‘পিয়া ভোলো অভিমান মধু রাতি বয়ে যায়...’। বর্ষামুখর রাতের আকাশে তখন আরও গাঢ় হচ্ছে অন্ধকার। গজলের মিঠে সুর আর গাড়ির জানালা দিয়ে ছুটে আসা জোলো হাওয়ার ঝাপটায় ক্রমশ বুজে আসছে চোখ। পিছনে পড়ে রইল অমৃতসরের বিখ্যাত স্বর্ণমন্দির, দিল্লির লালকেল্লা, আগ্রার তাজমহল, সারনাথের অশোক স্তম্ভ, বেনারসের শ্রী কাশী বিশ্বনাথ মন্দির...। এক সময়কার গর্বের জিটি রোড বা শের শাহ সুরি মার্গ ধরে ফিরছি কলকাতায়। অমৃতসর থেকে কলকাতা—খণ্ডিত ভারতীয় উপমহাদেশের বুকে ২,৫০০ বছর পুরনো এই মহাসড়কের অবস্থান এখন এইটুকুতেই সীমাবদ্ধ। মোটামুটিভাবে ১২, ২৭, ১৯, ৪৪ এবং ৩ নম্বর ন্যাশনাল হাইওয়ের মধ্যে। কিন্তু তার পরতে পরতে আজও অনুভব করা যায় বিবর্ণ হয়ে আসা এক ইতিহাসের হৃদস্পন্দনকে। কারণ, এটি ‘কেবল একটি মহাসড়ক নয়, বরং পৃথিবীতে খোদাই করা একটি সময়রেখা’।
আফগানিস্তানের কাবুল থেকে পাকিস্তান এবং আমাদের ভারত হয়ে পূর্বে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের টেকনাফ— প্রায় ৩,৬৫৫ কিলোমিটার লম্বা, এশিয়ার অন্যতম পুরনো ও দীর্ঘ মহাসড়কটির নাম গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড বা জিটি রোড। একসময় ইম্পিরিয়াল রোড নামেও যা পরিচিত ছিল। নোবেলজয়ী বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক জোসেফ রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের ভাষায়, ‘এটি জীবনের এমন এক নদী, যা বিশ্বের আর কোথাও নেই।’ সত্যিই অনেক আসা যাওয়া, ইতিহাসের অনেক উত্থান পতনের সাক্ষী জিটি রোড। মহাভারতের কালে নাকি এই রাস্তার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থেও। আসলে ভিন্ন ভিন্ন সময়কালে, ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল জিটি রোড। কিন্তু কবে তৈরি হয়েছিল এই রাস্তা? কে বা কারা তৈরি করেছিল? সুনির্দিষ্ট জবাব কারও জানা নেই।
কড়কড় করে কোথাও যেন বাজ পড়ল। আকাশ চিরে ঘনঘন বিদ্যুতের ঝিলিকে হঠাৎ যেন সার ফিরে পেলাম। মনে তখনও মাকড়সার জাল কাটছে ইতিহাসের পোকা। ভেবেই চলেছি, এই সেই রাস্তা... অন্তত ২,৫০০ বছর ধরে যা বেঁধে রেখেছে উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব অংশকে। আচমকা মনে পড়ল ডঃ নাসির রাজা খানের কথা। ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব অ্যাপ্লায়েড রিসার্চ’-এ তাঁর একটি গবেষণাপত্র পড়েছিলাম সেই কবে। জেনেছিলাম, জিটি রোডের অস্তিত্ব বহু প্রাচীন কাল থেকেই। আর সেব্যাপারে প্রথম প্রমাণ নাকি দিয়েছিলেন প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতিবিদ কৌটিল্য। মৌর্য্য যুগে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে দ্বিতীয় শতকে, আফগানিস্তানের বালখ থেকে অধুনা পশ্চিমবঙ্গের তাম্রলিপ্তিকা বা তমলুক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল একটি রাস্তা। নাম ‘উত্তরাপথ’। সেই সময় আরও