শেষ পর্যন্ত কি ঝুলি থেকে বেড়ালটা বেরিয়েই পড়ল? বিজেপি সম্পর্কে দেশের বৃহত্তম বামপন্থী দলটির সর্বশেষ মূল্যায়ন সামনে এসেছে। তাতে সিপিএম এখন আর বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির সরকারকে ‘ফ্যাসিবাদী শক্তি’ মনে করে না। এমনকী, নব্য ফ্যাসিবাদী বলতেও ঘোর আপত্তি। সিপিএমের ২৪তম পার্টি কংগ্রেসের আগে তাদের এই মনোভাব প্রকাশ্যে আসতেই ক্ষোভ উগরে দিয়েছে কেরলের কংগ্রেস নেতৃত্ব, এমনকী বাম শরিক সিপিআইও। কংগ্রেসের সরাসরি অভিযোগ, ‘সিপিএমের একটা অংশ সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপির অধীনে কাজ করতে চাইছে।’ তাই প্রশ্ন উঠছে, ভবিষ্যতে সমঝোতার রাস্তা তৈরি করতেই কি বিজেপির প্রতি সুর নরম করছে সিপিএম?
জ্যোতি বসুর ভাষায় বিজেপি ‘বর্বরের দল’। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য উঠতে বসতে মহাত্মা গান্ধীর রক্ত লেগে থাকা দলের মাথা গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিতেন। তাই ২০২২ সালেও সিপিএমের চোখে বিজেপি ছিল ‘ফ্যাসিবাদী শক্তি’। কিন্তু এখন? সিপিএম মনে করছে, ‘মোদি সরকারের কাজকর্মের মধ্যে নব্য ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্যের কিছু কিছু প্রকাশ ঘটেছে। তবে, সামগ্রিকভাবে সরকারকে ফ্যাসিস্ট বলা যায় না।’ এটা কোনও সিপিএম নেতার ভাষণের অংশ হলে ‘ব্যক্তিগত অভিমত’ বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। এক্ষেত্রে সেটা বলা যাবে না। কারণ এটা লিখিত নোট, তা অনেক ভেবেচিন্তেই সিপিএম তৈরি করেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সিপিএম হঠাৎ কেন ভোলবদল করতে চাইছে? অনেকে বলছেন, রাজনীতি হল সম্ভাবনার শিল্প। এখানে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। বরং আজ যা অসম্ভব, অবাস্তব আগামীতে সেটাই কঠিন বাস্তব রূপে প্রতিভাত হয়। এই মুহূর্তে কেরল ছাড়া কোনও রাজ্যে সিপিএম ক্ষমতায় নেই। একদা যে বাংলাকে দেখিয়ে ভারতবর্ষে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাত, সেখানেই তারা শূন্য। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা কম হয়নি। কিন্তু পারেনি। উল্টে দিন দিন তলিয়ে যাচ্ছে। দেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পেতে শরিক বদলাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে কৌশলও। রাজ্যভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন পলিসি। তাতে নীতির কোনও বালাই নেই। তবুও হাল ফিরছে না ‘লাল’-এর।
সিপিএমের চোখে তৃণমূল কংগ্রেস খারাপ। কারণ তৃণমূলের একাধিক নেতা জেল খেটেছেন এবং খাটছেন। তাই ‘দুনীর্তিগ্রস্ত দলে’র সঙ্গে চলার কোনও অর্থই সিপিএম খুঁজে পায় না। কিন্তু লালুপ্রসাদ যাদব পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে সাজা পেলেও তাঁর দলের সঙ্গে হাত মেলাতে আপত্তি নেই। কারণ তিনি তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সিপিএমের পাকা ধানে মই দেননি।
