অখণ্ডানন্দজী বলেন, “একদিন বড় দুঃখ হলো। লোকে নিজের পেটের ছেলেকে যা যত্ন করে তার চেয়ে বেশি যত্ন-আদর আশ্রমের ছেলেদের করি। তবুও ছেলেরা কেন পালায়?” শ্রীশ্রীঠাকুর দেখিয়ে দিলেন, তোরা আমার ভালোবাসা পেয়েছিস। তোরাই সকলকে ভালোবেসে যাবি—অন্যের ভালোবাসা পাবি কী করে? তোদের ভালোবাসার return তোরা যদি পেয়েই গেলি, তাহলে তো সাধারণ লোকের মতো হয়ে গেল।” তিনি আরও বলেন, “দেখ, সংসারী লোকের ভালোবাসায় ‘তুমি আমার, আমি তোমার’—এই একটা element আছেই আছে।” মহারাজ ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের কথা বললেন। সেসময় রিলিফ চলছে মহুলা গ্রামে—এর-তার বাড়িতে খেয়েই তাঁরা কাটিয়ে দিচ্ছেন। গৃহস্থ এক বৃদ্ধা ব্রাহ্মণী প্রায়ই এঁদের খাওয়াতেন—প্রাণের সঙ্গে যত্ন করতেন, সবই যথার্থ। পরে খবর পাওয়া গিয়েছিল, মুদির দোকানে দেনা করেও তিনি সাধুদের খাইয়েছেন। দুর্ভিক্ষ-ত্রাণকার্যে বিলির জন্য যে চাল এসেছিল তা বার্মা রাইস, আলোচাল। শুধু আলোচাল রিলিফের কাজ চলে না। রুগি এবং অসুস্থ লোকেদের জন্য সিদ্ধ চালের দরকার। আর পাড়াগাঁইয়ে আলোচালও কম পাওয়া যায়। কাজেই গাঁইয়ের অনেকে অখণ্ডানন্দজীকে সিদ্ধ চাল দিয়ে আলোচাল বদল করে নিত। একদিন একজন গ্রামবাসী অখণ্ডানন্দজীকে বলল, “মহারাজ, ওরকম বদল করবেন না, এতে কথা উঠতে পারে। সিদ্ধ চালের যা দরকার আমি দেব।” মহারাজ দেখলেন, ঠিকই কথা—এমনিতেই তিনি বলেছিলেন আর চাল বদল হবে না। এই কথাবার্তার মিনিট পনেরোর মধ্যেই ওই বৃদ্ধা ব্রাহ্মণী তাঁর আড়াই সের সিদ্ধ চাল পাঠিয়ে দিয়েছেন, বদলের জন্য। মহারাজ ভাবলেন, “এই নিয়ম করলুম বদল হবে না। আর ইনি আমাদের যত্ন করে খাওয়ান বলে এঁকে যদি বদলে দিই, তবে তো পক্ষপাতিত্ব হবে।” তিনি চাল বদলে দিলেন না। অখণ্ডানন্দজী বলেন, সেই দিনই ওই বৃদ্ধা বলেছিলেন, আমি সাধুদের জন্য এত করি আর তিনি এটা করলেন না? ঠিক ঠিক সন্ন্যাসীর ভালোবাসা এক—কোনো তফাত নেই, খোঁচ নেই।
আশ্রমের ছেলেদের প্রতি অখণ্ডানন্দজীর ভালোবাসার গভীরতা তাঁর কথাতেই প্রকাশ হয়ে পড়ে। তিনি একবার আশ্রমের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অন্য জায়গায় গিয়েছেন, কয়েক দিন আশ্রম ছেড়েই রয়েছেন। হঠাৎ একদিন সকাল থেকে তাঁর মন আর সেখানে বসছে না, আশ্রমে ফিরে আসবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। শুনলেন, ঐ দিন সব টাকা পাওয়া যাবে না—আরও এক দিন অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বললেন, “টাকা আজ যা পাওয়া যায়, তা-ই নিয়েই আশ্রমে যাব। টাকার জন্য আর আমি কিছুতেই অপেক্ষা করব না।” যা টাকা সংগ্রহ হয়েছিল তা নিয়ে এবং জনৈক ভক্তের দেওয়া তিন ঝুড়ি আম নিয়ে অখণ্ডানন্দজী বিকালে আশ্রমে পৌঁছালেন। এসেই শুনলেন, তার পরদিন ষষ্ঠী। পরদিন যে ষষ্ঠী, একথা তাঁর খেয়ালই ছিল না। তিনি বললেন, “আমি যদি ঐ দিন এসে না পড়তুম তাহলে ছেলেরা ষষ্ঠীর দিন আঁবটা (আমটা) খেতে পেত না।”
সরসীলাল সরকারের ‘অখণ্ডানন্দজীর স্মৃতি’ থেকে