যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
মিজোরামের তিন-তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী জোরাম মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এমএনএফ) সর্বোচ্চ নেতা তথা প্রেসিডেন্ট। এনডিএ-র শরিক তাঁর দল। আশি ছুঁই ছুঁই বয়সেও নির্মেদ, টানটান চেহারা। রোজ নিয়ম করে ঘাম ঝরান। ঘড়ি ধরে দেড়-দু’ঘণ্টা ব্যাডমিন্টন খেলেন। আজও। এক সময় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন জঙ্গলে কাটিয়েছেন বছরের পর বছর। আবার পরবর্তী জীবনে সেই তিনিই রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদে বসেছেন। ভারতের দূত হিসেবে নানা গোপন মিশনেও অংশ নিয়েছেন। বহু জঙ্গি সংগঠন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে ভারত সরকারের শান্তি আলোচনায় তাঁকে মিডলম্যান হিসেবেও দেখা গিয়েছে। কখনও প্রকাশ্যে। কখনও আবার পর্দার আড়ালে। জোরামথাঙ্গার মতো দেশের আর কোনও মুখ্যমন্ত্রীর বায়োডাটা এতটা বর্ণময় নয়।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জোরামথাঙ্গা নিজেই জানিয়েছিলেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে বহুবার তিনি গোপনে মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে গিয়েছেন। সে সব দেশে সক্রিয় বিভিন্ন ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আলোচনার টেবিলে আনার চেষ্টাও চালিয়েছেন। এমনকী প্রতিবেশী বাংলাদেশেও পুরনো সুসম্পর্কের সুবাদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া— দু’জনের সঙ্গেই সরাসরি টেলিফোনে কথা বলার ক্ষমতা রাখেন তিনি। বলেওছেন বহুবার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চোখ বন্ধ করে দেশের হাতেগানা যে কয়েকজন রাজনীতিবিদকে ভরসা করেন বলে শোনা যেত, জোরামথাঙ্গা সেই তালিকায় অন্যতম।
জোরামথাঙ্গা বলেছিলেন, মায়ানমার সরকারের সম্মতি নিয়েই ২০১৮ থেকে ২০২০-র মধ্যে বিমানবাহিনীর বিশেষ এয়ারক্র্যাফটে চেপে মায়ানমারের ভিতরে বহু ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ গোষ্ঠীর ডেরাতেও গিয়েছিলেন। সঙ্গে ভারত সরকারের প্রধান ‘ট্রাবলশ্যুটার’ অজিত দোভাল। ‘আমরা জানি মায়ানমারের কাচিন, কারেন, শান, আরাকান, চিন হিলস— সর্বত্র সশস্ত্র গোষ্ঠীদের সঙ্গে সেনার সংঘর্ষ চলছে। তার কোনও কোনওটার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ভারতেও। তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যাতে সরকারের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসানো যায়, সেটাই ছিল মূল লক্ষ্য। আর আমরা নেগোশিয়েশন করছিলাম মূলত কাচিন আর চিনদের সঙ্গে। নেপিদোতে না-হলে ব্যাঙ্ককে বা দিল্লিতে যাতে এই শান্তি বৈঠক হতে পারে— তার জন্যও কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২০২১-র পয়লা ফেব্রুয়ারি মায়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান সেই সব হিসেব-নিকেশই উল্টে দেয়। শান্তি-আলোচনার উদ্যোগ ভেস্তে যায়, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে পুরোদস্তুর আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। নিজে যেহেতু বহুদিন আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন কাটিয়েছি, তাই এদের সঙ্কট, এদের চাওয়া-পাওয়াটা আমি বুঝি।’ বেশ আক্ষেপের সুরেই বলেছিলেন জোরামথাঙ্গা।
১৯৬৬ সালের, ২৮ ফেব্রুয়ারি। স্বাধীন মিজোরামের কথা ঘোষণা করেছিলেন লালডেঙ্গা। এরপর কখনও মিজো গ্রামে, কখনও জঙ্গল-যু্দ্ধ। ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পরে লালডেঙ্গা-জোরামথাঙ্গারা পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। সেই সময় থরে-থরে রাইফেল, মেশিনগান মিজো গেরিলাদের হাতে তুলে দিয়েছিল পাক সেনাকর্তারা। পাক কমান্ডোরা ভারতীয় বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও, আরাকানের জঙ্গল হয়ে পালান জোরামরা। পৌঁছে যান চীনে। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে, পাকিস্তান ও চীনের অস্ত্রের বলে বলীয়ান হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে বিশ বছর লড়াই করেছিলেন। সেই রোমহর্ষক কাহিনি নিজের আত্মজীবনীতেও লিখেছেন জোরাম। সেই জোরাম আজ মায়ানমার ও মণিপুরে চলা সংঘর্ষের জেরে মিজোরামে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের বুকে টেনে জো-চিন-কুকিদের ‘মসিহা’ হয়ে উঠেছেন। কেন্দ্রের চোখ রাঙানির তোয়াক্কা না করে নিজের বিপ্লবী সত্ত্বাও উস্কে দিয়েছেন। হাজার হাজার শরণার্থীকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। নিজেদের সাধ্যমতো তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। জোরামথাঙ্গার কথায়, ‘এদের সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক, এটা আপনাকে বুঝতে হবে। ব্রিটিশরা ভাগ করার আগে আমরা সবাই একই ভূখণ্ডে ছিলাম। আজ যেটা মিজোরাম, মায়ানমারে যেটা চিন হিলস এবং এখন যেটা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম— এই সব জায়গাতেই আমরা থাকতাম। ঐতিহাসিক কারণে আমাদের মধ্যে হয়তো সীমান্তের বিভেদ তৈরি হয়েছে, কিন্তু মিজো আর চিন-রা আসলে একই জাতিগোষ্ঠীর।’
১৮৯২ সালের জানুয়ারিতে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রাজধানী কলকাতায় বাংলার তৎকালীন ছোটলাটের সভাপতিত্বে সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। আগামী দিনে বাংলা, অসম আর বার্মার সীমান্তঘেঁষা চিন-লুশাই হিলসের প্রশাসনিক রূপরেখা কী হবে, সেটা স্থির করাই ছিল ওই বৈঠকের প্রধান উদ্দেশ্য। ওই অঞ্চলে বসবাসকারী কুকি-চিন-মিজো গোষ্ঠীর সঙ্গে ব্রিটিশদের ততদিনে অন্তত পাঁচটি যুদ্ধ হয়ে গিয়েছে, আরও তিনটি হওয়ার অপেক্ষায়। কলকাতার সেই ‘চিন-লুশাই কনফারেন্সে’র পরই স্থির হয়েছিল, এই জাতিগোষ্ঠীর বাস যে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে, তা তিনটি ভাগে ভাগ করে দেওয়া হবে। চিন হিলস বার্মার, লুশাই হিলসের দক্ষিণভাগ বাংলার আর উত্তরভাগ অসমের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ফলে যে কুকি, চিন ও মিজোরা নিজেদের একই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের লোক বলে মনে করেন, তাদের মধ্যে সীমান্তের বিভেদ তৈরি হয়ে গিয়েছিল ১৩০ বছর আগেই। নৃতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা ওই জাতিগোষ্ঠীগুলিকেই একত্রে ‘জো’ বলে থাকেন। আজ জো-দের চিরাচরিত বাসভূমির বুক চিরে গিয়েছে তিনটি দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা। গত দু-আড়াই বছরের মধ্যে ওই অঞ্চলে এমন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে যা তিন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ‘জো’-দের আবার কাছাকাছি এনেছে। আর তার ‘এপিসেন্টার’ হয়ে উঠেছে মিজোরাম।