একটি মহাসড়ক ছিল। দক্ষিণ ভারত ও পশ্চিম উপকূলের সঙ্গে সংযোগকারী সেই রাস্তার নাম ‘দক্ষিণাপথ’। সেই দুই মহাপথ এক জায়গায় মিলিত হয়েছিল সারনাথের কাছে। অধ্যাপক জেসন নেলিস তাঁর ‘আর্লি বুদ্ধিস্ট ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ট্রেড নেটওয়ার্কস’ বইয়ে লিখেছেন, ‘উত্তরাপথ কোনও একক রাস্তা নয়। বরং ক্রমাগত স্থানান্তরিত হতে থাকা অনেকগুলি শাখা পথের একটি নেটওয়ার্ক।’ যদিও এই মহাসড়কের সঙ্গে সমার্থক হয়ে উঠেছে এক জনের নাম। তিনি সুর সাম্রাজ্যের সুলতান শের শাহ সুরি। ১৫৪০ থেকে ১৯৫৬ সুর বংশের রাজত্বকাল। সেই সময়কালেই রাস্তাটি ‘সড়ক-ই-আজম’ বা ‘শাহ রাহ-ই-আজম’ নামে প্রসারিত হয় আফগানিস্তানের কাবুল থেকে অধুনা বাংলাদেশের সোনারগাঁ পর্যন্ত। ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতকে মুঘল আমলে তা পরিচিতি পায় বাদশাহী সড়ক হিসেবে। সবশেষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে, কাবুল থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বর্ধিত অংশটি ‘লং ওয়াক’ বা ‘গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।
কত কথাই যে মাথায় ভিড় করে আসছে...। রাস্তা, সে কি শুধুই যোগাযোগের মাধ্যম? মানুষের সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে তার যে ওতপ্রোত সখ্য। পুরাপ্রস্তর যুগে যে সব পথঘাট তৈরি হয়েছিল, সেগুলির অবশেষ চিহ্ন ধরেই পরবর্তীতে পুনর্গঠিত বিভিন্ন রাস্তা। তাদের নাম বদলে গিয়েছে। এমনকী, গুরুত্ব অনুযায়ী কিছু সংযোজন-বিয়োজনও হয়েছে রুটগুলিতে। জিটি রোডের ক্ষেত্রে তার অন্যথা হয়নি বলে অনুমান। ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীন, ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল সেন্টার ফর দ্য আর্টস যেমন জিটি রোডকে পুরনো সিল্ক রুটের অংশ বলে দাবি করে। কারণ, ইউনেস্কোর সূত্র অনুযায়ী বালখ, বামিয়ান, হেরাত, বাদাকশান ইত্যাদির সঙ্গে কাবুলও ছিল সেই রুটের একটি শহর। আবার, সিল্ক রুটের একটি শাখা তিব্বতের লাসা থেকে, চুম্বি উপত্যকা, নাথুলা গিরিপথ হয়ে তাম্রলিপ্ত (তমলুক) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আসলে, এই সিল্ক রুট বা সিল্ক রোডও কোনও একক পথ নয়। এটি ১,৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে অলঙ্কার, সুগন্ধি, সূক্ষ্ম বস্ত্র ও মশলা ব্যবসায়ীদের ব্যবহৃত রুটের একটি নেটওয়ার্ক। শুধু বাণিজ্য নয়, এই রুট ধরেই বেশ কিছু ধর্মীয় ঐতিহ্যের আগমন ভারতীয় উপমহাদেশে। আবার, মূলত এই পথ ধরেই ভারতের বৌদ্ধ ধৰ্ম ছড়িয়েছে দিকে দিকে। সেই যাত্রাপথের পাশে থাকা দিল্লি, কলকাতার মতো শহরগুলি আজও তাই বহুসংস্কৃতির কেন্দ্র।
