বিনা উসকানিতে যুদ্ধ—কোনও উচ্চ লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য নয়, তা করার পিছনে বরং একটি দলীয় মতাদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য থাকে। বিজেপির মধ্যে অবশ্য বিনা উসকানিতেই যুদ্ধ নামার প্রবণতা বিদ্যমান। নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) এবং অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (ইউসিসি) এর উদাহরণ। কোনও অনুভূত প্রয়োজন মেটাবার উদ্দেশ্যে এগুলির পরিকল্পনা করা হয়নি। সঙ্ঘ (আরএসএস) এবং বিজেপির প্ররোচনায় হিন্দু ও অহিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই সিএএ ও ইউসিসি সামনে আনা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার এবার ভাষা নিয়ে আর একটি বিনা উসকানিতে রণভেরি বাজিয়ে দিয়েছে। তথাকথিত ‘ত্রিভাষা সূত্র’ বা টিএলএফ-এর প্রস্তাব প্রথম করেছিল রাধাকৃষ্ণন কমিটি। এটি কার্যকর হওয়ার আগেই প্রত্যাখ্যাত হয়ে গিয়েছিল। কোনও রাজ্য কখনও ‘ত্রিভাষা সূত্র’ বাস্তবায়িত করেনি।
ত্রিভাষা সূত্র অগ্রাধিকার নয়
ত্রিভাষা সূত্র অগ্রাধিকার না-পাওয়ার অনেক কারণ ছিল। স্বাভাবিক কারণেই প্রথম অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল স্কুল নির্মাণ এবং শিক্ষক নিয়োগের উপর। অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে দুই নম্বরে রাখা হয়েছিল সকলকে স্কুলে ভর্তি করানো এবং স্কুলের পরিসরে শিশুদের ধরে রাখা। তারপরের ধাপে ছিল শিক্ষার মান উন্নত করা। অর্থাৎ কেবল ভাষা শেখালে চলবে না, ওইসঙ্গে গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল এবং সমাজবিজ্ঞানের মতো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিও শিশুদের শেখানোর উপর জোর দিতে হবে।
স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরেও এই কাজগুলি অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে। ‘শিক্ষা’র কারণে নয়, বরং সংবিধানের ৩৪৩ অনুচ্ছেদের সৌজন্যে ভাষা একটি বিস্ফোরক বিষয় হয়ে ওঠে। এতে হিন্দিকে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ‘অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ’ বা ‘সরকারি দপ্তরগুলিতে কাজের ভাষা’ হিসেবে গণ্য করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। ওইসঙ্গে এও বলা হয়েছে যে, কিন্তু ১৫ বছর ধরে সেখানে ইংরেজি ভাষার ব্যবহারও অব্যাহত থাকবে। ওই নির্দিষ্ট ১৫ বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে ১৯৬৫ সালে।
একটি উদ্ভট সরকার ঘোষণা করে দিয়েছিল যে, ১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে হিন্দিই হবে একমাত্র ‘অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ’। এর তাৎক্ষণিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়াই মিলেছিল। বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিস্ফোরণ ঘটেছিল তামিলনাড়ুতে এবং ওই রাজ্যে ক্ষমতায় চলে এসেছিল একটি দ্রাবিড় পার্টি। জওহরলাল নেহরুর প্রতিশ্রুতি ছিল যে অহিন্দিভাষী মানুষজন যতক্ষণ পর্যন্ত চাইবেন ততক্ষণ পর্যন্ত ইংরেজি ‘অ্যাসোসিয়েট অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ’ বা সহযোগী সরকারি ভাষা হিসেবে থাকবে।
১৯৬৫ সাল ভাষা সঙ্কট যখন তুঙ্গে তখন উগ্রপন্থীদের মোকাবিলাসহ প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি করার সাহস ও প্রজ্ঞার পরিচয় একমাত্র দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। প্রশাসনিক কাজকর্মের প্রয়োজনে, প্রতিশ্রুতি ছাপিয়ে, কেন্দ্রীয় সরকারকে দুটি ভাষার ব্যবহার মেনে নিতে বাধ্য করেছিল। অন্যান্য ভারতীয় ভাষার মতো হিন্দিও বিজ্ঞান, আইন, অর্থনীতি, ইঞ্জিনিয়ারিং, বৈদেশিক বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রভৃতির চাহিদা পূরণের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না।
রাজ্য সরকারগুলিও দুটি করে ভাষার উপর নির্ভরশীল। আইন আইন প্রণয়নে এবং প্রশাসনের নানাবিধ কাজকর্মে তারা ইংরেজিই ব্যবহার করে থাকে। এরই মধ্যে, সুদূরপ্রসারী পরিণতিসহ তিনটি ঘটনাও ঘটে গিয়েছে। প্রথমত, ১৯৭৫ সালে ‘শিক্ষা’ নামক বিষয়টিকে ‘রাজ্য তালিকা’ থেকে সরিয়ে ‘যৌথ তালিকা’ ভুক্ত করা হয়, তার ফলে স্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রে ক্ষুণ্ণ হয় রাজ্যগুলির স্বশাসন। দ্বিতীয়ত, ১৯৯১ সালে উদারীকরণ ও বিশ্বায়নের সঙ্গে ভারত অনিবার্যভাবে আর যেটি সাদরে রবণ করেছিল তার নাম ‘ইংরেজি’। তৃতীয়ত, অভিভাবকদের তরফে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দাবি ছিল, আর দাবিটি তো এখন ক্রমবর্ধমান।
তৃতীয় ভাষা কোনটি?
