যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
ভারতে ফেসবুক চালু হয়েছিল ২০০৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। তার আগে ১৫ জুলাই আত্মপ্রকাশ করেছিল টুইটার। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে নরেন্দ্র মোদি যখন টুইটারে অ্যাকাউন্ট খোলেন তখন তিনি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। সেই বছর দেশের মাত্র ২০টি বড় শহরে সামান্য প্রভাব ছিল ফেসবুক, টুইটারের। কিন্তু ২০১৪ সালে নির্বাচনী প্রচারের গোটা পরিসরই সোশ্যাল মিডিয়া দখল করে নিয়েছিল। প্রচারের ঝড়ে উড়ে গিয়েছিল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। সোশ্যাল মিডিয়ার সেই দাপট দেখে রাহুল গান্ধী টুইটারে অ্যাকাউন্ট খোলেন ২০১৫-র এপ্রিলে।
লক্ষ্য করুন, গেরুয়া শিবিরের সোশ্যাল মিডিয়া দখল কিন্তু এক বছরে হয়নি। ২০০৭ সালেই আইআইটি আমেদাবাদের গ্র্যাজুয়েট প্রদ্যোৎ বরার নেতৃত্বে আইটি সেল চালু করেছিল বিজেপি। নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে ২০১৫ সালে গেরুয়া শিবির ছেড়ে বেরিয়ে যান প্রদ্যোৎ। বাজপেয়ি আমলের নেতা প্রদ্যোৎ বরা পরে স্বীকার করেছিলেন, কীভাবে ভোটে জেতার জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে ভুয়ো প্রচারের কাজে ব্যবহার করেছিল বিজেপি। প্রদ্যোৎ বলেছিলেন, ‘সত্যের সঙ্গে সমঝোতা করার প্রক্রিয়া বিজেপিতে শুরু হয় ২০১৪ সালে। সেবার নির্বাচনী প্রচারে ছড়ানো হয়েছিল বিভ্রান্তিকর তথ্য। ভুলভাল ভিডিও। এলোমেলো মিম। তবে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে ভুয়ো খবর সরাসরি প্রচার করা হতো না। চুক্তির ভিত্তিতে এই ধরনের প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হতো অন্য কোনও সংস্থাকে।’
‘নরেন্দ্র মোদি’ নামক অতিমানবীয় সত্তার নির্মাণ, অথবা আশি শতাংশ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার দেশে ‘হিন্দুরা বিপন্ন’ নামক সম্পূর্ণ অলীক একটি ধারণাকে বহুজনবিশ্বাস্য করে তোলা— একবিংশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির একটি প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল ফেসবুক। অন্যদিকে, ভারতের মতো বিপুল বাজারে নিজেদের উপস্থিতির প্রাবল্য ক্রমেই বাড়িয়ে চলতে হলে যে দেশের শাসকদের হাতে রাখতে হয়, এ কথা ফেসবুক জানে। শুধু ভারতের ক্ষেত্রেই নয়, কথাটি দুনিয়ার সর্বত্রই সত্য। বিশেষত যেখানে শাসকরা চরিত্রে মূলগতভাবে একাধিপত্যকামী— শাসককে চটালে দেশের বাজারে টিকে থাকা মুশকিল। ফলে, ভারতেই গেরুয়া শিবির ও ফেসবুকের মধ্যে এক আশ্চর্য মিথোজীবী বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে।
২০১২ সালেই ফেসবুকের মতো ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকা সোশ্যাল মিডিয়া পুঁজিপতিদের কাছে বিনিয়োগের লোভনীয় ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এখানে বিজেপির রাজনৈতিক চাহিদার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পর্বটি। আবার এর সঙ্গে মিশেছিল এই মাধ্যমের বাজারকে প্রসারিত করে তুলে মুনাফা বৃদ্ধির তাগিদ। সেই কারণেই ২০১৪ সালের নির্বাচনে এই মাধ্যমগুলিকে কাজে লাগানোর জন্য বিজেপির সঙ্গে ডিজিটাল মিডিয়া ও বিজ্ঞাপন ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী পুঁজিপতিদের মধ্যে একটা অঘোষিত জোট তৈরি হয়েছিল। এই জোটই তাদের প্রচারকৌশলে মোদি মিথ তৈরি করে বিজেপিকে এককভাবে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে।
