, শুধুই মানুষ। জাতীয় সড়ক, মাঠঘাট, নদীর চর। ধুলো উড়িয়ে সবাই চলেছে সঙ্গমের উদ্দেশে। তাঁবুর ভাড়া চড়েছে ৩২ হাজার টাকা পর্যন্ত। সোর্স না খাটালে আখড়ায় জায়গা হবে না। বস্তির মধ্যে খুপচি ঘরও ডেইলি ৬ হাজার টাকা ভাড়া। যাদের সম্বল করে পুণ্যার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর প্রচারে নেমেছে যোগী সরকার, তাদের কিন্তু না আছে টাকা, না সোর্স। তারা পারে শুধু হাঁটতে। অবিরাম। একের আঁচলের সঙ্গে অন্যের খুঁট বেঁধে। শক্ত করে হাত ধরে। ভয় তাদের যে একটাই—হারিয়ে যাওয়ার। ভিড়ের স্রোতের সামনে থাকা লোকটি যদি ডানদিকে যায়, তার পিছনের শতশত মানুষ সেদিকেই ছোটে। তারপর যদি তাকে পুলিস বাঁদিকে যেতে বলে, পিছনের স্রোতও সেই মুখী। ভিআইপি ট্রিটমেন্ট তাদের জন্য নয়। এই ভারতের হাঁটাপথের পাশ দিয়ে চলে যায় এসি গাড়ির কনভয়। তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপও করে না। কালো কাচের এপারে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ভারতের জন্য ঘাট বা জল আলাদা করা থাকে না। ঘণ্টায় দেড়-দু’হাজার টাকা দিয়ে নৌকা ভাড়া করে সঙ্গমে যাওয়ার ক্ষমতাও তাদের নেই। ওখানে স্নানের জন্য ১০-১৫ হাজার টাকা দেওয়ার সামর্থ্যও তাদের অধরা। এরা চায় শুধু তিনটি ডুবকি দিতে। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। সব পাপ তাতেই ধুয়ে যাবে। আর কখনওই যে সুযোগ আসবে না! ১৪৪ বছর কে বাঁচবে? যা করার এবারই করতে হবে। যোগীজি তো তাই বলেছেন! টিভি দেখাচ্ছে। রেডিও বলছে। পাপ ধুতে হলে যেতে হবে এবারই। বাংলা থেকে গুজরাত, উত্তরাখণ্ড থেকে তামিলনাড়ু... দলে দলে আসছে ভারত। ট্রেনে জায়গা না পেয়ে তারা এসি কোচের কাচ ভাঙছে, উঠে পড়ছে ইঞ্জিনে, চড়ছে লরিতে, কিংবা হাঁটছে। একটু পুণ্য কামিয়ে নেওয়ার আশায়। কিন্তু তাদের কেন্দ্র করেই যে অনেকটা রাজনীতি কামিয়ে নিচ্ছে আর এক দল! জন্ম দিচ্ছে কুম্ভ ইকনমির। হিসেব হচ্ছে ৩ লক্ষ কোটির ব্যবসার। অঙ্কটা বাড়ছে। প্রতিদিন। পুণ্যার্থীর সংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। 
এই রাজনীতির প্রাপ্তি কী? শুধুই ধর্ম? তা তো নয়। পূর্ণকুম্ভ চিরকালই সনাতন ধর্মের জোয়ার আছড়ে পড়ার ভরকেন্দ্র। ১৪৪ বছরের অঙ্কটা সেই স্রোতকে সুনামির আকার দিয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। সেটাই হওয়ার ছিল। মহাকুম্ভের প্রচার তাতে আরও একটু ঠেলা দিয়েছে মাত্র। আসলে এই একটি মহামিলন ক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে কয়েকজন নিজেদের আখেরটুকু গুছিয়ে নিতে নেমেছেন। যেমন? ১) যোগী আদিত্যনাথ। এই মেলার ‘সাফল্য’ সামনে রেখে জাতীয় রাজনীতিতে প্রতিযোগীর সংখ্যা কমিয়ে ফেলছেন তিনি। অমিত শাহ, রাজনাথ সিং, নীতিন গাদকারি... এই নামগুলো এখন তাঁর কাঁধের নীচে চলে গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদির পর কে? এই প্রশ্নে তাঁর নামটা আগে আসবে। সনাতনী সংগঠন এবং আখড়াগুলিও যদি এখন তাঁকে সমর্থন জোগান, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। দু’বছর পর উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন। যোগীর বিরুদ্ধ-লবি কলকাঠি নাড়লেও যাতে তারা হালে খুব একটা পানি না পায়, সেই ব্যবস্থাই নিশ্চিত করতে চাইছেন যোগী। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মাঠে নামলে ’২৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ম্যাচ প্র্যাকটিসটা সারা হয়ে যাবে তাঁর। ২) নরেন্দ্র মোদি। আঞ্চলিক দলগুলির রমরমা যে হারে বাড়ছে, তাতে জনপ্রিয়তার মিথ ধরে রাখাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে তাঁর পক্ষে। কুম্ভমেলা যদি তাঁর চেনা ফর্মুলায় (অর্থাৎ হিন্দুত্বে) ঠিকঠাক শান দিতে পারে, সেটা জনপ্রিয়তা, পদ এবং প্রাপ্তি—সবকিছুই ধরে রাখার সহায়ক হবে। ৩) আরএসএস। সরসঙ্ঘ চালক মোহন ভাগবত গত কয়েক মাস ধরেই দলের থেকে সংগঠনকে আগে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাজপেয়ি জমানার পর সঙ্ঘের প্রভাব-প্রতিপত্তির জ্বালানি কমতে শুরু করেছিল। নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে পুনরুজ্জীবন ঘটেছিল তাদের। তারপর সঙ্ঘ বহরে বেড়েছে, বাড়ির আকারেও। ২০২৫ আরএসএসের শতবর্ষ। পোস্টার বয় যদি পোস্টারের ভার বহন করতে না পারে, তাকে সরিয়ে দিতে এখন দু’মিনিটও লাগবে না সঙ্ঘের। কুম্ভমেলা, ধর্ম সম্মেলন এবং হিন্দুত্ব—সঙ্ঘ এখন আর পিছনে তাকাতে চায় না। 
এটাই এখন ঘোর বাস্তব। কারবারিরা জানেন, এই ভারতের চাল কেনার টাকা নাই থাকতে পারে। তারা ধর্মে যাবে। পুণ্য করতে যাবে। পাপ ধুয়ে ফেলতে যাবে। এটাই তাদের আবেগ। বিশ্বাস। আশাও বটে। ঈশ্বরকে পাওয়ার। এই জিগির যত কাজে লাগানো যাবে, ততই বাড়বে বেওসা। 
এবারের কুম্ভ কেন অন্যবারের থেকে আলাদা? শুধুই কি ১৪৪ বছরের অঙ্কে? না। এবারের কুম্ভ দেখিয়েছে, সাধারণের সঙ্গে অসাধারণের মিল এই মেলায় আর হচ্ছে না। দলিতের পাশে বসে ধনী শিল্পপতিকে আর ভাণ্ডারা খেতে দেখা যাচ্ছে না। সদগোপের পাশে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে কোনও কোটিপতি প্রবচন শুনছেন না। তাঁদের কাছে এই কুম্ভমেলা সত্যিই ‘হ্যাপেনিং’। দারুণ ব্যবস্থাপনা, পুলিসি সাহায্য, আলাদা জায়গায় স্নান... কে বলে ‘মিসম্যানেজমেন্ট’? বাংলার এমপিও ডুবকি লাগিয়ে উঠে বলছেন, এমন সুন্দর অভিজ্ঞতা হয়নি আগে। ঠিক জায়গা মতো প্লাগ গোঁজার সংস্থান যাঁদের আছে, তাঁদের কাছে সবটাই মিথ্যা প্রচার। মাউন্টেড পুলিস যাঁদের একমাত্র সম্বল ওই ঝোলাটুকু ঘোড়ার খুরের নীচে পিষে দিচ্ছে না, তাঁরা উপভোগ করছেন এই ধর্মীয় মহামিলনকে। কিন্তু তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, 
তাঁদের সংখ্যাটা পাঁচ হলে সত্যিকারের ভারত পাঁচ লক্ষ। ভিআইপিদের প্রচার ওই ভারতের জন্য নয়। সুবিধাও নয়। তাদের প্রিয়জন এই মেলায় এসে পদপিষ্ট হয়, তবু তারা হাঁটে। উন্মুক্ত জায়গাতেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হয় তাদের। পুলিস, সাফাইকর্মী দাঁড়িয়ে দেখে। হাসে। আঙুল তুলে দেখিয়ে সহকর্মীর সঙ্গে মজা করে। লজ্জায় মুখটুকু ঢেকে তারা ঈশ্বরকে ডাকে। তাও আসে। মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায় অজানায়, মেলে