হালফিল দ্বন্দ্ব নতুন শিক্ষানীতি (২০২০) ঘিরে, বিশেষ করে তার ‘ত্রিভাষা সূত্র’ সংক্রান্ত দিকগুলি নিয়ে। স্কুলগুলিতে আঞ্চলিক বা রাজ্য ভাষা হল সেখানকার ‘প্রথম’ ভাষা। ‘দ্বিতীয়’ ভাষা হল ইংরেজি। তাহলে ‘তৃতীয়’ ভাষা কোনটি? কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী একটি অদ্ভুত যুক্তি দেন যে, জাতীয় শিক্ষা নীতি বা এনইপি যেহেতু একটি জাতীয় নীতি, অতএব প্রতিটি রাজ্য সাংবিধানিকভাবে এই নীতি মানতে বাধ্য। তদুপরি, এনইপি তৃতীয় ভাষা শিক্ষার নিদান দিলেও সেখানে এই শর্ত দেওয়া হয়নি যে তৃতীয় ভাষা হিন্দিই হতে হবে। ধর্মেন্দ্র প্রধান যখন জিজ্ঞাসা করেন, তামিলনাড়ু রাজ্য সরকার এনইপি এবং তৃতীয় ভাষা শিক্ষার বিরোধিতা করছে কেন? তখন মনে হয় যে তিনি সরলতার ভান করছেন।
উত্তরগুলি সহজ: (১) এনইপি হল বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি নীতি। সংবিধান এসব ‘বাধ্যতামূলক’ বলেনি। (২) তামিলনাড়ুতে একের পর এক রাজ্য সরকারের নীতি অনুসারে, সরকারি স্কুলে কেবল দুটি ভাষাই পড়ানো হবে, তিনটি নয়। বেসরকারি স্কুলগুলিতে বিষয় হিসেবে হিন্দি পড়ানোর ক্ষেত্রে তামিলনাড়ু সরকার কিন্তু কোনও বাধা দেয়নি। তামিলনাড়ুতে যেসব কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় এবং সিবিএসই (৬৪২), আইসিএসই (৭৭) ও আইবি (৮) বোর্ড অনুমোদিত স্কুল চলছে, সেগুলিতে হিন্দি ‘অফার’ করা হয়। ওইসব স্কুলে হাজার হাজার শিশু যথারীতি হিন্দি শেখে। দক্ষিণ ভারত হিন্দি প্রচার সভা বা অনুরূপ সংস্থাগুলির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ শিশুর হিন্দি শেখার পথেও সরকার বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
অনেক রাজ্যে একটিই ভাষা
নতুন শিক্ষানীতির ব্যাপারে বলতে হয় যে, এনইপির ভালো বৈশিষ্ট্য যেমন আছে, তেমনি এমন কিছু বৈশিষ্ট্যও আছে যেগুলি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিতর্কিত বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি হল ‘ত্রিভাষা সূত্র (টিএলএফ)’। হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে টিএলএফ প্রয়োগ করা হয় না, তবে তা অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতেই প্রয়োগ করার চেষ্টা চলে। লক্ষ করার মতো বিষয় হল—হিন্দিভাষী উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, বিহার, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং হরিয়ানার সরকারি স্কুলগুলিতে কার্যকরভাবে শুধুমাত্র এক ভাষা নীতি অনুসরণ করা হয় এবং সেই ভাষাটি হল ‘হিন্দি’। এই রাজ্যগুলির সরকারি স্কুলগুলিতে ভর্তি হওয়া বেশিরভাগ শিশু অন্যকোনও ভাষা শেখে না, কারণ সেখানে ইংরেজি শিক্ষকের সংখ্যা কম এবং অন্যকোনও ভাষার শিক্ষকও প্রায় নেই। সরকারি স্কুলগুলির অনুসরণে, বেসরকারি স্কুলগুলি শুধু হিন্দি পড়িয়েই খুশি। কিছু শিশু ইংরেজিও শেখে তবে তা ‘তৃতীয় ভাষা’ হিসেবে নয়। যেসব স্কুলে তৃতীয় ভাষা পড়ানো হয়, সেখানে তা অবশ্যই হয় সংস্কৃত। পাঞ্জাব, গুজরাত এবং মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যগুলির স্কুলে হিন্দি হল তৃতীয় ভাষা। পাঞ্জাবি, গুজরাতি এবং মারাঠির সঙ্গে হিন্দি ভাষার নৈকট্য সুবিদিত। এটি তাদের পক্ষে বাড়তি সুবিধার বিষয়ও বটে।
এছাড়া যে মানের ইংরেজি শেখানো হয় তা অত্যন্ত নিম্ন। যেসব সরকারি স্কুলে ইংরেজি শেখানো হয়, সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা ইংরেজি ক্লাসরুমের বাইরে ইংরেজি প্রায় বলতেই পারে না। এটি তামিলনাড়ুসহ সকল রাজ্যের ক্ষেত্রেই সত্য।
ত্রিভাষা সূত্র অনুযায়ী তামিলনাড়ুকে তৃতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি গ্রহণে বাধ্য করার আগে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর উচিত, সারা ভারতে দুটি ভাষা (আঞ্চলিক ভাষা এবং ইংরেজি) শেখানোর ক্ষেত্রে সফল হওয়া। ‘স্পোকেন ইংলিশ’-এর অভাব রয়েছে আর ‘গুড স্পোকেন ইংলিশ’ বিরল।
দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে যে ইংরেজি, সেটি শেখাতেও সরকার ব্যর্থ। এটাই যখন বাস্তব অবস্থা, তখন সরকার কেন একটি তৃতীয় ভাষার শিক্ষাদানে সফল হতে মরিয়া?
• লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত