যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
সমীকরণ বদলেছে। ১০ বছর কম সময় নয়। ২০২৩ সালের মঞ্চে দাঁড়িয়ে কেসিআর নিজেও বুঝতে পারছেন, কুমিরছানার গল্পে আর চিঁড়ে ভেজার নয়। নতুন কিছু চাই। কী সেই নতুন? আস্তিনের ভিতরে-বাইরে তো আছেই সব সময়—সামাজিক প্রকল্প। পরিচিত, পরীক্ষিত এবং যার কোনও মার নেই। কংগ্রেসের চেনানো অস্ত্র, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই পরীক্ষায় সফল, জয়ললিতা এই হাতিয়ারেই বাজিমাত করেছিলেন এবং সবচেয়ে বড় কথা নরেন্দ্র মোদি একে ‘রেউড়ি’ বললেও প্রকল্পের ভরসাতেই ভোটে যাচ্ছেন। কেসিআর তাই আবাসের পাল্টা ‘গৃহলক্ষ্মী’ প্রকল্প বের করেছেন। এতে দলিত পরিবারের মহিলাদের নামে বাড়ি হবে, তাঁরা ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লোন পাবেন এবং সেই টাকা দেবে রাজ্য সরকার। এছাড়াও আছে মিড ডে মিলের পাল্টা ‘ব্রেকফাস্ট স্কিম’। ছেলেমেয়েরা স্কুলে গিয়ে শুধু দুপুরের খাবার পাবে? এ কেমন ব্যাপার? তাই সকালের খাবার কেসিআর দেবেন। তাই এই প্রকল্প। কেসিআর কিট, হরিৎ নিধি... পরিধি অনেকটাই বাড়িয়ে নিয়েছেন তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী। আর আছে মদের দোকানের লাইসেন্স। তেলেঙ্গানায় পাড়ায় পাড়ায় ‘সুরা বিপণি’। চাহিদাও প্রচুর। তাই লোকজন হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে, কবে মিলবে লাইসেন্স। ভোটের মুখে এসে কেসিআর লাইসেন্সের আবেদন জমা নেওয়া শুরু করলেন। মাত্র দু’বছরের জন্য লাইসেন্স। এলাকার জনসংখ্যার উপর নির্ভর করে ফি নেওয়া হবে—৫০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ১০ লক্ষ। আঁতকে ওঠার মতো নম্বর কি? ওখানকার জন্য কিন্তু নয়। কারণ এই দু’বছরের লাইসেন্সের জন্য আবেদন জমা পড়েছে ১ লক্ষ ২৫ হাজার। আর তার থেকে রাজ্য সরকার কামিয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা। প্রতি গলিতে দোকান হবে, মানুষ মদে ডুবে থাকবে, রাজ্যের আয় বাড়বে, আর ভোটে সুবিধাও হবে... এই হল সাদামাটা রাজনীতি। আসলে সব পুকুরে ছিপ ফেলে রেখে দিচ্ছেন কেসিআর। ক্ষমতার মাছটা ধরতেই হবে, যেভাবে হোক। মহাজোট ‘ইন্ডিয়া’র শরিকরা তাঁর উপর খুব একটা ভরসা করেন না। কমবেশি সব দলই মনে করে, বিজেপির সঙ্গে তাঁর আঁতাতটা বেশ গভীর। বিরোধীদের সঙ্গে মিটিং করেই তিনি দিল্লি চলে যেতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর দরবারে। তাই তাঁর থেকে যতটা দূরে থাকা যায়, ততই ভালো। আবার কেসিআর সরাসরি বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়াও বাঁধতে পারেন না। কারণ, তাঁর রাজ্যের লোকজন হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া পার্টিকে খুব একটা পছন্দ করে না। ২০১৪ সালে মোদি হাওয়ায় সারা দেশ ভেসে গিয়েছিল। কিন্তু বিজেপি তেলেঙ্গানার বিধানসভা নির্বাচনে পেয়েছিল মাত্র ৫টি আসন। সে আবার ২০১৮ সালে নেমে এসেছিল মাত্র