মহাবিশ্বে আলোর গতি সবচেয়ে বেশি। বৃহস্পতির একটি উপগ্রহ পর্যবেক্ষণ করার সময় আলোর গতি সম্পর্কে ধারণা হয় বিজ্ঞানী রোমারের। কীভাবে আলোর গতিবেগ নির্ণয় করা হল সেই গল্পই শোনালেন স্বরূপ কুলভি

হাবিশ্বে আলোর গতিই সবচেয়ে বেশি। আলোর চেয়ে কোনও কিছুই দ্রুত ছুটতে পারে না। শূন্যস্থানে আলোর বেগ সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল বা প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার। এমন যদি সম্ভব হতো, সূর্যের আলো সুইচ টিপে কেউ নিভিয়ে দেয়, তাহলে তা পৃথিবীর মানুষের জানতে প্রায় আট মিনিট লেগে যাবে। তোমাদের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে, বাড়িতে সুইচ টিপলেই তো আলো জ্বলে। আর সুইচ বন্ধ করলেই সঙ্গে সঙ্গে নিভে যায়। তাহলে সূর্যের বেলা এত দেরি কেন? এর কারণ হল, সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব। পৃথিবী থেকে সূর্য মোটামুটি ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে। তাই অত পথ পেরিয়ে আলো আসতে  ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ডের মতো সময় লাগে। কি, আলোর বেগ কতটা বেশি, তা অনুমান করতে পারছ? তাহলে একটু সহজ উদাহরণ দিয়ে দেখা যাক। ধর, তোমার একটি গাড়ি আছে। সেই গাড়িটি কোনও বিরতি না নিয়েই টানা ২৪ ঘণ্টাই চলতে পারে। ঘণ্টায় গতি ১০০ কিলোমিটার। এই গাড়ি নিয়ে সূর্যে পৌঁছতে সময় লাগবে ১০৬ বছর। তাহলেই ভাব, আলোর গতি কতটা দ্রুত। আসলে কোনও বস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে চোখে এসে পড়লে বস্তুটি দৃশ্যমান হয়। বস্তু থেকে ওই আলো এসে পৌঁছতে কিছুটা সময় লাগে। বস্তু দূরে হলে সময় বেশি লাগবে। আর কাছে হলে লাগবে কম সময়। তাই আলোরও গতি রয়েছে।
কিন্তু এই গতির পরিমাপ হল কীভাবে? মজার ব্যাপার হল, একটা সময় জানাই ছিল না যে আলোর গতি রয়েছে। কিন্তু পরে সেই ধারণার বদল হয়। তবে, বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছিল বিস্তর মতপার্থক্য। কেউ বলতেন, আলোর গতির কোনও সীমা নেই। আবার কেউ বলতেন, না, একটা সীমা আছে। শেষপর্যন্ত জট খুলল সতেরো শতকে। আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে। সালটা ১৬৭৬। এর জন্য স্যর আইজ্যাক নিউটন ও গ্যালিলিওর মতো বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীদের গবেষণা পথ দেখিয়েছে।
মহাবিশ্বে কোনও কিছুই নিয়মের বাইরে নয়। পৃথিবী নিজের অক্ষের উপর প্রায় ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘুরে আসে। এরফলেই হয় দিন-রাত। এই সময়ের কোনও নড়চড় হয় না। নিউটন জানালেন পৃথিবীর কক্ষপথ কেমন ও কেন এমন। সেইসঙ্গে তিনি যুগান্তকারী মহাকর্ষ সূত্র সহ অন্যান্য সূত্র বের করলেন। কোন গ্রহের চারপাশে কোন উপগ্রহ কীভাবে, কত গতিতে ও কত সময়ে ঘুরবে— এই সব হিসেবে অনেক নিখুঁতভাবে পাওয়া গেল। যেমন চাঁদ কক্ষপথে কোন সময়ে কোথায় থাকবে, সেগুলিও সঠিকভাবে বের করা সম্ভব হল। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সমস্যায় পড়লেন বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহগুলি নিয়ে। আরও ভালো করে বললে, বৃহস্পতির উপগ্রহগুলির কক্ষপথ নিয়ে। নিউটনের হিসেব অনুযায়ী বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে ঘোরার সময় পৃথিবী থেকে উপগ্রহগুলো যে জায়গায় দেখা যাওয়ার কথা, বাস্তবে তেমন ঘটছে না। কখনও কখনও সময় মতোই দেখা মিলছে। কখনও আবার বেশ কয়েক মিনিট পরে দেখা যাচ্ছে। তাহলে নিউটনের হিসেবে কোনও গোলমাল রয়েছে? 
ডেনমার্কের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওলে রোমারের মনেও এই খটকা দেখা দিয়েছিল। সময়টা ১৬৭৬ সাল। টেলিস্কোপ দিয়ে বৃহস্পতির উপগ্রহগুলির দিকে চোখ রেখেছিলেন তিনি। দেখলেন, বৃহস্পতি যখন পৃথিবীর কাছে চলে আসে, তখন এই গ্রহের উপগ্রহগুলিকে নির্ধারিত সময়ের আগে দেখা যাচ্ছে। আর বৃহস্পতি যখন পৃথিবী থেকে দূরে সরে যায়, তখন উপগ্রহগুলি নির্ধারিত সময়ের পরে দেখা যায়। বৃহস্পতির আইয়ো উপগ্রহের গ্রহণ দেখার পর একটা চমকে দেওয়ার মতো দাবি করলেন তিনি। কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক দাবি করলেন, যেখানে ঘটনাটি ঘটছে, সেখান থেকে পৃথিবীতে ঘটনাটি পৌঁছতে কিছুটা সময় লাগে। এভাবেই আলোর বেগ নির্ণয় করেন তিনি। তবে আলোর গতির যে হিসেব দিয়েছিলেন, তা নিখুঁত ছিল না।  কিন্তু তাঁর হিসেবের সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে এই পরিমাপ সঠিকভাবে বের করা সম্ভব হয়েছে।