এমনই সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে রাত আরও গভীর হচ্ছে। রাতের আঁধারে ছুটে চলেছি ভুলে যাওয়া ইতিহাসের এক পথ ধরে... উত্তরাপথ! শিবরঞ্জনীর বিরহী সুর বৃষ্টির রিনরিনে ফোঁটা হয়ে অনবরত ঝরে পড়ছে জানালার কাচে। আমার মনে পড়ছে প্রাচীন ভারতের বিশিষ্ট ব্যাকরণবিদ ও ভাষাতত্ত্ববিদ পাণিনির বিখ্যাত ‘অষ্টাধ্যায়ী’ গ্রন্থের কথা। সেখানেই ‘উত্তরাপথে’র সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। মৌর্য্য সাম্রাজ্যের অধিপতি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে সেই প্রাচীন রাস্তাটি ধরে এক রাজকীয় সড়ক তৈরি করেছিলেন। ‘উত্তরাপথ’ ছিল প্রাচীন ভারতের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য পথ। প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন ভারতের অর্থনীতির জীবনরেখাও। বস্তুত, এটি সড়ক ও নদীপথের সংমিশ্রণ। কারণ. কিছু অংশে এই পথের সঙ্গে নদী পারাপার যুক্ত ছিল। মনে করা হয়, প্রাচীন এই ‘উত্তরাপথে’র চিহ্ন ধরে নতুন সড়কটি তৈরির সময় পারস্যের (অধুনা ইরানের) প্রশস্ত, রাজকীয় রাস্তার কথা বিবেচনা করেছিলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত। আটটি পর্যায়ে রাস্তাটি নির্মিত হয়েছিল। তিনি শুধু রাস্তাটিকে নতুন রূপ দিয়েই ক্ষান্ত হননি, উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা একটি বাহিনীও গঠন করেন। সেসবের বিস্তারিত আখ্যান লিপিবদ্ধ তৎকালীন বিখ্যাত গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিসের বিবরণে। এরপর মৌর্য্য সম্রাট অশোক সেই রাস্তার দু’পাশে পর্যাপ্ত গাছ লাগান। পথচারীদের জন্য কূপ খনন ও বিশ্রাম গৃহ তৈরি করেন। এছাড়া মানুষ, এমনকী পশুদের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্রেরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যা সেই যুগে সত্যিই অভাবনীয়। এমনটাই কিন্তু জানা যাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব রিসার্চ অ্যান্ড রিভিউ সূত্রে। যাই হোক, পরবর্তীকালে কুষাণ সম্রাট কণিষ্কও রাজকীয় সড়কটিকে যথোচিত গুরুত্ব দিতেন। এবং প্রয়োজনীয় নানারকম সংস্কার করেছিলেন।
ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল গাড়িটা। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঝাঁকুনিতে চমকে উঠলাম। সামনের কাচের দিকে তাকাতে ইচ্ছা করছে না। আবার ডুব দিলাম সেই ষোড়শ শতাব্দীতে ফেলে আসা অতীতে। শের শাহের হাত ধরে ‘সড়ক-ই-আজম’-এর গরিমা যখন নতুন করে ফিরে আসছে। সোনারগাঁ ও রোহতাসে পুরনো রুটটি নতুন করে চালু হচ্ছে। সেই সময় প্রস্থেও বাড়ে জিটি রোডকে। পথচারীদের সুবিধার জন্য রোপণ করা হয়েছিল প্রচুর সংখ্যায় ছায়াপ্রদানকারী বৃক্ষ ও ফলের গাছ। ছিল কিছু সুদৃশ্য বাগান। বিভিন্ন ধর্মের উপাসনাস্থল নির্মাণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়। সাধারণভাবে, প্রতি দু’কোশ অন্তর একটি করে সরাইখানা বা বিশ্রাম গৃহ তৈরি করেন শের শাহ। সেইসময় এক কোশ পথ ছিল প্রায় সওয়া ২ মাইল বা ৩.