একটিতে। তাই রাজ্যে অন্তত বিজেপির সঙ্গে জোটে যাওয়া কাজের কথা নয়। এমনিতেই তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির নাম বদলে বিআরএস বা ভারত রাষ্ট্র সমিতি দেওয়ায় রাজ্যে উল্টো ফল হয়েছে। কেসিআর এখন জাতীয় নেতা হতে চান। কিন্তু রাজ্যের মানুষ মুখ্যমন্ত্রীর উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য নিজেদের সেন্টিমেন্ট বিসর্জন দেবে কেন? কেসিআর বুঝেছেন। কিন্তু পরে। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, জাত্যভিমানে ধাক্কা, দুর্নীতির অভিযোগ... এই প্রথম এতটা ব্যাকফুটে কেসিআর। তাই খানিক মরিয়াও। জাতপাতের রাজনীতি তেলেঙ্গানায় ভয়ানক। তফসিলি জাতি-উপজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি, আদিবাসী, খ্রিস্টান এবং মুসলমান মিলিয়ে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ শতাংশ। এক এক জনের জন্য তাই এক এক রকম ভাবতে হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীকে। সবচেয়ে বড় কথা, কেসিআর এবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ভোটে জিতে এলে মুসলিমদের জন্য হায়দরাবাদে আলাদা আইটি পার্ক করে দেবেন। এমনিতে হায়দরাবাদের মূল শহরে ঢুকলে কেসিআর বা তাঁর দলকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সেখানে শেষ কথা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। গত দু’টি বিধানসভা ভোটেই সাতটি করে আসন জিতেছিল তাঁর দল। এই ক’টিতে ‘মিম’-এরই দাপট। তা এবারও থাকবে। তাই এই সাতটি আসন ছেড়েই ভাবতে হয় বাকিদের। কেসিআর এবার ওয়াইসির রাজত্বেও হাত দিতে চাইছেন। কারণ তাঁর কাছে অন্য কোনও উপায় নেই। কেসিআরের ভয় কংগ্রেসকে। অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশে শেষ কথা ছিল কংগ্রেসই। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে ওয়াই এস রাজাশেখর রেড্ডি। দু’বারের মুখ্যমন্ত্রী এবং তুমুল জনপ্রিয়। রহস্যজনকভাবে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। দুই রাজ্যের মানুষই জানে, ওয়াইএসআর থাকলে অন্ধ্র ভাগ হতো না। চরম আপত্তি ছিল তাঁর। ওয়াইএসআরের মৃত্যুর পরই দরজা খোলে রাজ্য ভাগের। জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন কেসিআর। জন্ম নেয় তেলেঙ্গানা। ২০১৩ সালে। কংগ্রেসের উপহার ছিল রাজ্যবাসীকে। সব বাধার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে সোনিয়া গান্ধী নিজে বলেছিলেন, নতুন রাজ্য হোক তেলেঙ্গানা। মানুষের আবেগকে সম্মান জানিয়েছিলেন তিনি। রাজ্যবাসীর থেকে প্রতিদানের অপেক্ষায় আজও বসে আছেন তিনি। দশ বছর কেটে গিয়েছে। ২০১৮ সালের ভোটে ১৯টি আসন জিতেছিল কংগ্রেস। তারপর ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টেছে অনেক। সবচেয়ে বড় কথা, রাহুল গান্ধী পরিবারতন্ত্র এবং ‘রাজবেশ’ ছেড়ে মাটিতে নেমেছেন। ভারত জোড়ো যাত্রা... দেশের উত্তর ভাগে কতটা