মায়ানমারের চিন স্টেটে সেনা নির্যাতনের জেরে ওই প্রদেশ থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার শরণার্থী গত কয়েক বছরে মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়া নিয়েই মোদি সরকারের সঙ্গে জোরামথাঙ্গার প্রথম সংঘাত শুরু হয়। ২০২১ সালের গোড়ায় যখন মায়ানমার থেকে মিজোরামে শরণার্থীর ঢল নামে, জোরামথাঙ্গার সরকার তাদের সাদরে স্বাগত জানিয়েছিল। রাজ্যের মিজোরা মায়ানমার থেকে আসা তাদের চিন ভাইবোনদের মাথার উপর ছাদ, দু’বেলার খাবারদাবারের ব্যবস্থা করেছিল। রাজ্যের নানা প্রান্তে রাতারাতি গড়ে তোলা হয়েছিল অজস্র শরণার্থী শিবির। প্রথম দিন থেকেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বলে এসেছে এদের ‘পুশব্যাক’ কর। জোরামথাঙ্গা বলেছিলেন, ‘এদের সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক, আমি কিছুতেই তাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারব না।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে জোরামথাঙ্গার সম্পর্ক শীতল হতে শুরু করেছিল তারপর থেকেই।
ভিটেহারা এই মানুষগুলিকে শরণার্থীর স্বীকৃতি দিতে নয়াদিল্লির ‘প্রবল কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অসুবিধা’ রয়েছে। মায়ানমারকে বয়কট করে কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে ভারতের কোনও লাভ হবে না। উল্টে মায়ানমারের ভিতর দিয়ে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট বা কালাদান জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো যে সব প্রকল্পে ভারতের শত শত কোটি টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে, সেগুলি আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তার উপর রয়েছে চীনের দাপট। ফলে মায়ানমারে গণতন্ত্র থাক বা সামরিক শাসন— নিরাপত্তার স্বার্থেই ভারতের পক্ষে নেপিদোকে চটানো চলবে না। একইভাবে ঢাকার সঙ্গে সম্পর্কে কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে বলেই চট্টগ্রামের কুকি-চিনদের শরণার্থী বলে স্বীকার করা দিল্লির পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রশ্ন হল, এর প্রভাব কতটা পড়েছে মিজোরামের রাজনীতিতে। জোরামথাঙ্গার দল মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএফ) এনডিএ শরিক হলেও, বিধানসভা ভোটে বিজেপির সঙ্গে জোট করেনি। বিজেপির সঙ্গে ক্রমশ দূরত্ব বাড়াচ্ছে এমএনএফ। তার অন্যতম কারণ অবশ্যই শরণার্থী সমস্যা। এই প্রশ্নে জোরামথাঙ্গা একেবারে মোদি সরকারের উল্টো নীতিতে বিশ্বাসী। বারবার তা স্পষ্টও করে দিয়েছেন। জোরাম একাধিকবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও মোদি সরকার শরণার্থীদের জন্য একটি পয়সাও খরচ করেনি। ফলে জোরামের ক্ষোভ বেড়েছে। মণিপুর পরিস্থিতিতে ওই রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের সঙ্গেও তরজাতে জড়িয়ে পড়েছেন। মিজো-কুকি-চিন সৌভ্রাতৃত্বের ডাকে আইজলে বিশাল মিছিলে পা মিলিয়ে হেঁটেছেন। শুধু তাই-ই নয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গোটা দেশজুড়ে যে ইউনিফর্ম সিভিল কোড (ইউসিসি) বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রবর্তনের ডাক দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধেও গর্জে উঠেছেন জোরামথাঙ্গা। বলেছেন, ‘মোদি সরকার যদি মিজোরামে ইউসিসি চালু করার চেষ্টা করে তাহলে এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে দ্বিধা করব না।’ অনেকেই মনে করছেন, এটা আসলে ‘মিজো সাবন্যাশনালিজম’-কে উস্কে দিতে জোরামথাঙ্গার ‘পলিটিক্যাল পশ্চারিং’ বা রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা। বস্তুত তিন দেশজুড়ে কুকি-চিন-মিজোদের সঙ্গে যা ঘটছে, সেই নির্যাতন আর বঞ্চনার অভিঘাতেই যে ‘জো’ জাতীয়তাবাদের রাজনীতি নতুন খাতে বইতে চলেছে তা কিন্তু স্পষ্ট।
তাতে বড় ধাক্কা খাবেন মোদি-অমিত শাহ। ভরসা বলতে একমাত্র সেই অজিত দোভাল— যাঁর হাত ধরে একসময় জঙ্গি শিবির ত্যাগ করেছিলেন জোরামথাঙ্গা!