৬২ কিলোমিটারের সমান। রাস্তায় নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর ১৫ থেকে ২০ ফুট উঁচু ‘কোশ মিনার’ বা রাস্তা বরাবর মধ্যযুগীয় মাইল ফলক এবং ‘বাওলি’ বা ধাপযুক্ত কুয়োর সংখ্যাও বাড়ানো হয়। রাস্তার পাশে প্রায় ১,৭০০টি এমন সরাই নির্মাণ করা হয়, যেখানে জাতি, ধৰ্ম, বর্ণ, অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে সর্বসাধারণের জন্য বিনামূল্যে থাকা ও খাওয়ার সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। এই সরাইগুলোই ডাক চলাচলের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। প্রতিটি ডাক চৌকিতে দু’জন করে অশ্বারোহী বার্তাবাহক থাকতেন, যারা নিকটতম চৌকিটি থেকে পাওয়া তথ্য পৌঁছে দিতেন রাজার কানে। শের শাহের মৃত্যুর পর তাঁর কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান ছেলে ইসলাম শাহ। বাংলার দিকের রাস্তায় প্রত্যেক দু’টি সরাইয়ের মধ্যবর্তী আরও একটি করে বিশ্রামাগার নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে সেই সংখ্যা আরও বাড়িয়েছিলেন মুঘল সম্রাটরা। সম্রাট জাহাঙ্গীর তো ফরমানই জারি করেন যে, এবার থেকে সমস্ত সরাই পোড়া ইট ও পাথর দিয়ে তৈরি করা হবে। লাহোর ও আগ্রার মধ্যবর্তী পথের দু’পাশে বড়ো বড়ো পাতার ছায়াপ্রদানকারী গাছ লাগানোরও উদ্যোগ নেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পথ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘কারো নই, তাই সকলেরই’। ঐতিহাসিক জিটি রোডের ক্ষেত্রেও এটা সর্বতোভাবে প্রযোজ্য। সত্যিই যুগে যুগে রাজা, প্রজা, ধনী, দরিদ্র, বণিক, ভিখারি, জাতি, ধৰ্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এই রাস্তাকে পেয়েছে নিজেদের মতো করে। জিটি রোড কখনও হয়েছে নিছক গন্তব্যে পৌঁছনোর পথ কখনও বা লক্ষ্যপূরণের... কখনও রক্ষার, কখনও আবার আক্রমণের... কখনও উন্নয়নের, কখনও বা ধ্বংসের। প্রত্যেকেই যে যার মতো করে গ্রহণ করেছে এ পথের পরিষেবা, অনুভব করেছে এ পথের গুরুত্ব। ব্রিটিশ আমলেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর তিনের দশকে বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক উদ্দেশ্যে পাকা রাস্তা তৈরির একটি কর্মসূচি গ্রহণ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই সময় কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে পেশোয়ার পর্যন্ত জিটি রোডের পুনর্নির্মাণ হয়। সেই আমলে প্রতি মাইলে খরচ হয়েছিল ১,০০০ পাউন্ড। এভাবেই প্রাচীন সেই উত্তরাপথ চন্দ্রগুপ্ত ও শের শাহের পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়ন, মুঘল আমলের সংস্কার ইত্যাদি পেরিয়ে, উনিশ শতকে লর্ড বেন্টিঙ্কের আমলে আজকের জিটি রোডের রূপ পায়। ধূলিধূসরিত অতি প্রাচীন এক পথ থেকে আজকের ঝাঁ চকচকে রাজমার্গে উত্তরণ, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করার সেই কাহিনি যেন রূপকথাকেও হার মানায়!
