যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
আসলে কেন্দ্রের মোদি সরকারের পায়ের তলা থেকে যত মাটি সরে যাচ্ছে, যত বিজেপি সরকারের বিদায়বেলা আসন্ন হচ্ছে, ততই তারা সিবিআই, ইডি, রাজ্যপালদের অস্ত্র হিসাবে আঁকড়ে ধরে বিরোধীদের টাইট দেওয়ার কাজ করছে। আর কেন্দ্রের সমস্ত নির্দেশ বিরোধী রাজ্যের ছোটলাটরা বিনা বাক্যবায়ে নতমস্তকে পালন করছেন। এইসব ‘ইয়েস স্যার’ মার্কা জো হুজুর রাজ্যপালরা চিরকাল গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের জন্য দায়ী। প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল এন রবিকে প্রশ্ন করেছেন, তিন বছরেও রাজ্যপাল বিলগুলোতে সম্মতি দিতে পারলেন না কেন? তাঁর কাছে আটকে আছে ১২টি বিল। কেরলের রাজ্যপাল মহম্মদ আরিফ খান আটকে রেখেছেন সাতটি বিল। পাঞ্জাবের রাজ্যপাল বনোয়ারিলাল শুধু বিল আটকেই রাখেননি, তিনি রাজ্য বিধানসভার বাজেট অধিবেশন চালু করার অনুমতি দিতেও অস্বীকার করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে একাধিক বিল আটকে রেখে বারবার রাজ্য সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতার প্রমাণ দিয়েছেন বর্তমান রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। তাঁর পূর্বসূরি জগদীপ ধনকার মহাশয়ও তো রাজ্য সরকারের সঙ্গে তুমুল বিরোধিতার বাতাবরণ সৃষ্টি করে পুরস্কৃতও হয়ে গেলেন। আনন্দবাবু আবার উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে আগ বাড়িয়ে খেলতে গিয়ে ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি করেছেন। সংবিধান বলছে, বিল নিয়ে রাজ্যপালরা প্রশ্ন তুলতে পারেন, ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। কিন্তু অনির্দিষ্টকালের জন্য বিল আটকে অচলাবস্থার সৃষ্টি করতে পারেন না। ঠিক এই মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত রাজ্যপালদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, ‘আপনারা কিন্তু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নন, মনোনীত পদাধিকারী মাত্র। তাই কথায় কথায় রাজ্যের সঙ্গে এভাবে বিরোধ করতে পারেন না।’ সুতরাং রাজ্যপালদের কাজকর্ম আজ কাঠগড়ায় প্রশ্নের মুখে!
অতীতেও বহুবার এমন ঘটনা ঘটেছে। আসলে কেন্দ্রের সব সরকারই চায় বিরোধী রাজ্যকে একটু টাইট দিতে। সেক্ষেত্রে তারা অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে রাজ্যপাল নামক চেয়ারটি। ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ধরমবীর প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ভেঙে দিয়েছিলেন। সেই সময় শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত তাঁর একটি উত্তর সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, ‘সংবিধান রচয়িতারা কি রাজ্যপালকে মোঘল সম্রাট বানাতে চেয়েছিলেন?’ সেই ব্যবস্থা কিন্তু এখনও চলছে। কেন্দ্রের ইশারায় আস্তিন গুটিয়ে রাজনৈতিক খেলায় নেমে পড়ার অগণতান্ত্রিক অভ্যাস এখনও রাজ্যপাল পদটিকে কলঙ্কিত করে চলেছে। ১৯৭৭ সালে এখানে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে ফের নতুন করে রাজ্যপালের সঙ্গে সঙ্ঘাত শুরু হয়। বি ডি পান্ডে এখানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তাঁর কাজের জন্য বামফ্রন্ট সরকারের সমালোচনার শিকার হতে থাকেন। সেই সময় সিপিএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা প্রমোদ দাশগুপ্ত তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘বাংলা দমন পান্ডে’। এরপর ১৯৮৪ সালে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপাল হয়ে আসেন অনন্ত প্রসাদ শর্মা। সেই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে কী তীব্র মনোমালিন্য হয়েছিল, তা অনেকেই জানেন। সেদিন রাজ্যপাল মনোনীত উপাচার্য সন্তোষ ভট্টাচার্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট বন্ধ করে তাঁর কাজে দিনের পর দিন বাধা দিয়েছিল সিপিএম। উপাচার্যকে নিগৃহীত করা হয়েছিল কয়েকবার। আজকের কচি সিপিএম নেতাদের অনেকেই সেদিন জন্মাননি। তাই এইসব ইতিহাস তাঁদের অজানা। সেই ইতিহাস না জেনে আজ অনেক সিপিএম নেতাই মমতা জমানায় রাজ্যপালের সঙ্গে সঙ্ঘাত দেখে বোকার মতো খিল্লি খাচ্ছেন আর সোশ্যাল মিডিয়ায় বিপ্লব করছেন। এইসব নেতারা বোধহয় জানেন না, একসময় বামফ্রন্ট সরকার সারকারিয়া কমিশনে একটি চিঠি পাঠিয়ে বলেছিল, ‘রাজ্যপাল পদের প্রয়োজন নেই।’
আসলে রাজ্যপাল পদটাকে কেন্দ্র চিরকালই চরবৃত্তির কাজে ব্যবহার করে। মূলত ইন্দিরা গান্ধীই এই সংস্কৃতি চালু করেছিলেন। রাজ্যে বিরোধী সরকার থাকলেই অসহযোগিতা করে রাজ্যের মানুষের কাছে তার ভাবমূর্তি নষ্ট করার এই ছক অতি পুরনো। সেই ‘বিমাতৃসুলভ আচরণ’কে নরেন্দ্র মোদি সরকার নিয়ে গেল শিল্পের পর্যায়ে। প্রতিটি বিরোধী রাজ্যে রাজভবনকে রাজ্যপালরা অলিখিতভাবে করে তুললেন বিজেপির পার্টি অফিস। রাজ্যের বিশিষ্ট গেরুয়া নেতাদের নির্দেশ মেনে তাঁদের কাজ চালানোর অর্ডার এল কেন্দ্রের কাছ থেকে। আরও বড় পুরস্কারের লোভে অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধান পদক্ষেপ করতে থাকলেন রাজ্যপালরা। সকলেই হয়ে উঠতে চাইলেন এক একজন ‘মোঘল সম্রাট’। পাশাপাশি নানাভাবে বিরোধী রাজ্যগুলিকে বিব্রত করে ভাতে মারার ছক কষা তো চলছেই।
বারবার দেখা যাচ্ছে, আইনসভাগুলি সুষ্ঠুভাবে চালাতে রাজ্য যে বিল আনছে বা সিদ্ধান্তগ্রহণ করছে, রাজ্যপালরা তা আটকে রেখে অকারণে সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি করছেন। তাঁরা ভুলেই যাচ্ছেন, তাঁরা একজন মনোনীত সদস্য মাত্র, নির্বাচিত নন। কিন্তু দেখা যায়, সরকার তাঁদের এমন পাম্প দিয়ে বিভিন্ন বিরোধী রাজ্যে পাঠান যে, তাঁরা নিজেদের মনে করেন, হাম সে বড়কর কৌন! তখনই সমান্তরাল প্রশাসন চালানোর উদ্যোগ নিয়ে তাঁরা অকারণ জটিলতার সৃষ্টি করেন। প্রশ্ন জাগে, সংবিধানের সীমা লঙ্ঘনের বিষয়টা কি তাঁরা বিস্মৃত হন?
