‘রোগে প্রেম ঝরে’—এই বোধ হয় তাঁর ভালবাসার শেষ পরিচয়। প্রথম শান্ত দৃষ্টিতে দেখা। ক্রমে তা-ই পরিণত হয় রসদৃষ্টিতে। তখন খেল্ছিও আবার খেলাও দেখ্ছিও। একেবারে ডবল মজা। মুশকিল হয়, খেলাটাকে যদি কাজ বলে ভুল করি। কর্তা আমি নয়, কে কর্তা তা জানিও না। তাঁকে কর্তা বলে ভাবতে পারি না, মনে হয় তিনি করেন না কিছু, খেলেন। Seriously খেলেন নিশ্চয়। কিন্তু ওই Seriousnessটা একটা pose মাত্র। ‘হেসে দাও মা হাত-চাপড়ি’—এই হল শেষ কথা। ঠাকুর বলতেন, ‘আমি তিনটি হতে নারাজ—গুরু, কর্তা আর বাবা’।
বাউলের এই ‘পরমা প্রকৃতি’ হলেন রাধা। গীতায় দুটি প্রকৃতির কথা এক জায়গায় আছে—অপরা অর পরা। অন্যত্র আছে স্বীয়া প্রকৃতির কথা। তিনিই পরমা প্রকৃতি। প্রেমের চরম অবস্থায় শূন্যতা—তখন হয় ‘মূর্ছা’, নয় তো ‘মৃতি’। বৈষ্ণবেরা যথাক্রমে বলেন নবমী এবং দশমী দশা। তবে ‘উদাস’ কথাটি আরও ভাল লাগে—আপনি মীরার যে-বচনটি তুলে দিয়েছেন ঠিক তা-ই। এর আরেক নাম ‘প্রেমবৈচিত্ত্য’। ‘লাখ লাখ যুগ হিয়া হিয়ে রাখলুঁ তবু হিয়া জুড়ন না গেল’। তখনই প্রাণ উদাস হয়ে যায়। কিন্তু সে-মাধুরীর আর তুলনা নাই। তিনি যে অফুরান। তাই অতৃপ্তিতেই চরম তর্পণ।
আপনি যে-ধ্যানের কথা বলেছেন, তা একান্ত নির্দোষ। উপনিষদে এই ধ্যানের ইঙ্গিত একাধিক জায়গায় আছে। তৈত্তিরীয়ের উক্তি স্মরণীয়: ‘আকাশ-শরীরং ব্রহ্ম, সত্যাত্ম প্রাণারামং মন-আনন্দং শান্তিসমৃদ্ধম্ অমৃতম্’। এটি ওই ধ্যানের বিবৃতি। পতঞ্জলি একে বলেছেন ‘মহাবিদেহধারণা’। প্রযত্নশৈথিল্য (relaxation) হতে, অনন্তসমাপত্তির (Expansion into the Infinite) ভাবনা হতে তা হয়—যেমন সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে আকাশে মিলিয়ে যায়, তারপর জ্যোৎস্না ফুটে ওঠে—এমনিতর আর কি! তখন আপনা হতে জপ হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা pervasive concentration-এর, তাই ভয়ের কোন কারণ নাই। Exclusive concentration-এ অনেক সময় tension থেকে ভয়ের কারণ উপস্থিত হয়।
এই অজ্ঞাতনামা অনিমিত্ত-সুহৃৎটি কে, জানি না। আমি ভাবছি তিনিই হবেন, তা ছাড়া আর কে? রবীন্দ্রনাথের একটা গান মনে পড়ে—“যে জন দেয় না দেখা, যায় যে দেখে—ভালোবাসে আড়াল থেকে, আমার মন মজেছে সেই গভীরের গোপন ভালবাসায়।।”
এখানে মেঘ-রৌদ্রের লুকোচুরি চলছে। একটু-একটু শীত পড়ে আসছে। মনে হচ্ছে এবার পূজার সময়টা হয়তো মন্দ কাটবে না। ছেড়ে যাব, তাই প্রকৃতির দাক্ষিণ্যের যেন আর সীমা নাই। বর্ষায় এবার নাজেহাল করলেন না, মালঞ্চে অজস্র ফুল ফুটিয়ে চলেছেন, রজনীগন্ধাদের আবার ডেকে আনলেন, শিউলীকে বললেন, ‘অত তাড়া কিসের, শীতের তো এখনও ঢের দেরি’, দোলনচাঁপাদের এনে অতর্কিতে হাজির করেছেন। যেদিকে তাকাই, চোখ যেন আর ফেরাতে পারি না। হঠাৎ-সিদ্ধ আর কৃপা-সিদ্ধের মধ্যে Suddenness is a common factor। দুয়ের তফাৎটা হচ্ছে গোড়ার দিকে নয়, শেষের দিকে। উপমা দুটি লক্ষ্য করুন। একটি হচ্ছে ঘরে আলো জ্বলা, আরেকটি হচ্ছে ধনদৌলত পাওয়া। আলোর সিদ্ধি আর ঐশ্বর্যের সিদ্ধি তো একরকমের নয়। আলো এলে আর যায় না—এ ইঙ্গিতও এখানে প্রচ্ছন্ন আছে। কিন্তু ঐশ্বর্য নাও থাকতে পারে।
অনির্বাণের ‘পত্রং পুষ্পম্’ থেকে