ঠাকুরবাড়ির আলোর উৎসব
আজ দীপাবলি। সকলে মেতে উঠবেন আলো আর আতসবাজির আনন্দে। জোড়াসাঁকোয় রবি ঠাকুরের বাড়িতে কীভাবে পালিত হতো দিনটি, লিখলেন পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
উৎসবের আনন্দ এখনও থিতিয়ে পড়েনি। বরং বলা যায়, আমরা এক উৎসব পেরিয়ে আরেক উৎসবে পৌঁছেছি। শারদ-প্রাতে যেমন শিউলি ফুটত, তেমনই ফুটছে এই হেমন্তেও। কোজাগরীর পূর্ণিমা-চাঁদ জৌলুস হারালেও অন্ধকার জমাট বাঁধেনি। চারদিকে এখন আলো। আলোর উৎসবে অমাবস্যার অন্ধকার কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। দীপাবলি মানে শুধুই দীপ জ্বালিয়ে ঘর সাজানো নয়, আলোর সঙ্গে আছে বাজি। আলোর বাজি, শব্দের বাজি। আলোর বাজি চোখ জুড়োয়। শব্দ-বাজি আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠে। শব্দ-বাজি নয়, আলোর বাজিতে আকাশ ঝলমলিয়ে উঠত পুরনো কলকাতাতেও।
কালীপুজোকে ঘিরে যে আলোর উৎসব, সে উৎসবে ঠাকুরবাড়ির সকলে না হলেও কেউ কেউ মেতে উঠতেন। রবীন্দ্রনাথের কালে নয়, এই মেতে ওঠার ঘটনা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেই বেশি দেখা গিয়েছে। ঠাকুরবাড়িতে একসময় দুর্গাপুজো হতো। হতো জগদ্ধাত্রীপুজোও।
রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগেই দুর্গা ও জগদ্ধাত্রী— এই দুই পুজোই বন্ধ হয়েছিল জোড়াসাঁকোয়। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচর্চায়, বিশেষত চিঠিপত্রে আছে মোহময় শরৎ ঋতুর কথা, আনন্দময় দুর্গোৎসবের কথা। ঠাকুরবাড়িতে কস্মিনকালেও কালীপুজো হয়নি। অথচ ঠাকুরবাড়িতে বাজি তৈরি নিয়ে রীতিমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। বাজি তৈরির আশ্চর্য কলাকৌশল রপ্ত করেছিলেন ঠাকুরবাড়ির জামাই সরোজ মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন গগনেন্দ্রনাথের কন্যা সুজাতার স্বামী। তাঁর মা ছিলেন বিদ্যাসাগরের পুত্র নারায়ণচন্দ্রের কন্যা। ঠাকুরবাড়ির এই জামাইটি পেশায় ছিলেন অ্যাটর্নি। ঘরজামাই হয়ে থাকতেন জোড়াসাঁকোর পাঁচ নম্বর বাড়ির তিনতলায়।
ঠাকুরবাড়ির সেই বাজি পোড়ানো নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহলের শেষ ছিল না। অবনীন্দ্রনাথের পৌত্র সুমিতেন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, জোড়াসাঁকো-বাড়ির আশপাশের প্রতিটি গলিতেই, মদন চ্যাটার্জি লেন, বারাণসী ঘোষ লেন বা সিংহীবাগানে— কোথায় না দীপাবলির রাতে লোক জড়ো হতো! জড়ো হওয়া মানুষজনের সীমাহীন কৌতূহল। সকলেই দেখতে চাইত ঠাকুরবাড়ির বাজি পোড়ানো।
সরোজ মুখোপাধ্যায়ের এক বন্ধু, বাদুড়বাগানের শ্রীশ গুপ্ত বাজির ব্যবসা করতেন। তিনি ছিলেন রসায়নবিদ। ফলে রকমারি বাজি তৈরিতে তাঁর জুড়ি ছিল না। বন্ধুর কাছে চমক জাগানো সব বাজি তৈরির গল্প শুনে ঠাকুরবাড়ির জামাই উৎসাহিত হয়েছিলেন বাজি বানানোয়। বাজি বানানোর এই কাজে সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন অবনীন্দ্রনাথের পুত্র অলোকেন্দ্রনাথ। আরও একজন প্রবল উৎসাহে পাশে থাকতেন, তিনি মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথের নাতি।