আবার দেখুন, অটলবিহারী বাজপেয়ির সরকারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্ত্রী থাকায় তিনি বিজেপি ঘনিষ্ঠ। খুব ভালো কথা। কিন্তু ‘পাল্টুরাম’ নীতীশকুমার বিজেপি সরকারের ‘প্রাণভোমরা’ হলেও এনডিএ ছাড়লেই সেলিম সাহেবরা জাপটে ধরছেন। এমনকী, তাঁকে ইন্ডিয়া জোটের মাথা ভাবতেও আপত্তি থাকে না। তামিলনাড়ুতে একদা বিজেপির জোটসঙ্গী ডিএমকের হাত ধরতেও সঙ্কোচ নেই। কারণ তাঁরা তো কেউই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সিপিএমের রাজ্যপাট শিকেয় তুলে দেননি।
দিল্লিতে বিজেপি বিরোধী জোটে সিপিএম আছে। কিন্তু ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অন্যতম প্রধান শক্তি কংগ্রেসই কেরলে তাদের এক নম্বর প্রতিপক্ষ। একইভাবে বাংলাতেও ‘ইন্ডিয়া’র আর এক শরিক তৃণমূলকেই তারা প্রধান রাজনৈতিক ‘শত্রু’ মনে করে। বাংলায় বিজেপির উত্থানের জন্য মমতাকেই দায়ী করে। কিন্তু, ত্রিপুরায় হারল কেন? সেখানে তো মমতা ছিলেন না। তাহলে সিপিএম ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। আসলে বিজেপির চোখে চোখ রেখে লড়াইয়ের সুযোগটা সিপিএম কোথাও কাজে লাগাতে পারেনি। তাই ত্রিপুরা হাতছাড়া হয়েছে, আর বাংলায় তারা শূন্য। তারপরেও সিপিএম নিজেদের সাচ্চা বিজেপি বিরোধী বলে দাবি করে। তারজন্য কেরলে কংগ্রেসকে এবং বাংলায় তৃণমূলকে ‘বিজেপির বন্ধু’ সাজায়। জন্ম দেয় ‘বিজেমূল থিওরি’র।
কোথাও একটু মাটি পাওয়ার লোভে, কোথাও ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় সিপিএম গোটা দেশের প্রায় সব দলের সঙ্গেই সমঝোতা করে ফেলেছে। বাকি আছে কেবল বিজেপি। সেটাও যে হবে না, তা হলফ করে বলা কঠিন। কারণ সিপিএম এমন সময় বিজেপির গা থেকে ‘ফ্যাসিবাদী’ তকমা খুলতে চাইছে যখন গেরুয়া শিবির উগ্র হিন্দুত্বের লাইনকে মজবুত করতে মরিয়া। তাতে সংখ্যালঘুরা বিপন্ন বোধ করছেন। বিজেপির বিরুদ্ধে আক্রমণ তীব্রতর করার এটাই সেরা সময়। সেটা না করে তারা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাচ্ছে।
কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের নির্বাচনী সমঝোতার কথা তিন দশক আগে কেউ কল্পনাও করতে পারত না। তখন কেউ সমঝোতার কথা বললে ‘পাগল’ বলে দাগিয়ে দিত। কিন্তু বাংলায় একের পর এক নির্বাচনে উভয়দলের আসন বোঝাপড়া হয়েছে। উদ্দেশ্য? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতাচ্যুত করা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিএমের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। তাঁর জন্যই বামেরা এ রাজ্যে ক্ষমতার মধুভাণ্ড থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তবে সিপিএম বুঝে গিয়েছে, কংগ্রেসকে নিয়ে মমতাকে হটানো যাবে না। আইএসএফ, সিপিআই(এমএল) এর সম্মিলিত জোটও আঁচড় কাটতে পারেনি। তাই কি নতুন কোনও ‘বন্ধু’র সন্ধান? তারজন্যই কি বিজেপিকে ‘ফ্যাসিবাদী’ নয় বলতে চাইছে সিপিএম?
