যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
গত বুধবার ধর্মতলায় বিজেপির সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের ফ্লপ সভা থেকেও সেই ইঙ্গিত মিলেছে। এরাজ্যেও, ভোটের কড়া নাড়া শুরু হতেই দিল্লি থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি শুরু হয়েছে। কিন্তু অমিত শাহদের নামে কি আর কোনও আবেগ অবশিষ্ট আছে এই বঙ্গে, কিংবা ঘটা করে প্রধানমন্ত্রীকে এনে লক্ষ কণ্ঠের গীতাপাঠে? কোনও একাত্মবোধ নেই। দাঁতে দাঁত চেপে স্থির সঙ্কল্পকে সামনে রেখে অটল লড়াই নেই। এরপরও এরাজ্য থেকে লোকসভার ৩৫টি আসন জেতার খোয়াব আর দেখছে কি
কেন্দ্রীয় বিজেপি? নিদেন পক্ষে ডাবল ফিগার ছোঁয়ার দুরাশা, মায় দশটা লোকসভা আসন জয়ের টার্গেট? বোধহয় না। অমিত শাহ নিজে কোনও সংখ্যা ধর্মতলায় উচ্চারণও করেননি। যদি সেই জোশ থাকত, তাহলে বেশ কয়েক কোটি টাকা খরচ করে পুলিস, আদালতের বাধা পেরিয়ে ধর্মতলায় মঞ্চ বেঁধে মাত্র ২৩ মিনিটের এলেবেলে ভাষণ দিয়েই দিল্লি ফেরত যেতেন না ব্যস্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অন্তত ভাষণ দেওয়ার পর নিউটাউন কিংবা বাইপাসের ধারের পাঁচতারা অট্টালিকায় বঙ্গ বিজেপির নেতাদের সংগঠনের অসুখ সারানোর দাওয়াই দিতেন চা চক্রের ফাঁকে। কৌশল নিয়ে চুলচেরা মতবিনিময় হতো। কিন্তু সেসব কিছুই করলেন না। উল্টে যেখানে বেলা ৩টে পর্যন্ত তাঁর মঞ্চে থাকার কথা, সেখানে বেলা ২টো ৭ মিনিট নাগাদ স্টেজে উঠেই আড়াইটের মধ্যেই বক্তব্য শেষ করলেন তিনি! কারণ মঞ্চের উপর, মঞ্চের নীচে এবং উপস্থিত বঙ্গ বিজেপির নেতানেত্রীদের মধ্যে অনৈক্য, নীচ স্বার্থের বিষগন্ধ তিনি বিলক্ষণ পেয়েছেন। দিশেহারা কর্মীদের মধ্যে ‘দেখে নেওয়ার মানসিকতা’র অভাব থেকেই আঁচ করেছেন, একুশের বিধানসভার চেয়েও বড় ভরাডুবি অপেক্ষা করছে মমতার বঙ্গে। ‘উখারকে ফেক দেঙ্গে’ বললেন বটে কয়েকবার, কিন্তু লোহা যে গরমই হল না। বহুল ব্যবহারে বড্ড ক্লিশে শোনাল পুরনো হিন্দি বাক্যবন্ধটি!
ঠিক ন’বছর পর আবার ধর্মতলায় সিইএসসি’র সদর দপ্তরের বাইরে ২১ জুলাইয়ের স্টাইলে সভা করলেন বিজেপি ও সরকারের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড অমিত শাহ। কিন্তু লোকসমাগম, সভার ঝাঁঝ এবং আবেগ কিছুই পাওয়া গেল না। রেকর্ড বলছে, আগের বার (৩০ নভেম্বর, ২০১৪) ভারতীয় রাজনীতির তথাকথিত চাণক্য ভাষণ দিয়েছিলেন প্রায় ৩৪ মিনিট। আর এবার অপেক্ষাকৃত ফাঁকা ধর্মতলায় আরও বেশি সময় ধরে ঝাঁঝালো বক্তব্য রাখার কথা থাকলেও খুব বেশি আর এগননি। নিজেকে বেঁধে ফেলেছেন তুলনায় ১১ মিনিট কম সময়ে। শুনেছি, নরেন্দ্র মোদি জনান্তিকে একটা কথা প্রায়ই বলেন, কোনও রাজ্যে গেলে একটা ভাত টিপেই সংগঠনের ফাঁকফোকর বলে দিতে পারেন অমিতজি। কোথায় সত্যি হবে, আর কোথায় সময় দিয়েও পদ্ম ফুটবে না, তা তাঁর কম্পাস দিয়ে আঁকা তীক্ষ্ণ চোখে ফুটে ওঠে পরিষ্কার। সেরকম কোনও ইঙ্গিত পেয়েই কি নমো নমো করে ভাষণ শেষ করে রেসকোর্সে ছুটলেন তিনি চপার ধরতে?
আমাদের মনে আছে, এরাজ্যে বামফ্রন্টকে ২০১১ সালে গদিচ্যুত করতে সক্ষম হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তার আগের অন্তত দু’দশক এরাজ্যের রাজনীতি মানুষের আবেগ আন্দোলিত হয়েছে তাঁকে ঘিরেই। তারই ক্লাইম্যাক্স আমরা দেখেছি, ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই। দেখেছি, ব্রিগেডে বামফ্রন্টের ‘মৃত্যুঘণ্টা’ বাজানোর মধ্যে। সমাবেশের উপর গুলি চালিয়ে ১১ জনের প্রাণ নিয়েছিল বামফ্রন্টের পুলিস। উত্তাল হয়েছে রাজ্য। কিন্তু পালাবদলের জন্য তারপরও অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৮ বছর! আর এই বিজেপি নেতারা ভাবেন কী? পাঁচটা শাসক নেতা-মন্ত্রীর বাড়িতে ইডি ঢুকলেই উপর থেকে ফানুসের মতো পরিবর্তন নেমে আসবে রামধনু পাখনা মেলে!
গত বুধবার যাঁরা ধর্মতলায় সকাল থেকে চরকি কেটেছেন, তাঁদের বক্তব্য, অমিতজির ভাষণের আধঘণ্টা আগেও ধর্মতলা, লেনিন সরণি এবং এস এন ব্যানার্জি রোড এদিন প্রায় স্বাভাবিকই ছিল। বিরাট কোনও অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যায়নি। অনেক জায়গায় আগত সদস্যদের জন্য দুপুরের ভাত তরকারির ব্যবস্থা থাকলেও খাওয়ার লোক ছিল না। স্রেফ নষ্ট হয়েছে। জেলা থেকে আবেগতাড়িত কিংবা স্বতঃস্ফূর্তভাবে লোকজন এলে শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশন এবং ধর্মতলার দূরপাল্লার বাস গুমটিতে যে চেহারা দেখা যায়, তাও ছিল অনুপস্থিত। পরিষ্কার হল যে, স্থানীয় নেতৃত্ব যতই লম্বা-চওড়া ভাষণ দিন না কেন, তাঁদের উপর নিচুতলার কর্মীদের আস্থা, বিশ্বাস দুইই কমছে।
বঙ্গ বিজেপির সেই শোচনীয় অবস্থা দেখেই অমিতজিও গুটিয়ে গেলেন। একটাও কি নতুন ঝাঁকুনি দেওয়া বার্তা দিলেন দেশের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা। কেউ বলছেন, পাঁচ রাজ্যের ভোটের প্রচার শেষে তিনি ক্লান্ত। কেউ বলছেন, বঙ্গ বিজেপির হাল দেখে তিনি হতাশ! তাই ডেলি প্যাসেঞ্জারি শুরু করলেও তাঁর বক্তব্যে ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজে সেই আগ্রাসন ছিল না। মমতার সরকারের দুর্নীতি নিয়ে বিজেপির আস্ফালন নতুন কিছু নয়, নয় অপ্রত্যাশিতও। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বারবার ব্যবহারে এবং ভাঁওতা দেওয়ার আখ্যানে সিএএ যে নিছকই ভোটার, বিশেষ করে মতুয়াদের বিরক্তিরই উদ্রেক করবে তা বলাই বাহুল্য। এখানেও দ্বিচারিতা এবং পরস্পর-বিরোধী রাজনীতির মানসিকতা স্পষ্ট। ২০১৯ সালে তখনও এটি বিলই ছিল। এককথায় সিএএ বা সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল। তারপর সংসদে পাশের মাধ্যমে হয়েছে একটি আইন—সিএএ। কিন্তু তারপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেলেও আইনটি কার্যকর হল না কেন? মাত্র কয়েক দিন আগে অদ্ভুত স্তোকবাক্য শোনা গেল। শান্তনু ঠাকুরের সই করা শংসাপত্রই নাকি মতুয়াদের ‘নাগরিকত্বের প্রমাণ’। কৌশলে সস্তায় ভোট কেনার কী বিরাট আয়োজন! মতুয়ারা কিন্তু বছরের পর বছর গেরুয়া নেতাদের মিথ্যে খেলাটা ধরে ফেলেছেন। তাই বুধবার ধর্মতলার জমায়েতে তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ চোখে পড়েনি। বিজেপির দ্বিচারিতার রাজনীতির পাঁকে পড়ে মতুয়ারা আজ যারপরনাই ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। ভোট এলেই নাগরিকত্বের খুড়োর কল ঝোলানোর রাজনীতি আর কতদিন চলবে, তা বোধহয় নেতাদেরও অজানা।
হিসেব বলছে, একুশ সালের শুধু ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসে এরাজ্যে ৩৮টি জনসভা করেন নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ। এর মধ্যে আমাদের সম্মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন ১৭টি সভা আর দলের দ্বিতীয় সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী নেতা অমিত শাহ করেন ২১টি। তারপর বিধানসভা ভোটে ভরাডুবির পর থেকে রাজ্যের সাধারণ কর্মীদের দুর্দশার কালে কতবার ঘুরে গিয়েছেন শাহজি? বিপন্নতার সময় দিল্লি থেকে আর কেউই আসেনি। কলকাতার বুকে ক’টা সভা করেছেন। দলীয় কর্মীদের ক’দিন উৎসাহ দিয়েছেন। রেকর্ডটা কিন্তু মোটেই সুখকর নয়। উল্টে বেশ কয়েকবার আসব আসব বলেও শেষ মুহূর্তে অজ্ঞাত কারণে তাঁর বঙ্গ সফর বাতিল হয়ে যায়। ২৯ নভেম্বর ধর্মতলার সভার আগে অমিতজি এসেছিলেন ১৬ অক্টোবর। এক দলীয় নেতার দুর্গাপুজোর উদ্বোধনে। রামমন্দিরের আদলে প্যান্ডেলের ফিতে কাটতে। কোনও সাংগঠনিক বৈঠকে নয়। এমনকী, তার আগে ইস্টার্ন জোনাল কাউন্সিলের বৈঠকে তাঁর আসার কথা থাকলেও তা শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়। অবশ্য দলের পক্ষ থেকে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখা গিয়েছে। কিন্তু তা নিয়েও তেমন কোনও সাড়া পড়েনি জনমানসে। যেমন পড়েনি গত বুধবারের ধর্মতলার বিশাল আয়োজন ঘিরেও।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা অমিত শাহ বিশাল মাপের নেতা হতে পারেন, হতে পারেন দক্ষ সংগঠক কিন্তু বাঙালির আবেগ, বাঙালির হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে তার কোনও যোগ আছে কি? নেই, সম্মান জানিয়েই বলছি নেই। না-হলে গত একবছরে যেভাবে একের পর এক তৃণমূল নেতা-মন্ত্রী গ্রেপ্তার হয়েছেন, দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে, তাতে অমিত শাহের জনসভায় ঝড়ই ওঠার কথা ছিল। কিন্তু দলের র্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইলই যেখানে দ্বিধায়, বঙ্গ নেতৃত্ব দ্বিধাবিভক্ত, সেখানে হাওয়াই জাহাজে মাত্র দেড় থেকে পৌনে দু’ঘণ্টার বুড়ি ছোঁয়ায় কি বাংলার মানুষের মন জেতা সম্ভব? যেই বিজেপি আঙুল তোলে তৃণমূলের দুর্নীতির দিকে সঙ্গে সঙ্গে দলেই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে এক দলবদলুকে ‘মুখ’ করা হল কেন? তিনি তো তৃণমূলেরই প্রোডাক্ট। তাঁকেও তো ক্যামেরার সামনে হাত পেতে টাকা নিতে দেখা গিয়েছে, জেরা হয়নি কেন? এমন নেতাই মুখ, আর আগমার্কা সঙ্ঘী দিলীপ ঘোষরা দলে ব্রাত্য! নেতৃত্বের এই গোলকধাঁধায় এরাজ্যে বুথ সংগঠনে জোর দেওয়ার কেউ নেই। শুধু মোদি আর অমিতজিকে উড়িয়ে এনে কতটা লাভ হতে পারে, একুশের ফলেই তার প্রমাণ।