এই শোনো, শুনতে পাচ্ছ না? ভক্তগণ উদ্গ্রীব হয়ে শুনবার চেষ্টা করছেন। চারিদিকে বড় বড় শাল পাইনের গাছ। বাতাসে শনশন শব্দ। আবার বলে উঠলেন মা,—শোনো, কান পেতে শোনো, ওই যে আমি শুনতে পাচ্ছি—‘নিগমকল্পতরোর্গলিতং ফলম্।’ বলামাত্র মাকে বেষ্টন করে যে ভক্তরা বসেছিলেন সবাই শুনতে পেলেন। ও পাতার শব্দ তো নয়। ওই তো শোনা যাচ্ছে। ঠিকই বলেছেন মা, ওই তো সবই শুনতে পেলেন ভাগবতের সেই প্রসিদ্ধ শ্লোক—
‘‘নিগমকল্পতরোর্গলিতং ফলং শুকমুখাদ মৃতদ্রব সংযুগম্,
পিবত ভগবতং রসমালয়ং মুহুরহো রসিকা ভুবি ভাবুকাঃ ’’
ঘটনাটি ঘটেছে নৈমিশারণ্যে আনন্দময়ী মার আশ্রমে! কথাটা আমার প্রত্যক্ষ শ্রোতার কাছ থেকে শোনা। শব্দ তো আকাশের গুণ। নিত্য আকাশে কত শব্দ ভাসছে। আকাশ মরে না শব্দও করে না। আকাশ বিভু। অনাদিকাল থেকে কত শব্দ ছড়িয়ে আছে। আকাশ ভরে না। সেই শব্দ ধরবার যন্ত্র আজকাল তৈরি হয়েছে, দূরের শব্দ নিকটে আসছে। তেমন তেজস্বী যন্ত্র যদি থাকে তো এই নৈমিশারণ্যে উচ্চারিত সূতমুনির ভাগবতী বাণী ধরতে পারবে। মায়ের হৃদ্যন্ত্রটি তো ‘সর্বাভূতরুতজ্ঞানগ্রাহী।’ ‘অনাহত শব্দ ধরতে পারেন, ধরাতেও পারেন। এই শ্লোকটি শ্রীমদভাগবতের তৃতীয় শ্লোক। এর পূর্বশ্লোকে ভাগবতের বশীকারিতারূপ ঐশ্বর্য দেখানো হয়েছে। ঈশ্বরকেও হৃদয়ে অবরুদ্ধ করেন এই ভাগবত। এখন এই শ্লোকে মাধুর্য দেখানো হচ্ছে, পূর্বে বলা হয়েছে শ্রীমদ্ভাগবত সর্বশাস্ত্র অপেক্ষা সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু এই শ্লোকে বলা হচ্ছে, এটি সর্বশাস্ত্রের ফলস্বরূপ। বৃক্ষ চেনা যায় তার ডাল-পালা, প্রসারতা দেখে নয়, চেনা যায় তার ফল দেখে। তেমনি এই ভাগবতে চরম ফলটি ঘোষিত হয়েছে। কি সেই ফল? আসুন, আমরা সেই ফল আস্বাদ করি। কি কি কারণে ফল গ্রহণযোগ্য হয় না তা আমরা জানি। যেমন, প্রথমত, যদি ফল খুব উঁচু জলে থাকে এবং নাগালের বাইরে থাকে তা হলে সেই ফল পাবার আশা নেই। দ্বিতীয়ত, যদি ফলটি পাকা না হয় জোর করে পাড়া হয়, তা হলেও গ্রহণযোগ্য হয় না। তৃতীয়ত, ফলটি যদি পেকে উঁচু থেকে মাটিতে পড়ে, তা হলে সেটিও ফেটে ছত্রাকার হয়ে যায় বলে গ্রহণের অযোগ্য। চতুর্থত, যদি বা ভাল থাকে তা হলে তার খোসা, আঁটি বাদ দিয়ে ভাল অংশটি গ্রহণ করা যাবে, সবটুকু নয়।
এই শ্লোকে একটি একটি করে ওই বাধাগুলি যে ভাগবতে নেই তা বলা হচ্ছে। প্রথমত, এটি খুব উঁচু ডালের ফল, আমাদের নাগালের বাইরে সেকথা ঠিক। কারণ, এটি ‘নিগমকল্পতরোঃ ফলং’—নিগমকল্পতরুর ফল। নিগম হল বেদ। এটি খুব উঁচু ডাল। ভাগবত প্রথমে নারায়ণ স্বয়ং বলেছিলেন ব্রহ্মাকে। সেটি চতুঃশ্লোকী ভাগবত। ব্রহ্মা সেইটি তাঁর মানসপুত্র নারদকে দিলেন, বললেন, ‘বিপুলীকুরু।’ কিন্তু নারদের সময় কই? শুধু হরিগুণগান করে বেড়ান। তাই স্বর্গের ফল অর্থাৎ খুব উঁচু ডালের ফল, ‘গলিতং ফলং’, এটি নারদের কৃপায় গলিত হয়ে ‘ভুবি’ ভূতলে নেমে এল। তিনি দিলেন বেদব্যসকে। বললেন, ‘তুমি বাড়াও একে।’ তাঁর চিত্তপ্রসাদন হবে তা হলে। পরবর্তিকালে বেদব্যাসের কাছ থেকে পেয়েছিলেন শুক। শুকের কাছ থেকে পেয়েছিলেন সূতমুনি।
ব্রহ্মচারিণী বেলা দেবীর ‘ভাগবতী কথা’ থেকে