প্রস্থে ৪০ ফুট। কেন্দ্রীয় অংশটি ১৬ ফুট চওড়া। সেটি ৮ ইঞ্চি পুরু পাথর দিয়ে মজবুত ও পাকা করা। এছাড়া উঁচু রাস্তার ঢালে ৫০ থেকে ৬০ ফুট অন্তর বসানো হয়েছিল গুঁড়ি যুক্ত ভালো প্রজাতির গাছের চারা। ছিল উচ্চমানের বাঁধ ও উন্নত নিকাশি ব্যবস্থা। বিস্তীর্ণ এলাকায় বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছিল বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলার উপরেও, যাতে রাস্তাটি সবসময়ে জলসীমার উপরে থাকে। ছোট নদীগুলির উপর নানা সেতু। সব মিলিয়ে স্থানীয় পরিবেশকে মাথায় রেখে দুর্দান্ত পরিকল্পনা ও কারিগরি প্রকৌশলের প্রয়োগ-উৎকর্ষ যে জিটি রোডের নির্মাণকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। আর সে জন্য নির্মাণকারীদের কোনও প্রশংসাই বোধহয় যথেষ্ট নয়!
স্বপ্নের রাজপথ ধরে ইতিমধ্যেই অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি। রাস্তার দু’পাশে জমাট বাঁধা অন্ধকারের মাঝে হঠাৎ আলোর রোশনাই... পেরিয়ে যাচ্ছে কোনও ধাবা। ‘মেরে তেরে দিল কা, তয় থা একদিন মিলনা... জ্যায়সে বাহার আনে পর, তয় হ্যায় ফুল কা খিলনা’— অনেক দিন পর পুরনো দিনের মনকাড়া গান কানে আসায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। সত্যি, জিটি রোডের পক্ষেই সম্ভব এমনভাবে পুরনো কিছু ভালোলাগাকে আজও বাঁচিয়ে রাখা! ‘দ্য গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড: এ প্যাসেজ থ্রু ইন্ডিয়া’তে তাই হয়তো লেখা, ‘এখানে অতীত ও বর্তমান পাশাপাশি শ্বাস নেয়।’ বিভিন্ন সময়কালে এই পথ দিয়েই উপমহাদেশের মাটিতে আগমন ঘটেছিল মহান পারস্য সম্রাট দারিয়াস, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, চেঙ্গিজ খান, তৈমুর, এমনকী মৌর্য্য-কুষাণ ইত্যাদিরাও। স্বাভাবিকভাবেই তাই পথটির দু’পাশে স্মৃতিস্মারকগুলিতে মধ্য এশিয়ার উদ্ভাবন ও স্থাপত্যরীতির প্রভাব বেশ স্পষ্ট। সরাই, কোশ মিনার, বাওলি, সমাধিক্ষেত্র সর্বত্র।
মধ্য এশিয়ার সুফি ঐতিহ্য এবং দক্ষিণ ও মধ্য ভারতের ভক্তি মতাদর্শ এই পথ ধরে চলাচল করেছিল। ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষ একত্রবাস করে গড়ে তুলেছিল মিশ্র জনবসতি সমৃদ্ধ বড় বড় সব জনপদ। কার্যত যা উত্তর ভারতের তৎকালীন নগরায়ন প্রক্রিয়ায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তার প্রভাব পড়েছিল তৎকালীন শিল্প, সাহিত্য ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার নানা ক্ষেত্রে। বিশেষ করে কারুশিল্পে। অবশ্য শুধু কারুশিল্প নয়, মহান কবি, গায়ক, সুফি, সাধকদের স্মরণে যুগ যুগ ধরে নানা উৎসব, মেলা ও জনসমাবেশের মাধ্যমে নানা ঘরানার সংস্কৃতির প্রাণবন্ত চর্চা চলেছে এই অঞ্চলে। তার সঙ্গে সঙ্গে জিটি রোড বরাবর খাদ্য বৈচিত্র্যের বিস্ফোরণ আজও তাক লাগিয়ে