চিত্তের ভূমি: ব্যাসভাষ্য মতে, সমাধি হল চিত্তের সার্বভৌম ধর্ম। সমাধি শব্দ লক্ষ্য আর সাধন দুই অর্থেই ব্যবহার করা হয়। অষ্টাঙ্গিক মার্গের অষ্টম অঙ্গরূপে যে সমাধির উল্লেখ করা হয়েছে, তা হল সাধনরূপ। কিন্তু যখন বলা হয় যে চিত্তবৃত্তির নিরোধই যোগ, তখন সমাধি লক্ষ্য হয়ে ওঠে। সমাধি চিত্তের সার্বভৌম ধর্ম বলার অর্থ হল এই যে সমাধি চিত্তের সর্বভূমিতে সম্ভব। চিত্তের পাঁচটি ভূমি আছে—মূঢ়, ক্ষিপ্ত, বিক্ষিপ্ত, একাগ্র, নিরুদ্ধ। এই নিরুদ্ধভূমিতে পৌঁছনই হল যোগের লক্ষ্য। সমাধি এই পাঁচটি ভূমিতেই সম্ভব। সব সমাধিকে যোগ বলা যেতে পারে না। এইজন্য সাংখ্য বিচার ও বিবেকের উপর জোর দেয়। বিচার-বিবেক সতত না হলে যোগ সম্ভব নয়। মূঢ়ভূমিতে সমাধির উদাহরণ: গভীর নিদ্রা-এতে আরামের প্রাপ্তি হয়, কিন্তু প্রজ্ঞানের প্রাপ্তি হয় না।
বিক্ষিপ্তভূমির সমাধি—এই ভূমির সমাধি হতে যোগের সমাধির সম্ভাবনা শুরু হয়, কিন্তু চিত্তের সংস্কার নষ্ট না হবার কারণ প্রজ্ঞান সম্ভব হয় না। কোনো বিশেষ কার্য্য বা বিচারে যখন জগৎ বা জাতির বিস্মৃতি হয়ে যায়, তখন তাকে বিক্ষিপ্ত সমাধি বলা হয়—যেমন, বৈজ্ঞানিক বা শিল্পীদের সমাধি, কিন্তু এটিও যোগের সমাধি নয়। মূঢ়ভূমি হল তমোগুণপ্রধান, ক্ষিপ্তভূমি রজোগুণপ্রধান, আর বিক্ষিপ্তভূমি সত্ত্বগুণপ্রধান, কিন্তু শুদ্ধসত্ত্ব নয়। Clarity of consciousness পাওয়া যায় না, কিন্তু সমাধি হয়ে যায়, বস্তু বা ভাবে মন তল্লীন হয়ে যায়। বিচারক, বিজ্ঞানী, কবি সব এই স্তরে আসেন। কিন্তু একে যোগ বলা যায় না। সত্ত্বগুণের ধর্ম হল প্রকাশ। কিন্তু বিক্ষিপ্তভূমি পর্য্যন্ত confusion থাকে। ধার্মিক ব্যক্তিতেও যতক্ষণ পর্য্যন্ত বিরোধী ভাবনা থাকে, ততক্ষণ পর্য্যন্ত তাঁদের সমাধিকেও যোগের সমাধি বলা যেতে পারে না। যতক্ষণ পর্য্যন্ত সংস্কার ক্ষীণ না হয়, ততক্ষণ পর্য্যন্ত সমাধি পরিপাক হতে পারে না। একাগ্রভূমি হল শুদ্ধসত্ত্বভূমিঃ তম রজ লেশতম আর রজের সেখানে রূপান্তর হয়ে যায়। তমের রূপান্তর স্থিতিতে হয়, রজের শুদ্ধ প্রবৃত্তি বা বীর্য্য, সত্ত্বের রূপান্তর হয় প্রকাশে; তমের শ্রদ্ধায়, রজের বীর্য্যে আর সত্ত্বের প্রজ্ঞায় রূপান্তর হয়। একাগ্রভূমি হতেই সত্যকার যোগের আরম্ভ হয়—এই ভূমির যোগ হল সম্প্রজ্ঞাত যোগ। এই ভূমিতে ভূমার আবেশের ভাব, আর একাগ্র যোগের সাধনা যদি একসাথে হতে পারে, তবে সেটা অধিকতর কাম্য হয়। অন্তিম ভূমি হল নিরুদ্ধভূমি—এখানকার যোগ হল অসম্প্রজ্ঞাত যোগ। প্রথম লক্ষ্য—সম্প্রজ্ঞাত যোগ-যেমন, আত্মার অনুধ্যান। শুরুতে যে সমাধি সিদ্ধ হয়, তখন সমস্ত ব্যক্তিত্ব উজ্জ্বল, প্রকাশিত হয়ে যায়—এটি হল বৌদ্ধদের রূপাবচর ভূমির অন্তিম অবস্থা, আভাস্বর লোকের প্রাপ্তি; কিন্তু এই ভাস্বরতা অস্থায়ী—এই অস্থায়িত্ব প্রজ্ঞানের অভাব হতে হয় না, প্রকৃতির অন্তরে আরেক ক্রিয়া শুরু হয়ে যায়, যাকে বিরামপ্রত্যয় বলে, গীতায় যাকে ‘উপরাম’ ও উপনিষদে ‘প্রপঞ্চোপশম’ বলা হয়েছে। ধীরে ধীরে শান্ত আত্মার ভাব জাগ্রত হয়—তখন কোনও সংস্কার অবশিষ্ট থাকে না। অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি হল শান্ত আত্মার অবস্থা।
শ্রীমৎ অনির্বাণ রচিত ‘অনির্বাণ আলোয় পাতঞ্জল যোগ-প্রসঙ্গ’ থেকে