‘পলাতক তুফান’ গল্পটিকে পরে কিছু পরিবর্তন করে ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থের অর্ন্তভুক্ত করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। নাম পাল্টে রেখেছিলেন ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’। তিনিই বাংলার সায়েন্স ফিকশনের জনক।

শীতকালে পদ্মানদী শুকিয়ে গিয়েছে। দু’পাশে জেগে উঠেছে বালির চর। রাত গভীর। পদ্মার বুকে ভাসছে কয়েকটি বজরা, বোট ও ডিঙি নৌকা। রাতের অন্ধকার চিরে ভেসে আসছে সুমধুর কণ্ঠস্বরে গান, ‘এসো এসো ফিরে এসো, বঁধূ হে ফিরে এসো...’। গাইছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যে মুগ্ধ শ্রোতার অনুরোধে গানটি গাইছেন কবিগুরু তিনি তাঁর প্রিয় বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসু। শুধু এই গানটিই নয়, কবির গাওয়া সব গানই যে তাঁর বড় প্রিয়! রোজ রাতে শোবার আগে, রেকর্ডে তাঁর কণ্ঠে ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ না শুনে যে তিনি ঘুমোতে যান না কোনওদিন!
রবীন্দ্রনাথ যখন জমিদারির কাজে সপরিবারে শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে থাকতে যেতেন, তখন তাঁর আহ্বানে প্রতি সপ্তাহের শেষের দু’দিন জগদীশচন্দ্র সস্ত্রীক কাটিয়ে যেতেন তাঁদের সঙ্গে। তবে তাঁর একটা শর্ত ছিল। রবীন্দ্রনাথকে প্রতি সপ্তাহে একটি নতুন ছোটগল্প শোনাতে হবে তাঁকে। জগদীশচন্দ্র সেটি শুনবেন এবং ইংরেজিতে অনুবাদ করানোর দায়িত্ব নেবেন। তাঁর অনুরোধে ভগিনী নিবেদিতা হাসিমুখেই এই অনুবাদের কাজটি করে দিতেন।
জগদীশচন্দ্রের থেকে দু’বছর পাঁচ মাস সাতদিনের ছোট ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তাঁদের বন্ধুত্ব প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, ‘আমার জীবনের প্রথম বন্ধুত্ব জগদীশের সঙ্গে। আমার চিরভ্যস্ত কোণ থেকে তিনি আমাকে টেনে বের করেছিলেন।’
এঁদের বন্ধুত্বের সূচনাটি হয়েছিল অদ্ভুতভাবে! জগদীশচন্দ্র ইউরোপ থেকে সবে ফিরেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অভিনন্দন জানাতে তাঁর বাড়ি গিয়ে দেখেন সেই সময় কোনও একটা কাজে তিনি অনুপস্থিত। তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাজের টেবিলের উপর একটা ম্যাগনোলিয়া ফুল রেখে চলে এলেন। পরবর্তীকালে জগদীশচন্দ্র আবিষ্কার করেছিলেন উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। সেদিন তিনি নিশ্চয়ই ওই ম্যাগনোলিয়া ফুলটির মধ্যে কবিগুরুর ভালোবাসার স্পন্দন আবিষ্কার করেছিলেন! কারণ সেই মুহূর্ত থেকেই তাঁদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছিল! এই বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ এই বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী নিয়ে সারাজীবনে রবীন্দ্রনাথ বহু কবিতা, প্রবন্ধ লিখেছেন। উৎসর্গ করেছেন তাঁর ‘কথা’ ও ‘খেয়া’ কাব্যগ্রন্থ দু’টি।
রবীন্দ্রনাথদের একটি দল ছিল। সেই দলে ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভগিনী নিবেদিতা, অতুলপ্রসাদ সেন, কাজী নজরুল ইসলাম ও আরও অনেক দিকপাল! যে বাড়িতে এই দল উপস্থিত হতো, সেই বাড়িতে বসাতে হতো সাহিত্য-সভা! সেই সঙ্গে আয়োজন করতে হতো দেদার ভূরিভোজেরও! পরে এই দলের নাম রাখা হয় ‘খামখেয়ালী সভা’!
তাঁর এই বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী বন্ধুটির ভেতরের অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয়, কল্পনাপ্রবণ শিশুটিকে আবিষ্কার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ‘আবদুল মাঝির গল্প’টি মনে আছে নিশ্চয়ই? আবদুল পদ্মা থেকে এনে দিত ইলিশমাছ আর কচ্ছপের ডিম? আর শোনাত তার অদ্ভুত কল্পকাহিনি? বাস্তবের আবদুল মাঝিকে রবীন্দ্রনাথ যেন খুঁজে পেয়েছিলেন জগদীশচন্দ্রের মধ্যে!
জগদীশচন্দ্র যখন পদ্মার বোটে রবীন্দ্রনাথের  পরিবারের সঙ্গে থাকতে আসতেন, তখন রবি-পুত্র বালক রথীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে পদ্মার চরে খুঁজে বেড়াতেন তাঁর অতিপ্রিয় খাদ্য কচ্ছপের ডিম! এমনকী, কেমন করে কচ্ছপের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে লুকোনো ডিম খুঁজে বের করতে হয়, তাও শিখিয়ে দিয়েছিলেন বালক রথীন্দ্রনাথকে!
কবির ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাঁর আরও একটি মজার খেলা ছিল। বালক রথীকে বলতেন পদ্মার চরে কয়েকটা গর্ত খুঁড়ে রাখতে। রথীর খোঁড়া হয়ে গেলে তিনি তাদের প্রত্যেকের মাথায় বেঁধে দিতেন ভেজা গামছা। তারপর এক-একটা গর্তের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের এক-একজন ছেলেমেয়েকে ঢুকিয়ে দিয়ে গলা পর্যন্ত বালি চাপা দিয়ে দিতেন। শুধু মুখটা বেরিয়ে থাকত। এরপর নিজেও তেমন করেই গর্তে সেঁধিয়ে যেতেন! কিছুক্ষণ পর যখন সবার গা তেতে উঠত, তখন গর্ত থেকে ছুট্টে গিয়ে সবাইকে নিয়ে পদ্মার জলে ঝাঁপিয়ে পড়তেন! বলতেন এতে স্বাস্থ্য খুব ভালো থাকে। বন্ধুর এই কীর্তিকলাপ দারুণ উপভোগ করতেন রবীন্দ্রনাথ!
মনে আছে নিশ্চয়ই আবদুল মাঝি তার গল্পে চিতাবাঘকে দিয়ে তার নৌকার গুণ টানিয়েছিল? আর জগদীশচন্দ্র শুনিয়েছিলেন বাংলার প্রথম কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি ‘পলাতক তুফান’!
বিখ্যাত ব্যবসায়ী এইচ বোস নতুন একটি চুলের তেল ‘কুন্তলীন’-এর প্রচারের জন্য আয়োজন করেছিলেন একটি সাহিত্য প্রতিযোগিতার। যাতে শর্ত ছিল গল্পের মধ্যে ‘কুন্তলীন’কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিতে হবে। শ্রেষ্ঠ গল্পটির লেখক  পাবেন পঞ্চাশ টাকা পুরস্কার। ‘পলাতক তুফান’ লিখে প্রথম পুরস্কারের পঞ্চাশ টাকা জিতে নিয়েছিলেন বিশ্ববরেণ্য এই বিজ্ঞানী!
গল্পটি হল, একটি জাহাজের সমুদ্রযাত্রার সময় প্রবল ঝড় উঠেছে! ঢেউ উত্তাল। মাস্তুল ভেঙেছে। লাইফ-বোট ভেসে গিয়েছে। জাহাজ টলমল করছে। যাত্রীরা প্রাণভয়ে চিৎকার করছে! সেইসময় একজন যাত্রীর হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে, তার মাথার টাকের পাশের অবশিষ্ট চুলগুলো যাতে সমুদ্রযাত্রার সময় লোনা জলহাওয়ায় সম্পূর্ণ নির্মূল না হয়ে যায়, সেজন্য তার আট বছরের মেয়ে তার ব্যাগে এক শিশি ‘কুন্তল কেশরী’ তেল ভরে দিয়েছিল! কথাটা মনে হওয়া মাত্র সেই যাত্রীটি কুন্তল কেশরীর শিশিটার ছিপি খুলে সেটা সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিল! মুহূর্তের মধ্যে ঢেউয়ের উপর ছড়িয়ে পড়ল সেই তেল, মিশে গেল সমুদ্রের জলের সঙ্গে আর ম্যাজিকের মতো শান্ত হয়ে গেল সমুদ্র! শুধুমাত্র এক শিশি কুন্তল কেশরীর দৌলতে বেঁচে গেল জাহাজের যাত্রীরা!
এই গল্পটিকে পরে কিছু পরিবর্তন করে তাঁর লেখা ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থের অর্ন্তভুক্ত করেছিলেন জগদীশচন্দ্র। নাম পাল্টে রেখেছিলেন ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’।
কি দুর্ধর্ষ কল্পনা তাই না? এই কারণেই তাঁকে বাংলার সায়েন্স ফিকশনের জনক বলা হয়।
জগদীশচন্দ্রের সান্নিধ্যে এসে রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছেন তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ ‘ বিশ্বপরিচয়’, তেমনই রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে এসে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র হয়েছেন লেখক। তাঁর লেখা গ্রন্থের সংখ্যা প্রচুর। আজও যা প্রাসঙ্গিক।
চিরপ্রণম্য এই বিজ্ঞানসাধক জন্মেছিলেন ১৮৫৯ সালের ৩০ নভেম্বর। আর তাঁর মৃত্যুদিনও চলতি মাসেই। ২৩ নভেম্বর।