যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
সারা দেশে প্রতিদিন আইন তিনটি প্রয়োগ করা হয় শত শত আদালতে। হাজার হাজার বিচারক এবং দেড় লক্ষাধিক আইনজীবী (এঁদের বেশিরভাগই ফৌজদারি মামলার উপর সওয়াল করেন) কার্যত প্রতিদিন এই তিনটি আইনের মাধ্যমে তাঁদের বিচার-বুদ্ধির প্রয়োগ ঘটিয় থাকেন। প্রত্যেক বিচারক বা আইনজীবী জানেন যে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা হল ‘খুনের শাস্তি’র জন্য নির্দিষ্ট। তাঁরা জানেন, সাক্ষ্য আইনের ২৫ ধারায় একজন পুলিস অফিসারের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তি একজন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। তাঁরা আরও জানেন যে, আগাম জামিন এবং জামিনের বিধানগুলি ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৩৭, ৪৩৮ ও ৪৩৯ ধারায় বর্ণিত হয়েছে। এই তিনটি আইনের অসংখ্য ধারা বিচারক ও আইনজীবীরা বস্তুত আত্মস্থ করে রেখেছেন।
হাতছাড়া সংস্কারের সুযোগ
আইনের সংস্কার একটি উত্তম ধারণা। কিন্তু আইনের সংস্কার মানে চালু বিধানগুলির পুনর্বিন্যাস করা কিংবা সেগুলির চেনা ‘নম্বর’ পাল্টে দেওয়া নয়। আজকের দিনে ও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ফৌজদারি আইন কেমন হওয়া উচিত, তার একটি সর্বাত্মক দর্শন থাকতে হবে। আইনকে অবশ্যই হতে হবে পরিবর্তনশীল মূল্যবোধ, নৈতিকতা, আচার এবং আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দেখতে হবে আধুনিক অপরাধ-বিজ্ঞান, ফৌজদারি আইনশাস্ত্র এবং দণ্ড-বিজ্ঞানের ব্যবহার্য বিকাশ যেন নতুন আইনে উপযুক্তরূপে অবশ্যই প্রতিফলিত হয়।
বিধানের পুনর্বিন্যাস
কিন্তু, তিনটি বিলে আমরা কী পাচ্ছি? বিল তিনটি অনেক আইনজ্ঞ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছেন। আমরা দেখতে পেয়েছি যে, আইপিসির ৯০-৯৫ শতাংশ বিধান নতুন খসড়ায় স্রেফ ‘কাট অ্যান্ড পেস্ট’ করে দেওয়া হয়েছে। আইপিসির ২৬টি অধ্যায়ের মধ্যে ১৮টি (তিনটি অধ্যায়ের প্রতিটিতে একটিমাত্র বিভাগ রয়েছে) নতুন বিলে ‘কপি’ বা প্রতিলিপি আকারে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। স্ট্যান্ডিং কমিটির রিপোর্টে স্বীকার করা হয়েছে যে, এই বিলে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৫১১টি ধারার মধ্যে ২৪টি ধারা মুছে ফেলা হয়েছে এবং যোগ করা হয়েছে ২২টি ধারা। বাকি ধারাগুলি রেখে দেওয়া হলেও, নম্বর পাল্টে সাজানো হয়েছে নতুন করে। এই সামান্য কিছু পরিবর্তন আইপিসি সংশোধনীর মাধ্যমে সহজেই করা যেত।
একই কাণ্ড ঘটেছে সাক্ষ্য আইন এবং সিআরপিসির ক্ষেত্রেও। এভিডেন্স অ্যাক্টের ১৭০টি ধারার প্রতিটিই কেটে পেস্ট করা হয়েছে। সিআরপিসির ক্ষেত্রে কাট অ্যান্ড পেস্ট করা হয়েছে মোটামুটি ৯৫ শতাংশ। এই প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণ বৃথা কসরতই বলব। বিলগুলি এরপরও পাস হয়ে গেলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি অপেক্ষা করে থাকবে। শুধু যে কয়েক হাজার বিচারক, আইনজীবী, পুলিস অফিসার, আইনের শিক্ষক ও ছাত্র ভয়ানক অসুবিধার মধ্যে পড়বেন এমনটা নয়, অগণিত সাধারণ মানুষেরও মারাত্মক ভোগান্তি হবে। আইনগুলি ‘পুনরায় শিখতে’ হবে তাঁদের।
বিলগুলির বিষয়বস্তুতে কিছু ‘ওয়েলকাল’ ফিচার রয়েছে—সরকার এগুলিকেই সংসদে হাইলাইট করবে নিশ্চয়। অন্যদিকে আমি তুলে ধরতে চাই বিলের ‘কোশ্চেনেবল’ ফিচারগুলি ৷ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি হল—
বিপরীতমুখী বিধান