রাজ্যপাল পদে নিয়োগ নিয়ে দু’টি রীতি চালু ছিল। একটি হল, কোনও রাজ্যের বাসিন্দা সেই রাজ্যের রাজ্যপাল হতে পারবেন না। দ্বিতীয়টি হল, রাজ্যপাল পদের নিয়োগ নিয়ে রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা করতে হবে, যাতে দু’পক্ষের সম্মিলিত একটা বোঝাপড়ার ভিত্তিতে রাজ্যপালের নিয়োগ হয়। পরবর্তী ক্ষেত্রে দেখা যায়, এই দু’টি রীতিই লঙ্ঘিত হয়েছে। ১৯৫১ সালে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপাল হয়েছিলেন হরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, কিংবা পরবর্তীকালে ১৯৬৫ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল হন করণ সিং এবং পাঞ্জাবের রাজ্যপাল হন উজ্জ্বল সিং। এঁরা প্রত্যেকেই সেই রাজ্যের বাসিন্দা ছিলেন।
আর রাজ্যের সঙ্গে সৌহর্দ্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে রাজ্যপাল নিয়োগের পাট চুকে গেছে একেবারে গোড়াতেই। কেননা কেন্দ্র সরকার বারবার রাজ্যপালকে রাজ্যের বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে। প্রথম দিকে কেন্দ্র কিংবা রাজ্যে কংগ্রেসই ক্ষমতায় ছিল, তখন এই দ্বন্দ্ব বোঝার তেমন উপায় ছিল না। কিন্তু কেন্দ্র এবং রাজ্যের শাসক দল পৃথক হলেই দ্বন্দ্ব তুমুল আকার নিয়েছে। ১৯৬৭ সালে পাঞ্জাবে অকালি দল ক্ষমতায় আসতেই দ্বন্দ্বের শুরু। কেন্দ্র রাজ্যপাল পদের জন্য দু’টি নাম তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী গুরনাম সিংয়ের কাছে পাঠায়। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, এই দু’জনের কাউকেই রাজ্যপাল পদে তিনি চান না। কেন্দ্র তা মানতে অস্বীকার করে এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে ধরমবীরকে সরিয়ে পাঞ্জাবে অভিষিক্ত করা হয়। বিহারের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী মহামায়া প্রসাদ সিনহা রাজি না হলেও জোর করে নিয়োগ করা হয়েছিল রাজ্যপাল নিত্যানন্দ কানুনগোকে।
আটের দশকের পর থেকে যখন আঞ্চলিক দলগুলি ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগল, সঙ্ঘাতটা বেড়ে গেল তার পর থেকেই। কেন্দ্রের মূল উদ্দেশ্যই হয়ে দাঁড়াল নানাভাবে বিরোধী রাজ্যগুলিকে টাইট দেওয়া। এই কাজে কেন্দ্রের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠলেন রাজ্যপালরা। তখন থেকেই রাজভবন হয়ে উঠল ষড়যন্ত্রের আখড়া। কতবার যে রাজ্যপালরা গণতান্ত্রিক সরকারকে অগণতান্ত্রিক উপায়ে ফেলে দিয়েছেন, সেই সব গোপন ষড়যন্ত্র নিয়ে আস্ত একটা বই লেখা যাবে।
পরবর্তীকালে সারকারিয়া কমিশন রাজ্যপাল নিয়োগ নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব দেয়। কমিশন বলে, কোনও রাজ্যের রাজ্যপাল হিসাবে কাউকে পাঠানো হলে, রাষ্ট্রপতির উচিত সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া। রাজ্যপালের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, সেই সম্পর্কে অনেকগুলি প্রস্তাব সারকারিয়া কমিশন দিয়েছে। তার মধ্যে দু’টি হল, রাজ্যপালকে কোনওভাবেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলে চলবে না এবং রাজ্যের কোনওরকম রাজনৈতিক ব্যাপারে তাঁর নাকগলানো অনুচিত।
কিন্তু আমরা কী দেখছি! মোদি সরকারের আমলে বিরোধী রাজ্যের রাজ্যপালরা প্রত্যেকেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন। রাজনৈতিক নেতাদের মতো তাঁরা আচরণ করছেন।
সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ কতটা গভীর, তা বোঝা যায়। আসলে কোণঠাসা মোদি সরকারের এখন ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। রাজ্যপালদের কাঠপুতলি বানিয়ে এখন শেষ পারানির কড়ি সংগ্রহের মরিয়া চেষ্টা করছেন মোদি। কিন্তু তা যে আর সম্ভব নয়, তা নির্বাচনের মাস চারেক আগে থেকে জনগণই টের পাচ্ছেন। সুতরাং রাজ্যপালের অস্থির আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের নিরঙ্কুশ বিপন্নতা।