মোহনলালের সমবয়সি বাড়ির অন্য সদস্যদের বাজি তৈরির ব্যাপারে কম উৎসাহ ছিল না। রীতিমতো পড়াশোনা করতেন, কেমিস্ট্রির বই ঘেঁটে রকমারি রাসায়নিক পদার্থ সংগ্রহ করে কত রকমের চোখ জুড়নো বাজি তৈরি করতেন। আকাশের গায়ে আলো আর রঙের বিচ্ছুরণ দেখে সকলেই বিস্মিত হতো। ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণে অবস্থিত দোলনাবাগানের আমতলা থেকে এমন সব রকেট ছাড়া হতো, যা দেখার জন্য কালীপুজোর রাতে আশপাশের সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। ছাদ থেকে ছাড়া হতো কত রকমের হাউই! আলোয় আলোয় চারপাশ ভরে উঠত।
নানান রকমের বাজি তৈরি হতো। তুবড়ি, উড়ন-তুবড়ি, চটপটি, ছুঁচোবাজি— কত রকমের, কত ধরনের বাজি। এসব বাজি ওড়ানো, পোড়ানো সহজ কাজ ছিল না। বাজি তৈরির কাজে সরোজ মুখোপাধ্যায়কে অবনীন্দ্রনাথের নাতি সুমিতেন্দ্রনাথও সাহায্য করতেন। কীভাবে উড়ন-তুবড়ি জ্বালাতেন, সে বিবরণ আছে তাঁর লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘একতলার হলে আমি উড়ন-তুবড়ি বানাতুম তারপর তুবড়ির মুখে আগুন দিয়ে জ্বলন্ত মুখটা মাটির দিকে করে দু’আঙুলে ঘুরিয়ে ছেড়ে দিতুম। জ্বলন্ত ধূমকেতুর পুচ্ছ নিয়ে তা কানের পাশ দিয়ে, সোঁ সোঁ শব্দে শূন্যে উঠে মিলিয়ে যেত।’
সুমিতেন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, এই উড়ন-তুবড়ি জ্বালানো নিয়ে ঠাকুরবাড়িতে দু-একটা ছোটখাট দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এর ফলে এই তুবড়ি বানানো নিষিদ্ধ হয়েছিল। উড়ন-তুবড়ি বানানো বন্ধ হলেও বসন্ত-তুবড়ি বানানো হতো।
সেকালে কালীপুজোর রাতে অজস্র ফানুস দেখা যেত কলকাতার আকাশে। সুমিতেন্দ্রনাথের লেখায় আছে, ‘প্রায় প্রতিটি প্রতিবেশীর বাড়ির ছাদ থেকে একটার পর একটা — কত ছাঁদের, কত রংবেরঙের ফানুস ছাড়া হতো স্পিরিট বা কেরোসিনে চোবানো নুটির জ্বলন্ত গ্যাসে। তরতর করে ফানুসগুলো হেলতে দুলতে সোজা উপরে উঠে যেত, তারপর উপরকার বাতাসের স্রোতের পথে চলে যেত দূর থেকে দূরে!’
বাজি বানানো সহজ নয়। কোন মশলা কতটা দিতে হবে, তারও ফর্মুলা আছে! সেই রাসায়নিক-ফর্মুলা লেখা থাকত মোহনলালের খাতায়। ভুলচুক হওয়ার কোনও অবকাশ ছিল না। শুধু মশলার ভাগ-বন্টন নয়, প্যারাসুটের কাগজের ভাঁজ কী রকম হবে, ফানুসের কাগজ কীভাবে কাটা হবে, নকশা কেমন হবে, সব লেখা থাকত ওই খাতায়। বাজি সম্পর্কিত নানা তথ্যে ঠাসা খাতাটার মজাদার নামকরণ করেছিলেন তিনি। নাম দিয়েছিলেন ‘সবজান্তা বাবা’।
ফানুস তৈরির ক্ষেত্রে মোহনলালের অপরিসীম দক্ষতা ছিল। ‘ফানুস বানাতে ওস্তাদ’ ছিলেন তিনি, এমনই মনে হয়েছিল সুমিতেন্দ্রনাথের। সুমিতেন্দ্রনাথও ফানুস বানাতেন। নানা রকমের ফানুস তৈরি করতেন তিনি। ঘড়ি-ফানুস, মানুষ-ফানুস, হাতি-ফানুস, আপেল-ফানুস, কুঁজো-ফানুস — ফানুসের জগৎ ছিল বড়ই বৈচিত্র্যময়!