প্রভাব পড়েছে, সে নিয়ে সন্দেহ থাকলেও রাহুলের যাত্রায় দক্ষিণ ভারত যে নড়েচড়ে বসেছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। আর তার মধ্যে আছে তেলেঙ্গানাও। রাহুল বা কংগ্রেস কিন্তু হাঁকডাক করছে না। নিঃশব্দে জমি তৈরি করেছে তারা। তেলেঙ্গানায় কংগ্রেসের হারানোর কিছু নেই। যা পাওয়া যায়, সেটাই লাভ। কিন্তু যদি বাজি উল্টে যায়? সেই আশা কি একেবারে নেই? ১১৯টি কেন্দ্র তেলেঙ্গানায়। ৬০টি আসন যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য। কংগ্রেস অপেক্ষায় আছে। ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, এমনকী রাজস্থানে তারা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। তেমন তেলেঙ্গানায় না হলেও রাজনীতির সমীকরণ কিছুটা হলেও আশা জোগাচ্ছে কংগ্রেসকে। কেসিআর এবং নরেন্দ্র মোদি—দু’জনেই এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। কেসিআর জানেন, যেভাবে হোক সরকার বিরোধী ভোটটা ভাগ করে দিতে হবে। অর্থাৎ, বিআরএসের বিরুদ্ধে যা ভোট পড়বে, তা যেন শুধুই কংগ্রেসের ঘরে না যায়। তাই তিনি মোদির বিরুদ্ধে তোপ দাগছেন। প্রধানমন্ত্রীও কেসিআরকে তুলোধোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিরোধী ভোটটা ভাগ হয়ে যাক... তাহলে বিআরএস ক্ষমতায় ফিরতে পারবে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না হলেও কুছ পরোয়া নেই। তখন বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গড়তে অসুবিধা হবে না। কেসিআর জেতা মানে বিজেপিরই নৈতিক জয়। এখনকার কৌশলী সমর্থন ভবিষ্যতে রাজ্যসভায় গেরুয়া শিবিরকে ভালো ডিভিডেন্ড দেবে। তাই কংগ্রেসকে আটকাতে হবে। যে কোনও উপায়ে। মাঝে পবন কল্যাণ তো আছেনই। বামপন্থীরা তাঁকে বলছেন, দালাল। কারণ, বিজেপির সঙ্গে টিডিএসের সেতুবন্ধনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তাঁর দল ক’টা আসন পেল, সেটা এখন বড় কথা নয়। তেলুগু দেশম এবং অন্যান্যরা যদি কংগ্রেসের সঙ্গে যোগ দেয়, পুরো সমীকরণটাই মাটি হয়ে যাবে। তাই কিছুতেই কংগ্রেসকে জোট সরকার গড়ার মতো জায়গায় পৌঁছতে দেওয়া যাবে না। কেসিআর, মোদি, পবন কল্যাণ... বৃত্ত সম্পূর্ণ হচ্ছে ধীরে ধীরে। তবে প্রধানমন্ত্রীর দুশ্চিন্তা আরও গভীর। কংগ্রেস যদি উত্তর এবং মধ্য ভারতের সঙ্গে তেলেঙ্গানাতেও ক্ষমতায় এসে যায়, চব্বিশের ভোটের হাল শোচনীয় হতে বেশি সময় লাগবে না। বিজেপির অন্দরে অবশ্য একটা বিশ্বাস আছে— লোকসভা নির্বাচনের অঙ্ক আলাদা। বিধানসভা ভোটের মতো টসে হেরে শুরু করতে হবে না। সেখানে মোদি ফ্যাক্টর আছে। কিন্তু তা কতটা কার্যকর হবে? এটা এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। মোদি অপেক্ষায় আছেন সেমি-ফাইনালের রেজাল্টের। পাঁচটা রাজ্য। পাঁচ রকম চরিত্র। পাঁচটি পরীক্ষা। তিনি জানেন, এবারের বিধানসভা ভোটের প্রভাব লোকসভায় পড়বেই। অপেক্ষায় আছেন সোনিয়া গান্ধীও। রিটার্ন গিফ্টের।