দেয়। যেমন, আফগান ডেলিকেসি থেকে পাকিস্তানি, উত্তর ভারতীয়, মোগলাই এবং শেষে বাংলাদেশি রকমারি পদে। আমাদের রাজ্যে এই রাস্তায় রাজ করছে কলকাতার রসগোল্লা, চন্দননগরের জলভরা সন্দেশ, বর্ধমানের সীতাভোগ, মিহিদানা। খাবারে আঞ্চলিক ঘরানারও কত রকমের বিকাশ। ভারতের এক এক রাজ্যে টেক্কা দিয়েছে সর্ষের তেলে রাঁধা এক একটি পদ। বাংলার সীমান্ত পেরোতেই সর্ষে ইলিশকে পিছনে ফেলে বিহারে এগিয়েছে বেঙ্গন কা চোখা, উত্তরপ্রদেশে পুলাও, পাঞ্জাবের জনপ্রিয় আলু-গোবি। সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানেও জিটি রোড বরাবর একই ভাবে বদলাতে থাকে খাদ্যের ঘরানা। লাহোরে মশলাদার তরকারি ‘লাহোরি কড়াহি’, নিহারী, শিক কাবাব, ফালুদা। গুজরানওয়ালায় মাংসের নানা পদ, মিঠি লস্যি। রাওয়ালপিন্ডির পোলাও, মিয়াঁজিকি ডাল এবং দেশি ঘিয়ের পরোটা। এটকের কাছে নদীর নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে গরম গরম ফিশ ফ্রাই, নওশেরা ও পেশোয়ারে ধূমায়িত মাংসের সুঘ্রাণ। শেষে আফগান সীমান্ত পেরিয়ে পাহাড়ঘেরা কাবুলে ‘কাবুলি পালাও’। আজকের তুমুল জনপ্রিয় সামোসা (সিঙ্গাড়া), আলু-পুরি ও নান নাকি জিটি রোড ধরেই একসময় ভারতে এসেছিল!
একটা ঝাঁকুনিতে আবার ঘুমটা ভেঙে যেতেই দেখি, দাঁড়িয়ে আছি সিগন্যালে। সকাল হয়ে গিয়েছে। পিছু ছেড়েছে বৃষ্টি। দূরে হাওড়া ব্রিজ ছাড়িয়ে নীল আকাশের বুকে দুলছে সাদা মেঘের ভেলা। ধরে সফর প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিন্তু খুব জানতে ইচ্ছা করছে ,আদতে ঠিক কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে সেদিনের এই জিটি রোড? মনে পড়ে যাচ্ছে বিবিসির প্রখ্যাত সাংবাদিক ও ভ্রমণকাহিনি লেখক রাজা আলি আবিদির লেখা ‘জার্নাইলি সড়ক’ বইটির কথা। সেখানে পেশোয়ার থেকে কলকাতা, যাত্রাপথের এক বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন তিনি। পেশোয়ারে এক বয়স্ক মানুষ একটি মাইলস্টোন দেখিয়ে তাঁকে বলেছিলেন যে, ঠিক সেই জায়গাটা থেকেই নাকি এই মহাসড়কের শুরুয়াৎ। সেখান থেকে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে অবশেষে কলকাতার কাছাকাছি পৌঁছন লেখক। তারপর স্থানীয় মানুষদের কাছে জানতে চান, রাস্তাটির শেষ কোথায়? স্থানীয়রা তখন হাওড়া বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাছে একটি মাইলস্টোনের পাশে নিয়ে যায় তাঁকে। এবং স্বীকার করে যে, জিটি রোডের শেষ কোথায় সেটা তাদের জানা নেই। কিন্তু এই মাইলস্টোনটাই সেই জায়গা যেখান থেকে এই রাস্তা শুরু হয়েছে! সত্যি, বিস্ময় যেন বাঁধ মানে না। কানে বাজে ভারতের অন্তরাত্মার সেই প্রাণস্পন্দন, ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে...’।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : সত্যেন্দ্র পাত্র