কারা কারা যুক্ত ছিলেন এই উদ্যোগে? ২০১৪-র লোকসভা ভোটে মোদির হয়ে প্রচারের দায়িত্বে ছিলেন মুম্বইয়ের রাজেশ জৈন। গুজরাতের মোদি ঘনিষ্ঠ এই ব্যবসায়ী ছিলেন ৯০-এর দশকের ডটকম ব্যবসার অন্যতম সফল পথিকৃৎ। রাজেশই বিজেপির আইটি স্ট্রাটেজিস্ট। ২০১৪ সালে মোদির ডিজিটাল প্রচারের কৌশল কী হবে তা নিয়ে রাজেশ বৈঠকও করেছিলেন ফেসবুক ও হোয়াটস অ্যাপের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। অভিযোগ, সেই সময় বিজেপির আইটি সেলের সদস্যদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল ফেসবুকের কর্মীরা। রাজেশকে সহযোগিতা করতেন শশীশেখর ভেম্পাতি। একদা ইনফোসিসের পদস্থ কর্তা শশীশেখর পরে হয়েছিলেন প্রসার ভারতী কর্পোরেশেনের সিইও। রাজেশের প্রচার টিমের নাম ছিল ‘ফ্রেন্ডস অব বিজেপি’। টিমের সদস্য সংখ্যা ছিল ১০০ জন।
পুনে থেকে উঠে আসা তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের অভিজ্ঞ অধ্যাপক ডক্টর হীরেন যোশি একসময়ে ছিলেন গুজরাতে মোদির ওএসডি। ২০০৮ সালে গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনের সময় ডিজিটাল প্রচার চালিয়ে মোদির প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। গান্ধীনগরে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে বসেই তিনি মোদির নির্বাচনী প্রচারের কাজ পরিচালনা করতেন। ফলে ২০১৪-র লোকসভা ভোটের প্রচারে তাঁর গুরুত্ব বাড়ে। মোদি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর যোশি হন পিএমও–র অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি। তিনি দেখেন গবেষণা ও কমিউনিকেশন টেকনোলজি দপ্তর। ব্লুক্রাফট ডিজিটাল ফাউন্ডেশনের সিইও অখিলেশ মিশ্র দেখতেন ভুয়ো খবর প্রচারের ওয়েবসাইট ‘দ্য ট্রু পিকচার’। এরাই মোদির লেখা বই প্রকাশ করত। নমো টিভির প্রচারের ভিডিও বানাত। পরে অখিলেশ মিশ্র ভারত সরকারের ওয়েবসাইট মাইগভ ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর হন। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপি-রাজে যুক্ত এরকমই আরও অনেক নাম।
কেন বিজেপি তাদের আইটি সেলকে এত গুরুত্ব দেয়, তা বোঝা যাবে এদেশে ইন্টারনেট ও সোশাল মিডিয়ার ব্যাপ্তি কতদূর সেদিকে নজর দিলে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের হিসেব অনুযায়ী, এদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬৯ কোটি ২০ লক্ষ। মোট জনসংখ্যার বিচারে ৪৮.৭ শতাংশ। জানুয়ারি ২০২৩-এর হিসেবে, এদেশে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪৬ কোটি ৭০ লক্ষ। মানে মোট জনসংখ্যার ৩২.৮ শতাংশ বা প্রায় এক তৃতীয়াংশ। বিজেপির আইটি সেলের কর্তা ও প্রাক্তন আইবিএম কর্মী বিনীত গোয়েঙ্কা বলেছিলেন, ২০১৩ সালে যখন লোকসভা ভোটের প্রচার পর্ব শুরু হতে চলেছে তখনই বিজেপির নেটওয়ার্কের সদস্য সংখ্যা ছিল ৭৮ হাজার। তারাই জোরকদমে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ ও টুইটারে মোদি ও বিজেপির হয়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিল গোটা দেশের সব শহর ও গ্রামীণ ব্লকে। শুধু দেশের মধ্যে নয়, আমেরিকায় এনআরআইদের মধ্যেও বিজেপি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। যাদের কাজ, শুধুই মোদির প্রচার করা। বিনীত গোয়েঙ্কার মন্তব্য, এদেশে ফেসবুক বিজেপিকে চেনায়নি, বিজেপিই ফেসবুককে চিনিয়েছিল।
আমেরিকায় ‘সাইবার সিকিওরিটি ফর ডেমোক্র্যাসি’ নামে একটা সংগঠন একটা রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। ফেসবুকের বিভিন্ন পেজকে ওরা পাঁচ ভাগে ভেঙেছিল— অতি-দক্ষিণপন্থী, দক্ষিণপন্থী, মধ্যপন্থী, বামপন্থী এবং অতি-বামপন্থী। পাঁচ মাস ধরে আশি লক্ষ পোস্টের পরিসংখ্যান বিচার করে জানা গেল যে, অতি-দক্ষিণপন্থী পেজের ভুয়ো খবরে সবচেয়ে বেশি এনগেজমেন্ট হয়। পেজের প্রতি এক হাজার ফলোয়ারপিছু গড়ে ৪২৫ জন তেমন পোস্ট লাইক করেন, তাতে কমেন্ট করেন, শেয়ার করেন। আর মধ্যপন্থী পেজ থেকে যথাযথ তথ্য শেয়ার করলে প্রতি হাজার ফলোয়ারে এনগেজমেন্ট ৮০, বামপন্থী পেজে ১০০, অতি-বামপন্থী পেজে ১৪৫। শুনলে অবাক হবেন, বিজেপির রয়েছে নিজস্ব ২ থেকে ৩ লক্ষ হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ। ‘দ্য পলিটিসাইজেশন অব সোশ্যাল মিডিয়া ইন ইন্ডিয়া’ প্রবন্ধে জেলভিন জোসে লিখেছেন, বিজেপি গোপনে পরিচালনা করে ১৮ হাজার ভুয়ো টুইটার হ্যান্ডেল। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ফেসবুক–হোয়াটস অ্যাপের কন্টেন্ট যত ব্যক্তিগত চরিত্রের হয় ততই তার আবেদন বেশি।
ফেসবুকের প্রাক্তন ডেটা সায়েন্টিস্ট সোফি ঝ্যাং তথ্যপ্রমাণ পেশ করে জানিয়েছিলেন, ভারতে ফেক অ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাটি বিজেপির প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। অভিযোগটিতে অবশ্য চমকে ওঠার অবকাশ নেই। ভারতে বিজেপির প্রতি ফেসবুকের পক্ষপাতের বহু প্রমাণ আগেও মিলেছে। বিজেপি নেতাদের বিদ্বেষমূলক প্রচারে ফেসবুক সজ্ঞানে নিষ্ক্রিয় থাকছে, এই অভিযোগে তোলপাড় হয়েছিল ২০২০ সাল। সোফি ঝ্যাং বলেছিলেন, বিনা বাধায় অজস্র দক্ষিণপন্থী ফেক অ্যাকাউন্ট রাখতে দেয় ফেসবুক। সেগুলি এইসব পেজের এনগেজমেন্ট বাড়ায়। এনগেজমেন্ট বেশি বলেই ফেসবুকের অ্যালগরিদম সেই পোস্টগুলিকে আরও ছড়িয়ে দেয়।
আসলে, সাধারণ মানুষের মনে অতি-দক্ষিণপন্থী ভুয়ো খবরের গ্রহণযোগ্যতা সত্য তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি। বিভিন্ন গবেষণা বলে, যাদের আইকিউ কম, তারাই অতি-দক্ষিণপন্থী রাজনীতির দিকে আকৃষ্ট হয়। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর কথায়, দক্ষিণপন্থী অর্থনীতির হাতে সবচেয়ে বেশি মার খেয়েছে যারা, তারাই দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সবচেয়ে বড় সমর্থক। কারণ, তাদের আর্থিক বিপন্নতা সব সময় তাদের আইকিউকে চেপে রাখে, আর ফাঁক গলে ঢোকে আদিম রিপুর রাজনীতি। দক্ষিণপন্থী রাজনীতির এই রকম লোকই দরকার, যারা বিশ্বাস করবে, মুসলিমরা সংখ্যায় বেড়ে গেলে হিন্দুদের সব অধিকার কেড়ে নেবে। এই রকম লোককেই দক্ষিণপন্থী রাজনীতির চাই, ভয় দেখালেই যারা প্রবল ভয় পেয়ে যায়।
আর সেই সুযোগেই ঘৃণার কুপ্রচারে গোটা সমাজকে তমসার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়!