অহল্যা বলেছিলেন, “হে রাম, আমার যদি শূকর গর্ভে জন্ম হয়, তাতেও আমার আপত্তি নাই, কিন্তু তোমার পাদপদ্মে যেন শুদ্ধা ভক্তি থাকে। ধন, মান, দেহ, সুখ কিছুই চায় না, কেবল ঈশ্বরকে দেখতে চায়। এরই নাম শুদ্ধা ভক্তি। যখন নারদ রাবণ বধের কথা রামচন্দ্রকে স্মরণ করাবার জন্য অযোধ্যায় গিয়েছিলেন তখন সীতারাম দর্শন করে স্তব করতে লাগলেন। রামচন্দ্র নারদের স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাহিলেন। নারদ বল্লেন, “রাম, যদি একান্ত আমায় বর দিবে, তবে এই বর দাও যেন তোমার পাদপদ্মে আমার শুদ্ধা ভক্তি থাকে; আর যেন তোমার ভুবন মোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হয়।” রাম আরও কিছু বর দিতে চাহিলেন, নারদ বল্লেন, “আর কোন বর চাই না।”
আবার আছে উর্জিতা ভক্তি। তাতে ভাবে হাসে, কাঁদে, নাচে, গায়—ভক্তি যেন উথলে পড়ছে। যেমন চৈতন্যদেবের। রাম লক্ষ্মণকে বল্লেন, “ভাই যেখানে দেখবে উর্জিতা ভক্তি, সেখানে আমি স্বয়ং বর্ত্তমান জানবে। যারা ঈশ্বরের খুব কাছে তাদের ভিতরই ভক্তি, ভাব এই সব হয়; আর দু-একজনের (ঈশ্বর কোটীর) মহাভাব, প্রেম এ সব হয়।
একটি আছে নিষ্ঠাভক্তি। শ্বশুর, শাশুড়ী দেওর ভাসুর সবাইয়ের সেবা করে, পা ধোবার জল দেয়, গামছা দেয়, আসন দেয়, কিন্তু পতিকে যেরূপ সেবা করে, সেরূপ সেবা আর কাকেও করে না। পতির সঙ্গে সম্বন্ধ আলাদা। সবাইকে প্রণাম করবে, কিন্তু একটীর উপর প্রাণ ঢালা ভালবাসার নাম নিষ্ঠা। হনুমানের এত নিষ্ঠা যে রামরূপ বই আর কোনরূপ তার ভাল লাগতো না। নিষ্ঠা ভক্তি না হলে সচ্চিদানন্দ লাভ হয় না। যেমন এক পতিতে নিষ্ঠা থাকলে সতী হয়, তেমনি আপনার ইষ্টের প্রতি নিষ্ঠা হলে ইষ্টদর্শন হয়। নিষ্ঠার পর ভক্তি। ভক্তি পাকলে ভাব হয়। ভাব ঘনীভূত হলে মহাভাব হয়। সর্ব্বশেষে প্রেম। প্রেম রজ্জু স্বরূপ। প্রেম হলে ঈশ্বরকে বাঁধবার দড়ি পাওয়া যায়। যাই দেখতে চাইবে দড়ি ধরে টানলেই হয়। গোপীদের এত নিষ্ঠা যে, মথুরায় রাজবেশে পাগড়ী মাথায় কৃষ্ণকে দর্শন করলে, তখন তারা ‘ইনি আবার কে, এর সঙ্গে আলাপ করে কি আমরা দ্বিচারিণী হব?” বলে ঘোমটা দিলে। তারা বৃন্দাবনের মোহনচূড়া, পীতধড়াপরা রাখাল কৃষ্ণ ছাড়া আর কিছু ভালবাসবে না। দ্বারকায় হনুমান এসে বল্লে ‘সীতারাম দেখবো’। ঠাকুর রুক্মিণীকে বললেন, “তুমি সীতা হয়ে বস, তা না হলে হনুমানের কাছে রক্ষা নাই।”
তুমি এ রকম ঢিমে তেতালা বাজালে চলবে না। তীব্র বৈরাগ্য দরকার। ১৫ মাসে একবৎসর করলে কি হয়? তোমার ভিতরে যেন জোর নাই। শক্তি নাই। চিঁড়ের ফলার আঁট নাই, ভ্যাদ ভ্যাদ করচে। উঠে পড়ে লাগো। কোমর বাঁধো। কেউ কেউ বলে ‘এ জন্মে না হোক পর জন্মে পাব’—ও কি কথা? অমন ম্যাদাটে ভক্তি করতে নাই। শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, বা মধুর—এই সকলের মধ্যে একটা ভাব আশ্রয় না করলে তাঁকে লাভ করা যায় না, ঋষিদের শান্তভাব ছিল। তারা আর কিছু ভোগ করবার ইচ্ছা কোরতো না। যেমন স্ত্রীর স্বামীতে নিষ্ঠা, সে জানে আমার পতি কন্দর্প। হনুমানের দাস্যভাব। যখন রামের কাজ করে তখন সিংহ তুল্য। স্ত্রীরও দাস্যভাব থাকে। তাই স্বামীর সেবা প্রাণপণে করে। মার কিছু কিছু থাকে; যশোদারও ছিল।
কুমারকৃষ্ণ নন্দী সংকলিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ বাণী ও শাস্ত্রপ্রমাণ’ থেকে