মৃত্যুদণ্ড বিলোপের দাবিতে বিশ্বজুড়ে হইচই হওয়া সত্ত্বেও সেটি বহাল রাখা হয়েছে। গত ছ’বছরে সুপ্রিম কোর্ট মাত্র সাতটি মামলায় মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করেছে। প্যারোল ছাড়াই একজনের স্বাভাবিক জীবনের বাকিটা কারাবাসে কাটাবার ব্যবস্থা দোষী ব্যক্তির জন্য সত্যিই আরও কঠোর শাস্তি। অথচ অপরাধীর দিকে তাকিয়ে এটির সংস্কারের সুযোগ নেওয়া হল না।
ব্যভিচার আবার ফিরে এসেছে ‘অপরাধ’ হিসেবে। ব্যভিচার স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার একটি বিষয়। তাঁদের মধ্যেকার ‘চুক্তিটি’ ভেঙে গেলে ক্ষুব্ধ দম্পতির কোনও একজন ডিভোর্স বা সিভিল ড্যামেজের মামলা করতে পারেন। তাঁদের জীবনে রাষ্ট্রের প্রবেশ করার কোনও প্রয়োজন নেই। আইপিসির ৪৯৭ ধারা সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দিয়েছিল। সবচেয়ে খারাপ বিষয় হল যে, সেটিকেই ফেরানো হয়েছে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ হিসেবে।
কারণ নথিভুক্ত না-করে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা কমানোর ‘এগজিকিউটিভ পাওয়ার’ প্রয়োগ হল সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। নির্জন কারাবাস একটি নিষ্ঠুর এবং অস্বাভাবিক শাস্তি। আদালতের কার্যক্রমের উপর মিডিয়া রিপোর্টিংয়ের কিছু ক্ষেত্রে আইনি বাধা আরোপ অসাংবিধানিক। বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন বা ইউএপিএ’র মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপগুলির মোকাবিলা যথেষ্টভাবেই করা যাচ্ছে। তাই এই আইনকে নতুন দণ্ডবিধির আওতায় আনার কোনও প্রয়োজন নেই।
সহকারী দায়রা জজের (অ্যাসিস্ট্যান্ট সেশন জাজ) পদটি তুলে দেওয়া একটি ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ এর ফলে দায়রা জজের উপর ভয়ানক বোঝা চাপবে। প্রথম আপিল গিয়ে হাজির হবে উচ্চ আদালতে। স্বভাবতই হাইকোর্টের উপর বোঝা আরও বেড়ে যাবে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিটি হিংস্র প্রকৃতির হলে কিংবা হেফাজত থেকে তার পক্ষে চম্পট দেওয়ার আশঙ্কা থাকলেই হাতকড়া পরানোর অনুমতি দেওয়া উচিত। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জামিনের জন্য আনা হয়, গ্রেপ্তারের প্রয়োজনীয়তা এবং বৈধতা সম্পর্কে তাঁকে অবশ্যই নিশ্চিত বা সন্তুষ্ট হতে হবে। নতুন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮৭(২) ধারা পুলিস অফিসার এবং বিচারকদের মধ্যে এই বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে যে, একজন গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে অবশ্যই পুলিস হেফাজতে অথবা বিচার বিভাগীয় হেফাজতে পাঠাতে হবে। বিচারপতি কৃষ্ণ আইয়ারের একটি হুঁশিয়ারি মনে করাতে পারি যে, ‘কোনও হেফাজত নয়’-এর মতো তৃতীয় বিকল্পটিকে বিচারকরা উপেক্ষা করেন। ২৫৪ ধারায় তদন্তকারী অফিসারকে অডিও-ভিজ্যুয়াল মোডে জবানবন্দি (ডিপোজিশান) দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর দ্বারা জনসমক্ষে উন্মুক্ত আদালতে নিরপেক্ষ বিচারের নীতি লঙ্ঘিত হয়। ‘জামিনই নিয়ম, জেল ব্যতিক্রম’—নতুন বিল এটি স্পষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার ফলে ধারা ৪৮২-র ভূমিকা পশ্চাৎমুখী।
ম্যাকলি এবং জেমস স্টিফেনের ‘বজ্র’ চুরি করতে চেয়েছিল সরকার। তার বদলে যা করল সে তো চালু আইনের বেশিরভাগ বিধানের টুকলি—স্রেফ কাট অ্যান্ড পেস্ট! আসলে দুই ঔপনিবেশিক আইন রচয়িতার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের মাধ্যমেই শেষ হল মোদি সরকারের আইন সংস্কার!