যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
বিজেপি নেতৃত্ব মনে করছে, চব্বিশের নির্বাচনে রামমন্দিরই হবে তাদের তুরুপের তাস। তাই ভেবেচিন্তেই নির্বাচনের মুখে ঠিক করা হয়েছে মন্দির উদ্বোধনের দিন। রামমন্দিরকে ঘিরে দেশজুড়ে উন্মাদনা তৈরির জোরদার চেষ্টা চলছে। নেওয়া হয়েছে বাড়ি বাড়ি রামলালার ছবি ও প্রসাদ পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি। উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত সহ বিজেপি শাসিত রাজ্যে রামমন্দির নিয়ে সাড়া মিললেও বাংলায় তেমনটা নেই। এখানে বিজেপির প্রায় কোনও কর্মসূচিই সফল হচ্ছে না। কারণ কর্মীর অভাব। সোশ্যাল মিডিয়া আর টিভি নির্ভর রাজনীতির এটাই ‘সাইড এফেক্ট’।
একুশের নির্বাচনের পর থেকেই বাংলার গেরুয়া শিবির ক্ষয়রোগে ভুগছে। সুকান্ত মজুমদার দায়িত্ব নিয়ে তা রোধ করতে পারেননি, উল্টে বেড়ে গিয়েছে। কারণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। দিলীপ ঘোষের অনুগামীরা দলে গুরুত্ব পান না। ফলে অনেকেই অভিমানে বসে গিয়েছেন। অনুপম হাজরা কেন্দ্রীয় সম্পাদক হওয়ার পর বিজেপির কোণঠাসা কর্মীরা কিছুটা হলেও অক্সিজেন পেয়েছেন। তাঁরাও নেমেছেন দলে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। তাতে আদি-নব্যের মারামারি নেমে এসেছে রাস্তায়। সামনে নির্বাচন।
তাই দিল্লি বিজেপি কোনও পক্ষকেই চটাতে সাহস পাচ্ছে না। আর তাতে অশান্তি উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।
বাংলায় দিল্লির নেতাদের ডেলি প্যাসেঞ্জারিটা ছিল সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু সেটা একেবারে প্রধানমন্ত্রীকে সামনে রেখে! তাও আবার শুরু হচ্ছে ব্রিগেড দিয়ে। যাকে বলে, ডাবল ধামাকা। একুশের নির্বাচনের আগেও ব্রিগেডে সভা করেছিলেন মোদি। বাঙালি আবেগ কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে মিঠুন চক্রবর্তীকে তোলা হয়েছিল মঞ্চে। তবে, তখন বাংলার পরিস্থিতি ছিল অন্যরকম। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের তোলা হাওয়া দেখে সাধারণ মানুষ তো বটেই, তৃণমূলের নেতারাও অনেকে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ ঝাঁপ দেওয়ার জন্য পাঁচিলে উঠে বসেছিলেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেন্দ্রীয় এজেন্সির আক্রমণ আরও বেড়েছে। একের পর এক নেতা মন্ত্রীকে জেলে ভরেছে। তবুও অটুট ঘাসফুল শিবির। ভাঙন তো দূরের কথা, উল্টে গেরুয়া শিবিরের নেতা, বিধায়করা তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন।
এই অবস্থায় একক শক্তিতে ব্রিগেডে সভা করার হিম্মত বঙ্গ বিজেপির নেই। তাই এমন সব সংগঠনকে যুক্ত করেছে, যাদের কিছু নিজস্ব অনুগামী বা ভক্ত আছে। বঙ্গ বিজেপি তাদের সামনে রেখে লোকজন জড়ো করে ক্ষমতা জাহির করতে চাইছে। গীতাপাঠের অনুষ্ঠানের জেরে বাংলায় ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি হবে কি না, সেটা বলবে সময়।
তবে, এই কর্মসূচির ফলে সুকান্তবাবুর চেয়ারটা আপাতত বেঁচে গেল।
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, গীতাপাঠের অনুষ্ঠানের পিছনে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। সুকান্তবাবুর সঙ্গে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলেন। তবুও তাঁরা নাকি অরাজনৈতিক ও নিরপেক্ষ! তার প্রমাণেও তাঁরা মরিয়া। তাই শুধু প্রধানমন্ত্রীকেই নয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও ব্রিগেডে আমন্ত্রণ জানাবেন।
অনেকে বলছেন, এই আমন্ত্রণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আসল ট্যুইস্ট। মুখ্যমন্ত্রী গীতাপাঠের আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন কি না, তা এখনও জানা যায়নি। যদি ব্রিগেডের গীতাপাঠের অনুষ্ঠানে যান তাহলে তাঁকে বসতে হবে একঝাঁক বিজেপি নেতার পাশে। সেটা তিনি কিছুতেই চাইবেন না। আর তিনি অনুষ্ঠানে না গেলেই তাঁর গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হবে হিন্দু-বিরোধী তকমা। শুরু হয়ে যাবে প্রচার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গীতা মানেন না। সংখ্যালঘুরা চটে যাবে, তাই হিন্দু সাধু সন্ন্যাসীদের গীতাপাঠের অনুষ্ঠানে তিনি গেলেন না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সংখ্যালঘু তোষণকারী বানাতে চাইছে বিজেপি। অন্যদিকে তাঁকে ও বিজেপিকে এক আসনে বসানোর জন্য আদাজল খেয়ে নেমেছে সিপিএম ও বঙ্গ কংগ্রেস। তারজন্য কেউ কেউ দীঘায় জগন্নাথ দেবের মন্দির নির্মাণের প্রসঙ্গটিও সামনে আনছেন। সরকারি টাকায় মন্দির নির্মাণ নিয়ে বিতর্ক জওহরলাল নেহরুর আমলে হয়েছে, এখন হচ্ছে, আগামী দিনেও থাকবে। কিন্তু সেই মন্দির প্রতিষ্ঠার পিছনে উদ্দেশ্য যদি হয় পর্যটকদের আকৃষ্ট করা, তাহলে সেটা কি খুব অন্যায়?
কয়েকদিন আগে কথা হচ্ছিল পুরী ঘুরে আসা এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে। কথায় কথায় তিনি বললেন, দীঘায় জগন্নাথ দেবের মন্দির হচ্ছে শুনে পুরীর অটোচালক থেকে হোটেল মালিক, সকলেই বেশ চিন্তিত। কারণ প্রতি বছর প্রচুর বাঙালি পর্যটক পুরী যান। মূলত বাংলার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে পুরীর পর্যটন ব্যবসা। সেই পর্যটকদের একটা অংশ পুরীর বদলে দীঘায় ভিড় জমালেই তাঁদের ব্যবসা মার খাবে। পাশাপাশি জমে যাবে দীঘার মার্কেট। পুরীর ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা যদি সত্যি হয়, তাহলে বাংলায় এমন মন্দির আরও হওয়া দরকার।
তবে এটা ঠিক, বাংলাতেও ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির ট্রেন্ড ঊর্ধ্বমুখী। সিপিএমের আমলে ধর্ম নিয়ে এত রাজনীতি হতো না। অবশ্য তার কারণও আছে। বাম আমলের বেশিরভাগ সময়টাই দিল্লিতে ছিল কংগ্রেস সরকার। আর বিজেপি যখন ছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ি। তিনি সবসময় ধর্ম অপেক্ষা রাজধর্মকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি হাঁটেন তাঁর উল্টো পথে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব ভালো করেই জানেন, লোহা কাটতে গেলে লোহারই দরকার হয়। তাই তিনি বিজেপিকে মাঠ ছেড়ে দেননি। বিশেষ কোনও ধর্মকে আঁকড়ে না ধরলেও তাকে অচ্ছুৎ করে দেননি। তিনিও বামেদের মতো ধর্মকে আফিম মনে করে নাক সেঁটকালে হিন্দুত্বের ঠিকাদারি চলে যেত বিজেপির হাতে। সেটা করেননি বলেই এরাজ্যে ভোট ধর্মের ভিত্তিতে নয়, হয় সরকারের কাজের নিরিখে।
ভুল করলে শাস্তি দেয়। ভালো কাজের জন্য আশীর্বাদ করে দু’হাত তুলে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্রিগেডে লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠ কি গেরুয়া শিবিরকে সুবিধা দেবে? বিজেপির অনেকে বলছেন, এতে দলের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। তাঁদের বক্তব্য, হায়দরাবাদে বিজেপির দলের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে সংখ্যালঘুদের কাছে টানার পরামর্শ দিয়েছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেছিলেন, ‘সংখ্যাগুরু হিন্দুদের পাশাপাশি সংখ্যালঘুদেরও কাছে টানতে হবে। বিশেষ করে গরিবদের অভাব অভিযোগ শুনতে হবে। তাদের পাশে থাকতে হবে।’
কেন সংখ্যালঘুদের পাশে টানার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী? বিজেপি নেতৃত্ব উপলব্ধি করেছিল, শুধু হিন্দু ভোটের উপর নির্ভর করলে ক্ষমতায় ফেরা যাবে না। কারণ অনেক চেষ্টা করেও হিন্দুভোট এককাট্টা করা যায়নি। তাই নরেন্দ্র মোদির ফের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য সংখ্যালঘু ভোটের সমর্থন লাগবে। বিশেষ করে বাংলা, কেরল সহ কয়েকটি রাজ্যে।
নরেন্দ্র মোদির পরামর্শের পর সেই প্রক্রিয়াও বিজেপিতে শুরু হয়েছিল। বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির সংখ্যালঘু নেতারা স্লোগান তুলেছিলেন, ‘না দুরি না খাই হ্যায়, মোদি হামারা ভাই হ্যায়’। অর্থাৎ আমাদের মধ্যে কোনও দূরত্ব বা বিভেদ নেই। মোদি আমাদের ভাই। বাংলাতেও সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।
তাতে পঞ্চায়েত ভোটে কিছু সংখ্যালঘু এলাকায় সাফল্যও পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু লোকসভা ভোটে তাদের আর ধরে রাখা যাবে না। ব্রিগেডে সাধুসন্ন্যাসীদের মাঝে প্রধানমন্ত্রীকে গীতাপাঠ করতে দেখলে মুসলিমরা মুখ ফিরিয়ে নেবে। আরও বেশি করে বিজেপি বিরোধী হয়ে যাবে।
উদ্যোক্তা থেকে বিজেপি নেতৃত্ব একযোগে দাবি করেছে, ব্রিগেডের গীতাপাঠের অনুষ্ঠানের সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। না থাকারই কথা। কারণ পবিত্র গীতাও ফলের আশা না করে কর্ম করার উপদেশ দিয়েছে। মহাভারতে যুধিষ্ঠিরও বলেছেন, ‘আমি কর্মফলান্বেষী হইয়া কোনও কর্ম করি না, দান করিতে হয়, তাই দান করি, যজ্ঞ করিতে হয়, তাই যজ্ঞ করি, ধর্মাচরণের বিনিময়ে যে ফল চাহে, সে ধর্মবণিক, ধর্মকে সে পণ্যদ্রব্য করিয়াছে।
সে হীন, জঘন্য।’
লোকসভা নির্বাচনের মুখে ব্রিগেডে ঘটা করে গীতাপাঠ। প্রধান পুরোহিত প্রধানমন্ত্রী। তাই উঠছে প্রশ্ন, বিজেপি ধার্মিক, না ধর্মবণিক?