বিজেপি-সিপিএম সমঝোতা কি সম্ভব? এই প্রশ্নটা শুনলে অনেকে হয়তো ‘পাগলের প্রলাপ’ বলে উপহাস করবেন। কিন্তু পাল্টা জানতে ইচ্ছা করে, যেদিন বর্ধমানের মঙ্গলকোটে সিপিএমের তাড়া খেয়ে তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া ধুতি তুলে দৌড়েছিলেন, সেদিন কি কেউ দুই দলের সমঝোতার কথা কল্পনা করতে পেরেছিলেন? পারেননি। পারার কথাও নয়। কারণ বামেদের উত্থান কংগ্রেসের বিরোধিতা করেই। তাই কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের নির্বাচনী সমঝোতা ছিল কল্পনার অতীত। তবুও সেটাই হয়েছে। সেই তুলনায় বিজেপির সঙ্গে বামেদের সম্পর্ক কোনও দিনই অতটা খারাপ ছিল না। বরং বহু আগেই বিজেপি ও সিপিএমের দুই প্রবাদপ্রতিম নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ি ও জ্যোতি বসুর বোঝাপড়া প্রকাশ্যে এসেছে। একই মঞ্চে উভয় নেতা ভাষণ দিয়েছেন। তাঁদের সেই হাসিমুখের ছবি অ্যালবামের পাতায় আজও জ্বলজ্বল করে। আর এ রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বামেরাই বিজেপির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছে। ভোটের ফলই তার প্রমাণ। যদিও সিপিএমের বুদ্ধিজীবীরা তাকে ‘বাইনারি’ থিওরি দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
উনিশের লোকসভা নির্বাচন থেকেই বাম ভোট বিজেপিতে যাচ্ছে। তারপর থেকে প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনে একই ঘটনা ঘটছে। মাঝে দু’-একটি উপ নির্বাচনে এবং পুরসভায় বামেরা বিজেপির থেকে কিছু বেশি ভোট পেয়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে রামে যাওয়া ভোট বামে ফেরেনি। একদিকে, সিপিএমের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হটানোর একের পর এক চেষ্টা বানচাল হয়েছে। অন্যদিকে, বিজেপির প্রতি বাংলার ক্রেজ ও ভোট, দু’-ই কমছে। ফলে ক্ষমতা দখল দূরের কথা, লড়াইয়ের জায়গাতেই বিরোধীরা নেই। এই পরিস্থিতিতে বিজেপিকে ‘ফ্যাসিবাদী’ শক্তি না বলাটা বাংলায় মমতা বিরোধী ভোট এককাট্টা করার একটা কৌশল।
একথা ঠিক, এই মুহূর্তে বিজেপির সঙ্গে বামেদের সমঝোতার কোনও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু বাংলায় শাসক বিরোধী ভোট ভাগাভাগি ঠেকাতে সিপিএমের এই কৌশল কাজে লাগতে পারে। এর আগে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব এবং অমিত শাহ একাধিকবার ‘তৃণমূলের চেয়ে বামেরা ভালো ছিল’ বলে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছেন। তৃণমূলকে হারাতে বিজেপিকে ভোট দেওয়ার জন্য বামেদের কাছে আবেদনও করেছেন। কারণ তাঁরা জানেন, বামেদের ভোট শিফ্টিংয়ের জোরেই বিজেপি বাংলায় প্রধান বিরোধী দল। বামেরা নিঃস্ব হলেই পূর্ণ হবে রামের ঘর।
রাজনৈতিক মহল মনে করছে, সিপিএম লোকসভা ভোটে পূর্ব মেদিনীপুরে তারই একপ্রস্ত মহড়া সেরে ফেলেছে। জেলার দু’টি আসনেই জিতেছে বিজেপি। সিপিএম গোহারা হেরেছে। তাও নেতৃত্বের বদল হয়নি। উল্টে অসুস্থ নিরঞ্জন সিহিকেই জেলা সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছে। চতুর্থবারের জন্য। একেবারে নজিরবিহীন। কেউ কেউ বলছেন, এটা গোপন গেমপ্ল্যান বাস্তবায়নের ‘পুরস্কার’।
সিপিএম নেতৃত্ব হয়তো মনে করছে, ছাব্বিশে তৃণমূলকে ধাক্কা দিতে গেলে রাজ্যজুড়ে কার্যকর করতে হবে ‘পূর্ব মেদিনীপুর মডেল’। তারজন্য করা যাবে না বিজেপিকে আক্রমণ, দেখাতে হবে আরও নরম মনোভাব। তাতেই শক্তি বাড়বে বিজেপির। আর বিজেপির শক্তি বৃদ্ধি মানেই মমতার বিপদ! তবে তারজন্য হয়তো সিপিএমের ‘মহাশূন্যে’ পাড়ির পথ প্রশস্ত হবে। কিন্তু মিটবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পরাজয়ের জ্বালা। অনেকে মনে করছেন, বিজেপিকে ‘ফ্যাসিবাদী শক্তি’র তকমা থেকে মুক্ত করার চেষ্টার এটাই আসল কারণ।