জোড়াসাঁকো বাড়িতে যেমন বাজি তৈরি, ফানুস তৈরি হতো, তেমনই হতো ডানলপের অদূরে ‘গুপ্তনিবাস’-এ। অবনীন্দ্রনাথ জীবনের শেষপর্বে সপরিবারে গাছ-গাছালিতে ঘেরা এই বাড়িতে কাটিয়েছেন। সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় গুপ্তনিবাসে বাজি তৈরির কথা আছে, আছে মোহনলাল- কন্যা ঊর্মিলা গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখাতেও। বাড়ির উঠোনে বাজির মশলা নিক্তিতে ওজন হচ্ছে, সে স্মৃতি ভুলতে পারেননি ঊর্মিলা। বাড়ির ছোটরা তুবড়িতে মশলা ঠেসার ভার পেত। বুড়ো আঙুল বাঁকা থাকলে ভালো ঠাসা সম্ভব, আঙুল বাঁকা থাকলেই দেওয়া হতো অগ্ৰাধিকার। ‘গুপ্ত নিবাসে’র অদূরে ছিল ডানকুনি-শিয়ালদা ট্রেনলাইন। একবার প্রচুর বাজি পোড়ানো হচ্ছে, ঠিক তখনই একটা ট্রেন আসছিল, ট্রেনটি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। মোহনলাল-কন্যা লিখেছেন, ‘যতক্ষণ না সব বাজি শেষ হয়ে বাগান অন্ধকার হয়ে গেল, ট্রেন দাঁড়িয়ে রইল। কত্তাবাবা বললেন, দেখেছিস, ড্রাইভার সাহেবের চোখ আছে বলতে হবে।’ ‘কত্তাবাবা’ আর কেউ নন, অবনীন্দ্রনাথ।
কালীপুজো নিয়ে ব্রাহ্মসমাজে উন্মাদনার কথা নয়। ঠাকুরবাড়িতে ধর্মীয় উন্মাদনা না থাকলেও বাজি পোড়ানোর আনন্দ ছিল। ভাইফোঁটার মতো মাধুর্যময় দিনটি ঠাকুরবাড়িতে অবশ্য বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছে। ভাই-বোনের চিরায়ত সম্পর্কের এই স্মারক-উৎসব বেশ ঘটা করেই উদ্যাপিত হতো। সৌদামিনী-সুকুমারী-শরৎকুমারী- স্বর্ণকুমারী ও বর্ণকুমারীর কাছে দ্বিজেন্দ্রনাথ-সত্যেন্দ্রনাথ-হেমেন্দ্রনাথ-জ্যোতিরিন্দ্রনাথরা ফোঁটা পেতেন। ফোঁটা পেতেন রবীন্দ্রনাথও। রবীন্দ্রনাথ তাঁর দিদিদের সামান্য হলেও প্রণামী দিতেন। কিশোর-বয়সে সেই টাকা কখনও তাঁকে দিয়েছেন নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবী।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তখন নানা বিপর্যয়ের পর থাকতেন রাঁচিতে। কাছে না থাকায় ভাইফোঁটায় স্বর্ণকুমারী তাঁকে পাঠিয়েছিলেন চন্দনগুঁড়ো। ক’দিন পরই উত্তর এসেছিল কবিতায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘প্রাণ খুলি করি বোন এই আশীর্বাদ, পূর্ণ হয় যেন তব যত কিছু সাধ।’ রবীন্দ্রনাথকে বৃদ্ধ-বয়সেও ফোঁটা দিয়েছেন বর্ণকুমারী। ভাই-বোন দু’জনেরই তখন অনেক বয়স হয়েছে। বর্ণকুমারী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের থেকে চার বছরের বড়। একবার ভাইফোঁটায় ভাইকে কাছে না পেয়ে বর্ণকুমারী চিঠিতে তাঁকে লিখেছিলেন, ‘ধান-দূর্বা-ফুল দিয়া আশীর্বাদ করিলাম।’
সে চিঠি হাতে পেয়ে শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘তোমার ভাইফোঁটা পেয়ে খুশি হয়েছি। আমাদের ঘরে ফোঁটা নেবার জন্য ভাই কেবল একটি মাত্র বাকি আর দেবার জন্যে আছেন এক দিদি।’ রবীন্দ্রনাথের কথায় দুঃখ মিশে ছিল, দাদা-দিদিদের বিয়োগ-বেদনা কবির মনে জেগে উঠেছিল। সে বছর ফোঁটা না দিতে পারলেও পরের বছর রবীন্দ্রনাথকে ফোঁটা দিয়েছিলেন বর্ণকুমারী। অসুস্থ কবি তখন সবে পাহাড় থেকে জোড়াসাঁকোয় ফিরেছেন। ভাইয়ের আসার খবর শুনে ছুটে এসেছিলেন দিদি। মিলন-মধুর দৃশ্যটি ধরা আছে রানি চন্দের ‘গুরুদেব’ বইতে। সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য, বই থেকে একটু তুলে দেওয়া যেতে পারে, ‘গুরুদেবের এক দিদি জীবিত তখন— বর্ণকুমারী। তিনি এলেন আশি বছরের ভাইকে ফোঁটা দিতে।... আঙুলে চন্দন নিয়ে গুরুদেবের কপালে কাঁপতে কাঁপতে ফোঁটা কেটে দিলেন।...ফোঁটা কেটে তিনি বসলেন বিছানার পাশে চেয়ারে। ভাইয়ের বুকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।’
পাহাড়ে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাই বর্ণকুমারী বকা দিলেন ভাইটিকে, ‘দেখো রবি, তোমার এখন বয়স হয়েছে, এক জায়গায় বসে থাকবে। অমন ছুটে ছুটে আর পাহাড়ে যাবে না কখনও। বুঝলে?’ রবীন্দ্রনাথের শরীর ভেঙে পড়লেও রসবোধে, রসিকতায় ঘাটতি পড়েনি। বলে উঠেছিলেন, ‘না, কখনো আর ছুটে ছুটে যাব না, বসে বসে যাব এবার থেকে।’
রানি চন্দকে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত স্নেহ করতেন। রানির মনে হয়েছিল, ‘সেদিন দিদির সঙ্গে তাঁর এই কথা রোগশয্যায় যেন উৎসবের আমেজ এনে দিল।’
12th November, 2023