না ঠিকঠাক ডেথ সার্টিফিকেট, কিংবা কখনও দেহটাও... তবু তারা হাত জোড় করে ডুব দেয় পুণ্যসলিলায়। সামান্য একটু পুণ্যের খোঁজে। ট্রেনে উঠতে গিয়ে ভিড়ের চাপে চিরতরে হারিয়ে যায় তাদের স্ত্রী-মেয়ে। তারপরও তারা খোঁজ নেয় প্রয়াগরাজ স্পেশালের। কারণ যে একটাই... ১৪৪ বছর। হ্যালির ধুমকেতুও ৭৬ বছরে আসে। আর মহাকুম্ভ ১৪৪ বছরে একবার। এ সুযোগ পাবে না আর... তাই দাম দিয়েই চলেছে সত্যিকারের ভারত। গরিব ভারত। ধর্মপ্রাণ ভারত। তারা ভাবছে না যে, এই সুযোগে কতই না রাজনীতি কামিয়ে নিচ্ছে ভেকধারী গেরুয়া বাহিনী। এই ভারতের কাছে তুচ্ছ যে মৃত্যুও! ভিড় তাই আসানসোল স্টেশনে, লখনউ থেকে এলাহাবাদগামী জাতীয় সড়কে, পাটনা থেকে মুঘলসরাইগামী বাসে। সেই ভিড় সম্পৃক্তও নয়... অতিপৃক্ত। বাতাস গলে যাওয়ারও জায়গা নেই তাতে। তীর্থের এমনই টান। পুণ্যলাভের এমনই মহিমা। 
গোকুলে ছোট্ট শ্রীকৃষ্ণ সেই পুরোহিতকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তীর্থে গিয়ে কী খুঁজে পেলেন?’ পুরোহিত মশাই উত্তর দিয়েছিলেন, ‘শান্তি।’ শ্রীকৃষ্ণের আবার প্রশ্ন ছিল, ‘আর ঈশ্বর?’ পুরোহিতের জবাব ছিল, ‘তাঁকে কি বললেই পাওয়া যায়? অনেক সাধনা করতে হয়। অনেক তীর্থ করতে হয়।’ হেসে শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘কে জানে, তীর্থে গিয়েও যা পাননি, হয়তো এই বাড়িরই কোনও কোণার ঘরে তাঁকে পেয়ে যাবেন।’ রাজনীতি আমাদের এই শিক্ষা দেয় না। বরং তারা ধর্মের মোড়কটাকে আরও বেশি চেকনাই করে তোলে। তারা ডাকে... আরও বেশি করে। তাহলেই যে তাদের অর্থনীতির শ্রীবৃদ্ধি। ক্ষমতার উত্তরণ। মনে পড়ে ‘বর্তমান’-এরই সাংবাদিক সমৃদ্ধ দত্তর এক অভিজ্ঞতার কথা। প্রয়াগেই তাঁর দেখা হয়েছিল খয়রাশোল থেকে যাওয়া উজ্জ্বল পালের সঙ্গে। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ভগবানের মোবাইল নম্বরটা জানেন তো?’ সাংবাদিক দু’পাশে মাথা নাড়লে একটু ক্ষুণ্ণ হয়ে তাঁর উত্তর ছিল, ‘এটাও জানেন না!’ কর গুনতে গুনতে শিখিয়েছিলেন উজ্জ্বলবাবু আট ডিজিটের নম্বর... ‘হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ, কৃষ্ণকৃষ্ণ হরেহরে/ হরেরাম হরেরাম, রামরাম হরেহরে।’ বলেছিলেন, ‘এই নিন। সারাদিন যখন সময় পাবেন, ডায়াল করবেন। একদিন না একদিন কানেকশন হবেই।’ 
এটাই যে সনাতন ভারত। তারা রাজনীতি জানে না। বোঝে না। দুঃখ পায়। প্রিয়জনের দেহ কাঁধে নিয়ে বাড়িতে ফেরে। তারপরও ক্ষমা করে দেয় রাজনীতির কারবারিদের। ঠাকুরের আসল শিক্ষাটা যে তারাই নিয়েছে... ‘ক্ষমা পরম ধর্ম’। তাই এই ভারত সাধনায় মাতে। কর্ম করে। ফলের আশা না করেই। 
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পরিবারের কারুর ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি চিন্তায় মানসিক চাপ বৃদ্ধি। ব্যবসাপাতি হলেও অর্থপ্রাপ্তিতে বাধা থাকবে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৫.৭৮ টাকা৮৭.৫২ টাকা
পাউন্ড১০৮ টাকা১১১.৭৮ টাকা
ইউরো৮৯.৪৬ টাকা৯২.৮৬ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা